দুই প্রধান রাজনৈতিক নেত্রীর প্রতি বিষোদগার করে জাতীয় প্রেসক্লাবে বুধবার এক গোলটেবিল আলোচনা হয়েছে, যাতে অংশ নিয়েছেন প্রবীণ সাংবাদিক এ বি এম মূসা, সৈয়দ আবুল মকসুদ, মাহমুদুর রহমান মান্না, আসিফ নজরুল প্রমুখ।
এ বি এম মূসা সাবেক দুই প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্ব দেয়ার ক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। আসিফ নজরুল সামরিক শাসক এইচ এম এরশাদের সঙ্গে তুলনা করে বলেছেন, দুই নেত্রী তার চেয়েও ‘খারাপ’।
নিউ ইয়র্ক থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক ‘আজকাল’ এর আয়োজনে এই গোলটেবিল আলোচনার শিরোনাম ছিল- ‘দুই নেত্রীর ওপর দায় চাপিয়ে কি দেশের গণতন্ত্র রক্ষা হবে?’
পাঁচ বছর আগে দুই নেত্রীকে রাজনীতি থেকে বিদায়ের এক চেষ্টা হয়েছিল। নতুন নির্বাচন নিয়ে রাজনীতিতে উত্তাপের মধ্যে এই গোলটেবিল বৈঠক হওয়ার আগে হিযবুত তাহরীরের মতো জঙ্গি সংগঠনের পাশাপাশি নতুন একটি সংগঠনও দুই নেত্রীকে বিদায় দেয়ার দাবি তুলেছে।
দেশের প্রথম সংসদে আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিত্বকারী এ বি এম মুসা বলেন, “দেশের রাজনীতিতে এখন পরিবারতন্ত্র, স্বামীতন্ত্র এবং পিতৃতন্ত্র চলছে। আমাদের দেশের মূর্তিপূজার ট্রাডিশন এখন ব্যক্তিপূজায় পরিণত হয়েছে।”
“খালেদা জিয়া বা শেখ হাসিনার ১৬ কোটি মানুষের নেতৃত্ব দেয়ার ক্ষমতা নাই,” বলেন অশীতিপর মূসা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আসিফ নজরুল সামরিক শাসনের সঙ্গে তুলনা করে বলেন, “এমন না আমি এরশাদকে গ্লোরিফাই করছি। আমি বলার চেষ্টা করছি- একজন সামরিক শাসক, যাকে আমরা এত সমালোচনা করি, তার চেয়েও এরা খারাপ, দুই নেত্রী।”
এরশাদের সামরিক শাসনকে ‘গ্লোরিফাই’ করছেন না বলার আগেই তিনি বলেন, তখন দেশের শিল্প, সংস্কৃতি ও সাহিত্যেও একটা উল্লেখযোগ্য ‘জোয়ার’ এসেছিল।
“অবশ্য এরশাদের আমলে একটা ট্রাক দুর্ঘটনা ঘটেছিল।”
দেশের দ্বিতীয় সামরিক শাসক এরশাদের ক্ষমতারোহণের শুরুতে যখন আন্দোলন দানা বেঁধে উঠছিল, সেই ১৯৮৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি ছাত্রদের মিছিলে ট্রাক তুলে দেয়া হয়, যাতে প্রাণ হারান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্র ইব্রাহিম সেলিম ও কাজী দেলোয়ার হোসেন।
এছাড়াও এরশাদের সামরিক শাসনের অবসানে রাজনৈতিক ও ছাত্র আন্দোলনে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে প্রাণ হারিয়েছিলেন জাফর, জয়নাল, দীপালি সাহা, নূর হোসেন, নাজিরুল জেহাদসহ অনেকে।
এছাড়াও এরশাদের মদদপুষ্ট বাহিনীর হামলায় নিহতের তালিকাও দীর্ঘ। এর মধ্যে রয়েছেন ডা. শামসুল আলম মিলন, আওয়ামী লীগ নেতা ময়েজউদ্দিনও।
‘ক্রসফায়ার’, ‘গুম’ ইত্যাদি বিষয়গুলো তুলে ধরে আসিফ নজরুল বলেন, “ক্রসফায়ার, গুমের মতো হুমকি এরশাদ চালু করেছিল, না খালেদা-হাসিনা চালু করেছে?
এরশাদ শাসনের অবসানের পর ভোটে নির্বাচিত দুই নেত্রীর আমলে গণতন্ত্র সংহত হয়নি বলেও মনে করেন তিনি।
“আপনারা একটু সংবিধানের দিকে তাকিয়ে দেখেন তো। অবশ্যই পঞ্চম এবং সপ্তম সংশোধনী অত্যন্ত খারাপ, মার্শাল ল’র শাসন ছিল। এটা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই আমাদের।”
“কিন্তু গণতান্ত্রিক আমলে কী হয়েছিল? বঙ্গবন্ধু সরকারের আমলে চতুর্থ সংশোধন (সংবিধানের) হয়েছিল, যেখানে সমস্ত দলই নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়েছিল। মার্শাল ল ওলারা এত বড় কাজ করেনি, সমস্ত দল নিষিদ্ধ করেনি।”
“সামরিক শাসনামলে বাংলাদেশে যে প্রতিষ্ঠানগুলো ছিল, এখন সে প্রতিষ্ঠানগুলো আরো বেটার কাজ করছে? জুডিশিয়ারি বেটার কাজ করছে? এরশাদের আমলে জুডিশিয়ারি এরশাদের বিরুদ্ধে কয়টা রায় দিয়েছিল, এখন কয়টা দিচ্ছে? এরশাদের আমলে ডাকসু ইলেকশন হয়েছিল, এখন হচ্ছে?”
“এই গণতান্ত্রিক সরকারের আমলে একটা নির্দিষ্ট বিচারককে কেয়ারটেকার গভর্নমেন্টের প্রধান করে দেশটা অশান্তির দিকে, রক্তারক্তির দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছিল “
“আরেক সরকার সংবিধান এমনই পরিবর্তন করেছেন যে এই সংবিধানের বিরুদ্ধে কোনো কথা বললেও মৃত্যুদণ্ড এটা গণতন্ত্র সংহতকরণ?” সমালোচনার ধারা অব্যাহত রাখেন আসিফ নজরুল, যাকে সম্প্রতি আদালত অবমাননার অভিযোগে তলব করা হয়েছিল।
ডাকসুর দুই বারের নির্বাচিত ভিপি মাহমুদুর রহমান মান্না গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার ২২ বছরে স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন না হওয়ার সমালোচনা করেন।
আওয়ামী লীগের সাবেক এই সাংগঠনিক সম্পাদক বলেন, “স্বৈরাচার এরশাদ নয় বছরে দুই বার ডাকসু নির্বাচন দিয়েছেন। আর দুটি গণতান্ত্রিক দল ২২ বছরে একটাও নির্বাচন দেননি।”
“হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ নির্বাচন দিতে পেরেছিলেন, কারণ তার তো ছেলে নাই। কিন্তু দুই নেত্রীর দুইটা ছেলে। নির্বাচন দিলে আরো দুইটা তোফায়েল আহমেদ তৈরি হবে। সুতরাং কী দরকার?”
২০০৭ সালে জরুরি অবস্থা জারির পর সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে দলে সংস্কারের প্রস্তাব তুলে সংস্কারপন্থী হিসেবে যারা পরিচিতি পান, তাদের মধ্যে মান্না ও তোফায়েল দুজনের নামই ছিল। বলা হয়, শেখ হাসিনাকে রাজনীতি থেকে বিদায়ের চেষ্টার অংশ ছিল ওই সংস্কার প্রস্তাব।
পরে দলের কাউন্সিল হলে মাহমুদুর রহমান মান্না কোনো পদে আসতে পারেননি, দলের নীতি-নিধর্থারণী পদও হারান তোফায়েল।
ওই সময় আওয়ামী লীগের মতো বিএনপিতেও খালেদা জিয়াকে ‘মাইনাস’ করার চেষ্টা চলে, তবে তাও সফল হয়নি। ওই সময় তা ‘মাইনাস টু’ নামেই আলোচিত ছিল।
সাংবাদিক সৈয়দ আবুল মকসুদ বর্তমানের রাজনীতিকে ‘মিডিয়ানির্ভর রাজনীতি’ আখ্যায়িত করে বলেন, “এই রাজনীতির কারণে জনগণের রাজনীতি আর নেই।”
তবে তিনি এর দায় পুরোপুরি দুই প্রধান নেত্রীর ওপর না দিয়ে প্রথম আলোর এই কলামনিস্ট বলেন, “দুই নেত্রীর চেয়ে তাদের দলের শীর্ষ নেতাদের ব্যর্থতা আমি বেশি দেখি। (তারা) জনগণের আবেগ-অনুভূতি ও রাষ্ট্রের চাহিদা বুঝে জনগণের কাছে গেলে দুই নেত্রীর প্রভাব কমে আসবে।”
আবুল মকসুদ যে সংবাদপত্রে নিয়মিত লেখেন, সেই পত্রিকাটি ২০০৭ সালের সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সমর্থন দিয়েছিল এবং নতুন করে আবার সেই ধরনের সরকার আসার পথ তৈরিতেও তারা সক্রিয় বলে আওয়ামী লীগ নেতারা ইঙ্গিত করছেন।
আলোচনায় অংশ নিয়ে সাংবাদিক মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল প্রধান দুই দলকে নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেন।
তিনি বলেন, “দেশপ্রেমের বোধ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাসম্পন্ন তৃতীয় রাজনৈতিক শক্তির প্রয়োজন।”
আলোচনায় অংশ নেয়া একমাত্র সংসদ সদস্য গোলাম মাওলা রনি দুই প্রধান রাজনৈতিক দলকে নিয়ে এত সমালোচনার মধ্যে স্বীকার করেন, দলগুলোতে আত্মসমালোচনার অভাব রয়েছে।
আওয়ামী লীগের এই সংসদ সদস্য বলেন, “আমার দলের লোকদের সামনে থেকে দেখেছি, পেছনে বসে বসে গম্ভীরভাবে এত্তসব আজেবাজে সমালোচনা করে। যে সমালোচনা শুনলে মনে হয় যে সে দলের সঙ্গেই সম্পৃক্ত নয়।
“কিন্তু যখনই সে নেতা বা নেত্রী কোনো ঊর্ধ্বতন নেতার কাছে যান, তার চোখে-মুখে কৃতজ্ঞতা এবং দালালির যে আলুথালুভাব আমি দেখতে পাই, তাতে আমার মনেই হয় না উনি আগে যে কথাগুলো বলেছিলেন সেগুলো আমি শুনেছিলাম, না স্বপ্নে দেখেছিলাম।”