কান টানলে মাথা আসে বলেই পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির ঘটনায় আবুলদের বিরুদ্ধে মামলা হয়নি বলে মন্তব্য করেছেন বিরোধী নেতা ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। বলেছেন, আপনারা সরকারের কাছে একবার জানতে চান কেন পদ্মা সেতু হলো না? কেন আবুলদের বিরুদ্ধে মামলা হয় না। আসলে আবুলদের বিরুদ্ধে মামলা হয়নি কারণ কান টানলে মাথা আসে। তাদের টান দিলেই মাথা চলে আসবে। রাজধানীর মহানগর নাট্যমঞ্চে মুক্তিযোদ্ধা দল আয়োজিত মুক্তিযোদ্ধা সংবর্ধনা ও সমাবেশে তিনি এ মন্তব্য করেন। খালেদা জিয়া বলেন, পদ্মা সেতুর কাজ শুরুর আগেই সরকারের লোকজন বিদেশে ঘুষ আদান-প্রদান করেছে। তাই দীর্ঘদিন টালবাহানার পর সরকার বিশ্বব্যাংককে শর্ত দিয়েছে টাকা দিলে আবুলদের বিরুদ্ধে মামলা হবে। সরকারের এ শর্তেই প্রমাণ হয় দুর্নীতি হয়েছে এবং সরকারই তা স্বীকার করে নিয়েছে। তিনি বলেন, সরকার ব্যস্ত কমিশন নিয়ে ও চোরদের বাঁচাতে। সরকারের ডানে চোর, বাঁয়ে চোর। মন্ত্রী, এমপি, উপদেষ্টা, আত্মীয়-স্বজনসহ সরকার নিজেই চোর। হলমার্ক, সোনালী ব্যাংক লুটপাট করেছে সরকারের লোকজন। আওয়ামী লীগ শেয়ারবাজার লুটের মাধ্যমে দেড় কোটি মানুষকে নিঃস্ব করেছে। প্রধানমন্ত্রীর আত্মীয়-স্বজন ভিওআইপি ব্যবসার মাধ্যমে দেশকে লুটেপুটে খাচ্ছে। বিরোধী নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তারের সমালোচনা করে খালেদা জিয়া বলেন, আমাদের দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ ২৫ হাজার নেতাকর্মীকে কারাবন্দি করেছে সরকার। কিন্তু মামলা ও গ্রেপ্তার করে আন্দোলন দমানো যাবে না। একদল গ্রেপ্তার হলে আন্দোলনে আরেক দল যোগ হবে। এখন যোগ হওয়ার সময়।
বিরোধী নেতা বলেন, মানচিত্র বদলে দেয়ার ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। তাই সীমান্তে আমাদের ভাইদের হত্যা করা হচ্ছে। ফেলানীদের হত্যা করে কাঁটাতারে ঝুলিয়ে রাখা হচ্ছে। কিন্তু সরকার প্রতিবাদ করছে না। তিনি বলেন, বিদেশী ও প্রতিবেশীদের সঙ্গে আমরা সমমর্যাদার ভিত্তিতে বন্ধুত্ব চাই। মাথা উঁচু করে থাকতে চাই। মাথা নিচু করে, হাত জোড় করে নয়। কিন্তু আওয়ামী লীগ দেশের মানুষকে যেভাবে পদানত করে রেখেছে ঠিক তেমনি তারা বিদেশে মাথা নত করে রয়েছে। এর মাধ্যমে তারা ক্ষমতায় দীর্ঘস্থায়ী হতে চায়। খালেদা জিয়া বলেন, দেশের তরুণ প্রজন্ম আওয়ামী লীগের অতীত ইতিহাস সম্পর্কে জানে না। মুক্তিযোদ্ধাদের উচিত তরুণ প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধ ও আওয়ামী লীগের দুঃশাসনের ইতিহাস তুলে ধরা। ’৭১-’৭৩ সালে আওয়ামী লীগ নেতারা লুটপাটে ব্যস্ত ছিল। আওয়ামী লীগের লোকজনই পাকিস্তানিদের ফেলে যাওয়া সম্পত্তি ও হিন্দুদের সম্পত্তি দখল করেছে। ব্যাংক লুট করেছে। তারা তাদের নেতার কথাও শোনেননি। তাই শেখ মুজিব বলেছিলেন, সবাই পায় সোনার খনি, আমি পেলাম চোরের খনি। চোর কি করে মুক্তিযোদ্ধা হয়? আওয়ামী লীগ হচ্ছে সেই চোরের দল। তিনি বলেন, ’৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের ব্যাপারে আওয়ামী লীগ কি জবাব দেবে? যুদ্ধের পর তো প্রচুর বৈদেশিক সাহায্য এসেছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগের লোকজন সেগুলো বিদেশে পাচার করে পকেট ভারি করেছিল। আওয়ামী লীগ মানেই দুর্ভিক্ষ, খুন, লুটপাট ও চুরির শাসন। তিনি সরকারের কৃষিনীতির সমালোচনা করে বলেন, সরকার কৃষকদের কাছে ধান কিনছে না। তারা কমিশনের জন্য বিদেশ থেকে আমদানি করছে। এর মাধ্যমে কৃষকদের উৎপাদনের নিরুৎসাহী করে তুলছে। একই ভাবে কলকারখানায় উৎপাদন নেই। সেখানে সরকার গ্যাস, বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারছে না। বিদেশী বিনিয়োগ তো নেই-ই। কিন্তু বিদ্যুতের কথা বলে সরকার কুইক রেন্টালের নামে নিজেদের পকেট ভারি করেছে।
বিশ্বজিৎ হত্যার ঘটনায় প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের সমালোচনা করে বিরোধী নেতা বলেন, বিশ্বজিতের মতো তরুণকে কেন রাজপথে প্রাণ দিতে হলো? তারপরও প্রধানমন্ত্রী কেন মিথ্যা বলছেন? কারণ ছাত্রলীগকে ধরলে তারা বলবে, আমাদের কি দোষ? আমরা তো ওইখান থেকে নির্দেশ পেয়ে কেবল নির্দেশ পালন করেছি। আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের পর ৪০ হাজার মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করেছে। যারা এ হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে তাদেরও বিচার হওয়া উচিত। বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, আমাদের আন্দোলনের দাবি সুনির্দিষ্ট। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন। এ দেশের কোন দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে দেয়া হবে না। আওয়ামী লীগ দেশে গণতন্ত্র আনেনি, তারা বারবার গণতন্ত্র হত্যা করেছে। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের আহ্বান জানিয়ে বলেন, আসুন আপনারা দলমত নির্বিশেষে সকল মুক্তিযোদ্ধা জালিম সরকারের পতন ও দেশ রক্ষার এ সংগ্রামে শরিক হোন।
বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, বিজয়ের মাসে মুক্তিযোদ্ধাদের সমাবেশ করতে নানা প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে সরকার। শেষ পর্যন্ত এ হলে অনুষ্ঠানের অনুমতি দিয়েছে। আমরা বিজয় দিবসের অনুষ্ঠান করতে চাইলেও অনুমতি দেয়া হয়নি। দেখে-শুনে মনে হচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশকে তারা পৈতৃক সম্পত্তি মনে করছে। তবে এদেশকে কারও পৈতৃক সম্পত্তি বানাতে দেয়া হবে না। তিনি বলেন, জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ডাক দিয়েছেন, আপনাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছেন। যুদ্ধ শেষে আপনাদের মতোই নিজের জায়গায় ফিরে গেছেন। আপনারাই সত্যিকারের মুক্তিযোদ্ধা। রণাঙ্গনে দেশকে স্বাধীন করেছেন। সীমান্ত পাড়ি দিলেই মুক্তিযোদ্ধা হয় না। খালেদা জিয়া বলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা থেকে নাম কাটার হুমকি দিয়েছে সরকার। ভাতা বন্ধ করার হুমকি দিয়েছে। যদি নাম কাটা হয় ভবিষ্যতে সে নাম যোগ হবে, ভাতাও দেয়া হবে। শুধু তাই নয়, ভবিষ্যতে মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা বাড়ানো হবে। তিনি বলেন, আমিই মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠন করেছিলাম। ভবিষ্যতে সে মন্ত্রণালয়ে একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাকে দায়িত্ব দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক মূল্যায়ন করা হবে। মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের সন্তানদের চিকিৎসার জন্য একটি উন্নত হাসপাতাল তৈরি করবো।
মুক্তিযোদ্ধারা কোন দলের সম্পদ নয়
এলডিপির চেয়ারম্যান কর্নেল (অব.) অলি আহমদ বীরবিক্রম বলেন, দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে মুক্তিযোদ্ধাদের উচিত খালেদা জিয়ার ডাকে সাড়া দিয়ে দেশরক্ষার আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়া। বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ বলেন, জাতিসংঘ নাকি শেখ হাসিনার শান্তির মডেল গ্রহণ করেছে। তারা যদি জানতেন তিনি দেশে কি রকম অশান্তির ও দুর্নীতির মডেল বাস্তবায়ন করছেন তাহলে দুর্নীতির একটি পুরস্কার দিতো। বিএনপি স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য তরিকুল ইসলাম বলেন, মুক্তিযুদ্ধ একটি চলমান প্রক্রিয়া। যখন গুমের মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে, খুনে রাজপথ রঞ্জিত হচ্ছে, সরকার লুটপাটে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে তখন সে চলমান প্রক্রিয়াকে ফের যুদ্ধে পরিণত করতে হবে। কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মে. জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীরপ্রতীক বলেন, ২৫শে মার্চ রাতেই জিয়াউর রহমান তার অধীনস্থ সৈন্যদের নিয়ে বিদ্রোহ করেন। সেদিন এত উন্নত গণমাধ্যম ছিল না বলেই তা ইতিহাসে লেখা নেই। তবে সেটাই সত্য। তিনি মুক্তিযোদ্ধা কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের চেয়ারম্যান হেলাল মোর্শেদ খানের উদ্দেশে বলেন, ’৯৬ সালে আপনার উল্টাপাল্টা কাজের জন্য অনেক মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তা চাকরি হারিয়েছে। এখন উল্টাপাল্টা করবেন না, জবাব দিতে হবে। বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান বলেন, ৭১-এর ৩রা মার্চ ঢাকায় সংসদ বসলে শেখ মুজিব হতেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। তিনিই শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানিদের সঙ্গে গোলটেবিল বৈঠক করেছেন, আপস করেছেন। আমরা ভাসানীর নেতৃত্বে যুদ্ধ করেছি, দেশবাসী জিয়ার ডাকে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নিয়েছে। বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, মুক্তিযুদ্ধের আগে রাজনীতি করেছি আমরা, যুদ্ধও করেছি। কিন্তু এখন তা সম্পদ হয়ে গেল আওয়ামী লীগের। অতীতে অনেক কোয়ার্টার-সেমিফাইনাল খেলেছি, এবার ফাইনাল খেলতে হবে। মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য জয়নাল আবেদিন এমপি বলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের নাম কাটার এখতিয়ার হেলাল মোর্শেদ খানদের কে দিয়েছে? ভবিষ্যতে এ ধরনের বক্তব্যের জন্য তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা হবে। সংবর্ধনা সমাবেশের আহ্বায়ক মেজর (অব.) শাহজাহান ওমর বীরউত্তম বলেন, প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে অনুষ্ঠানে অংশ নেয়া মুক্তিযোদ্ধাদের অভিনন্দন জানাই। সেই সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের চেয়ারম্যান হেলাল মোর্শেদের পদত্যাগ দাবি করছি। ঢাকা মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব আবদুস সালামের পরিচালনায় সমাবেশে আরও বক্তব্য রাখেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, মে. জেনারেল (অব.) আইনউদ্দিন বীরপ্রতীক, মুক্তিযোদ্ধা দলের সভাপতি অধ্যক্ষ সোহবারউদ্দিন, ক্যাপ্টেন (অব.) শাহজাহান মিয়া, ইশতিয়াক আহমেদ উলফাত, প্রজন্ম দলের সভাপতি শামা ওবায়েদ, ইসমাঈল হোসেন বেঙ্গল, মেজর (অব.) ড. রেজা প্রমুখ। বক্তৃতায় মুক্তিযোদ্ধারা অভিযোগ করে বলেন, মুক্তিযোদ্ধা কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের সভাপতি হেলাল মোর্শেদ সারা দেশের মুক্তিযোদ্ধাদের চিঠি দিয়ে এই সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে না আসার অনুরোধ জানান। তারা বলেন, মুক্তিযোদ্ধারা কোন ব্যক্তি বা দলের নয়, তারা দেশের সম্পদ। ৭১ দেশের স্বাধীনতার জন্য একবার মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম। এবার দেশের গণতন্ত্র টিকিয়ে রাখার জন্য আরেকবার মুক্তিযুদ্ধ করতে হবে।
এর আগে সকাল ১০টা থেকেই সারা দেশের ৭৫টি সাংগঠনিক জেলা থেকে মুক্তিযোদ্ধারা মহানগর নাট্যমঞ্চের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যোগ দেন। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অনুষ্ঠানস্থল কানায় পূর্ণ হয়ে যায়। বিজয়ের ৪১তম বার্ষিকীতে দেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানিত করার জন্য বিরোধী দল বিএনপি মুক্তিযোদ্ধা সংবর্ধনার অয়োজন করে।