ব্যাংকের সংকট বাড়িয়েছেন রাজনৈতিক পরিচালকেরা

ব্যাংকের সংকট বাড়িয়েছেন রাজনৈতিক পরিচালকেরা

আবদুর রহমান বিশ্বাসকে ১৯৭৭ সালে অগ্রণী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান নিযুক্ত করেছিলেন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। আবদুর রহমান তখনই বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। পরে তিনি বিএনপির হয়ে সাংসদ হন, আরও পরে রাষ্ট্রপতি। সেই থেকে শুরু সরকারি ব্যাংকের পর্ষদে রাজনৈতিক নিয়োগ।
এর পর থেকে প্রতিটি সরকারই রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোতে (আগে বলা হতো রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক) রাজনৈতিক বিবেচনায় পরিচালক নিয়োগ দিয়ে আসছে। এসব পরিচালক ব্যাংকের স্বার্থের চেয়ে নিজেদের স্বার্থই দেখেছেন বেশি। এতে ব্যাংকের সংকট আরও বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ মনে করেন, এতে ব্যাংকের যেমন ক্ষতি হয়েছে, তেমনি নিয়োগ দেওয়া ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলগুলোরও ক্ষতি হয়েছে।
রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকে রাজনৈতিক ব্যক্তিদের পরিচালক নিয়োগ দেওয়ার ক্ষেত্রে অতীতের সব রেকর্ড অবশ্য ছাড়িয়ে গেছে বর্তমান সরকারের সময়। ব্যাংকে এতসংখ্যক রাজনীতিবিদকে এর আগে কখনোই নিয়োগ দেওয়া হয়নি। এই সরকারের সময়েই ব্যাংকে প্রথমবারের মতো নিম্ন সারির রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের ব্যাংকের পরিচালক পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
তাঁদের বেশির ভাগেরই নির্দিষ্ট কোনো পেশা ছিল না, পরিচালক পদটাই পেশায় পরিণত হয়েছিল।
পর্ষদকে রাজনীতিকরণ করায় ব্যাংকগুলোর পরিস্থিতিও খারাপ হয়েছে। রাষ্ট্রমালিকানাধীন প্রতিটি ব্যাংকের সূচক খারাপের দিকে গেছে। এই সরকারের সময়েই বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছে। রাষ্ট্র মালিক হলেও পরিচালনা ও দক্ষতার কারণে বেসিক ব্যাংক একটি আদর্শ ব্যাংকে পরিণত হয়েছিল। এই ব্যাংকটিও এখন সমস্যায়।
প্রথম দফায় নিয়োগ দেওয়া পরিচালকদের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। এখন আবার নতুন করে নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আবারও কয়েকজন রাজনীতিবিদকে ব্যাংকের পরিচালক নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে বলে অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে। তাঁদের মধ্যে ছাত্রলীগের সাবেক নেতাদের সংখ্যাই বেশি। পদবঞ্চিতদের পুরস্কার দিতেই এ ব্যবস্থা।
পুরোনো কথা: ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর শুরু হয়েছিল সামরিক শাসন। সে সময় থেকে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে সামরিক বাহিনীর সদস্যদের পরিচালক নিয়োগ দেওয়া শুরু হয়। সামরিক বাহিনীর সদস্যদের পর্ষদে নিয়োগ দেওয়ার সেই ধারা চলেছে ২০০৮ সাল পর্যন্ত।
এরশাদ সরকারের আমলে জাতীয় পার্টির সাংসদ এবং অবসরপ্রাপ্ত ও চাকরিরত সরকারি কর্মকর্তারা পর্ষদের সদস্য হতেন। তবে ১৯৮৮ সালে দেশের একজন অন্যতম শীর্ষ ঋণখেলাপি নারায়ণগঞ্জের ফজলুর রহমানকে সোনালী ব্যাংকের পরিচালক বানিয়ে নজির সৃষ্টি করা হয়েছিল।
১৯৯০ সালের পর বিএনপি সরকার ব্যাংকের চেয়ারম্যান করেছিল অবসরপ্রাপ্ত সচিবদের। তখন পরিচালক পদে নিয়োগ পান সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তারা। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় তৎকালীন অর্থমন্ত্রী শাহ এম এস কিবরিয়া প্রথমবারের মতো পেশাজীবীদের ব্যাংকের পর্ষদে নিয়োগ দেন। অর্থনীতিবিদদের মধ্যে আতিউর রহমান, দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, সুশীল রঞ্জন হাওলাদার ও নাসরীন খোন্দকার বিভিন্ন ব্যাংকের পর্ষদে স্থান পেয়েছিলেন। এ ছাড়া কয়েকজন সরকার-সমর্থক ব্যবসায়ীও পরিচালক হয়েছিলেন। যেমন শামসুদ্দোহা, লুৎফর রহমান, রশিদুজ্জামান প্রমুখ।
২০০১ সালে আবার ক্ষমতায় আসে বিএনপি সরকার। সে সময় বিভিন্ন ব্যাংকের চেয়ারম্যান করা হয় সাবেক ও কর্মরত সচিবদের। পাশাপাশি প্রতিটি ব্যাংকেই সশস্ত্র বাহিনীর একজন কর্মকর্তাকে পরিচালক পদে রাখা হয়েছিল।
সোনালী ব্যাংকে সে সময় তিনজন পর্ষদ চেয়ারম্যানের দায়িত্বে ছিলেন। যেমন, সাবেক সচিব মির্জা আজিজুল ইসলাম (পরে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা), সাবেক সচিব আসাফউদ্দোলা এবং অর্থনীতিবিদ মাহবুবউল্লাহ। মির্জা আজিজ সে সময়ের রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের ছেলের একটি ঋণ প্রস্তাব নিয়ে চাপ দেওয়ায় পদত্যাগ করেছিলেন। এর পরে বিএনপির রাজনীতির সমর্থক মাহবুবউল্লাহকে চেয়ারম্যান করা হয়। সোনালী ব্যাংকে সরকারি কর্মকর্তাদের বাইরে পরিচালক ছিলেন শেখ আবদুল হাফিজ এফসিএ।
অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান নিয়োগ করা হয়েছিল পরিকল্পনা বিভাগের সচিব এম ফজলুর রহমানকে। এই ব্যাংকে সরকারি কর্মকর্তা ছাড়াও পরিচালক পদে ছিলেন বিজিএমইএর পরিচালক নুরুল হক এবং বিএনপি-সমর্থক সংগঠন ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ড্যাব) ভাইস প্রেসিডেন্ট শাহরিয়ার হোসাইন চৌধুরী।
জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের সচিব খন্দকার শহিদুল ইসলাম। আর পরিচালক পদে সরকারি কর্মকর্তাদের বাইরে ছিলেন ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস-এর সম্পাদক এ এইচ এম মোয়াজ্জেম হোসেন ও ফেনী চেম্বারের সভাপতি শেখ নুরুল আলম।
এই সময়: প্রত্যক্ষভাবে রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের ব্যাংকের পরিচালক করা হয়েছে বর্তমান সরকারের আমলেই। মূলত দলীয় লোকজনকে আনুগত্যের পুরস্কার দিতেই তাঁদের ব্যাংকের পরিচালক করা হয়েছিল বলে ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করেন। ব্যাংকের পরিচালক হতে ছাত্রলীগের সাবেক নেতাদের আগ্রহই বেশি দেখা গেছে।
সোনালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান সাবেক ব্যাংকার কাজী বাহারুল ইসলাম। এ ব্যাংকের পরিচালক ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জগন্নাথ হল ছাত্রলীগ থেকে নির্বাচিত সাবেক ভিপি সুভাষ সিংহ রায়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির আন্তর্জাতিক সম্পাদক সাইমুম সরোয়ার, সিরাজগঞ্জ-২ আসনে আওয়ামী লীগদলীয় পরাজিত প্রার্থী এবং মহিলা আওয়ামী লীগের বন ও পরিবেশবিষয়ক সম্পাদক জান্নাত আরা হেনরী, সাংসদ এম আসাদুজ্জামানের ছেলে ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপকমিটির সহসম্পাদক কে এম জামান রোমেল, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সত্যেন্দ্র চন্দ্র ভক্ত এবং দৈনিক সংবাদ-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাশেম হুমায়ুন।
অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বজলুল হক খোন্দকার। আর পরিচালক হিসেবে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু হলের সাবেক ভিপি মঞ্জুরুল হক, বুয়েট ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবদুস সবুর এবং ছাত্রলীগের সাবেক নেতা শাহাজাদা মহিউদ্দিন। জনতা ব্যাংকের পরিচালক ছিলেন সাবেক ছাত্রলীগ নেতা বলরাম পোদ্দার, রূপালী ব্যাংকে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম চৌধুরী ও যুবলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মাহাবুবুর রহমান। এর বাইরে বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান করা হয় শরিক দল জাতীয় পার্টির সাবেক সাংসদ শেখ আবদুল হাই এবং কৃষি ব্যাংকের পরিচালক করা হয়েছিল যুবলীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবিরকে।
কোনো সুপারিশই মানা হয়নি: ১৯৯৬ সালে দায়িত্ব নিয়েই শাহ এম এস কিবরিয়া অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদকে প্রধান করে একটি ব্যাংক সংস্কার কমিটি গঠন করেছিলেন। সেই কমিটি ১৯৯৯ সালে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়ে বলেছিল, ‘পরিচালনা পর্ষদ এমন ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত হবে, যাঁরা ব্যাংকিং ও অর্থনৈতিক বিষয়ে অভিজ্ঞ এবং সামাজিক দায়িত্ববোধসম্পন্ন এবং যাঁদের ছত্রচ্ছায়ায় ব্যাংক কর্মকর্তারা সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে নিজ নিজ দায়িত্ব পালনে অনুপ্রেরণা পাবেন।’ কমিটির সুনির্দিষ্ট সুপারিশ ছিল, কোনো সাংসদ বা কোনো রাজনৈতিক দলের কোনো ধরনের পদে আছেন—এমন কাউকে পরিচালক করা যাবে না।
১৯৯৮ সালেই বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকিং খাত নিয়ে তিন খণ্ডের একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেই প্রতিবেদনেও বিশ্বব্যাংক কোনো অবস্থাতেই রাজনীতিবিদদের সরকারি ব্যাংকের পরিচালক করা যাবে না বলে সুপারিশ করেছিল। কারণ, এতে ব্যাংকের রাজনীতিকরণ হয় এবং স্বার্থের সংঘাত ঘটে।
বর্তমান সরকারও ক্ষমতায় আসার তিন মাসের মাথায়, ২০০৯ সালের ১২ এপ্রিল অর্থ মন্ত্রণালয় একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেছিল। প্রজ্ঞাপনে ব্যাংকের পর্ষদে অর্থনীতিবিদ, চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট, আর্থিক বাজার, মুদ্রানীতি ও আর্থিক ব্যবস্থাপনা বিষয়ে অভিজ্ঞতা ও দক্ষতাসম্পন্ন ব্যক্তি, সাবেক ব্যাংকার, আইনজ্ঞ, বেসরকারি খাতের ব্যবসায়ী প্রতিনিধি ও কমপক্ষে একজন নারী পেশাজীবী নিয়োগের কথা বলা ছিল। এর পরেও এই সরকারই কেবল রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে পরিচালক নিয়োগ দেয়।
বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন সময়ে সার্কুলার দিয়ে ব্যাংক পরিচালকেরা কী করতে পারবেন না, তা বলে দিয়েছে। ২০১০ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি জারি করা সার্কুলারে বলা আছে, পরিচালকেরা ব্যাংকের দৈনন্দিন কাজে হস্তক্ষেপ, ব্যাংকের রুটিন কিংবা প্রশাসনিক কাজে নিজেদের সম্পৃক্ত, ব্যাংকের কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীকে কোনো বিষয়ে নির্দেশনা প্রদান, কোনো ঋণ প্রস্তাবে জামিনদার এবং কাউকে কোনো সুবিধা দেওয়ার বিষয়ে ব্যবস্থাপনা পর্ষদকে প্রভাবিত করবেন না। অথচ পর্ষদ এসব কাজে সম্পৃক্ত হওয়ায় অর্থমন্ত্রীকে আলাদা একটি চিঠি দিতে বাধ্য হয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আতিউর রহমান ২০১১ সালের ৪ জানুয়ারি অর্থমন্ত্রীকে একটি চিঠি দিয়ে পর্ষদ পরিবর্তনের সুপারিশ করেছিলেন। চিঠিতে লেখা ছিল, ‘ব্যাংকের ঋণ অনুমোদন, বদলি, পদোন্নতি ইত্যাদিতে পর্ষদ সদস্যরা সরাসরি হস্তক্ষেপ ও প্রভাব বিস্তার করছে।’ সেই চিঠিও আমলে নেওয়া হয়নি।
খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, রাজনীতিবিদদের পরিচালক পদে নিয়োগে আপত্তি নেই, কিন্তু ভালো লোক আছে তো? সরাসরি রাজনীতিবিদ নন, কিন্তু একই ধরনের মনোভাব পোষণ করেন এমন পেশাজীবী তো আছেন। এমন লোকজনকে নিয়োগ দিতে হবে, যাঁরা তদবির করবেন না, রাজনীতিকরণ করবেন না, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, পরিপক্ব। তা না হলে কেউ রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠতে পারেন না। তাঁরা ব্যাংকটিকে বরং ভালো করার চেয়ে নষ্ট করে দেন।

 

অন্যান্য অর্থ বাণিজ্য বাংলাদেশ রাজনীতি শীর্ষ খবর