অন্যদিকে বিশ্বজিত্ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় গতকাল কোতয়ালী ও সূত্রাপুর থানা অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছে এলাকাবাসী।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহী উদ্দীন খান আলমগীর গতকাল সাংবাদিকদের বলেন, বিশ্বজিত্ হত্যাকাণ্ডে ছাত্রলীগ জড়িত নয়। ছাত্রলীগে অনুপ্রবেশকারীরা এ জঘন্য হত্যাকাণ্ডে জড়িত। বিশ্বজিত্ হত্যাকাণ্ডে জড়িত যেই হউক কাউকে ছাড় দেয়া হবে না বলে তিনি জানান।
জানা গেছে, হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের গ্রেফতারে ডিবির উপ-কমিশনার (দক্ষিণ) মনিরুল ইসলামের নির্দেশে একাধিক টীমকে দায়িত্ব দেয়া হয়। সহকারী পুলিশ কমিশনার ছানোয়ার হোসেনের নেতৃত্বে অভিযান শুরু হয়।
গোপন সংবাদের ভিত্তিতে ডিবি ও র্যাব গত মঙ্গলবার রাতে সিঙ্গাইর উপজেলার আজিমপুর গ্রাম ঘেরাও করে। রাত ১২টা পর্যন্ত গ্রামের অধিকাংশ ঘরে তল্লাশি চালিয়েও নাহিদকে পাওয়া যায়নি। পরে ডিবি ও র্যাব জানতে পারে উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক রমিজউদ্দিন এবং তার ভাই সিঙ্গাইর সরকারি কলেজের ভিপি ও ছাত্রলীগ নেতা সমিজের বাসায় নাহিদ লুকিয়ে আছে। রমিজ ও সমিজকে পুলিশ আটক করে সিঙ্গাইর থানায় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলে তারা স্বীকার করে, নাহিদ তাদের ঘরে লুকিয়ে ছিল। পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে নাহিদকে আরেক ছাত্রলীগ নেতা মোহসীনের বাসায় পাঠিয়ে দেয়া হয়। দুইভাইকে সঙ্গে নিয়ে মোহসীনের বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে রাত ১টায় পুলিশ নাহিদকে গ্রেফতার করে। নাহিদকে ঢাকায় ডিবি অফিসে এনে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। বিশ্বজিত্ হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার কথা জানান তিনি ডিবিকে। ৯ ডিসেম্বর ওই হত্যাকাণ্ডে জড়িত অন্যদের নাম ঠিকানা বলে দেন তিনি। তাদের কেউ কেউ নাহিদের সঙ্গে সিঙ্গাইরে আশ্রয় নিতে চাইলে নাহিদ তাদের সঙ্গে করে আনেননি। নাহিদের গ্রামের বাড়ি ভোলার দৌলতখান উপজেলার দক্ষিণ জয়নগর গ্রামে। তার বাবার নাম আব্দুর রহমান।
আমাদের সিঙ্গাইর প্রতিনিধি জানান, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় দলীয় সূত্রে নাহিদের সঙ্গে রমিজের পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা। আর এ কারণেই রমিজের গ্রামের বাড়িতে আশ্রয় নেন তিনি।
হাতিয়া সংবাদদাতা জানান, বিশ্বজিত্ হত্যাকাণ্ডে জড়িত ওবাইদুল কাদের তাওসীনের বাবা মাওলানা মহিউদ্দীন ইত্তেফাককে নিজের ছেলের আসল পরিচয় না দিয়ে বলেছেন, তার ছেলের নাম মাহফুজুর রহমান নাহিদ। মাওলানা মহিউদ্দিন আজহারুল হক সিনিয়র মাদ্রাসার অধ্যক্ষ ও স্থানীয় জামায়াত নেতা। তাওসীনের বড় ভাই তাফসীর উদ্দিন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সোহরাওয়ার্দী হল শাখা শিবিরের সভাপতি। ২০১০ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি ছাত্রলীগ নেতা ফারুক হত্যা মামলার ২ নম্বর আসামি। তিনি সেই থেকে পলাতক।
জানা যায়, উত্তেজিত কর্মীদের তাওসীনই বোমা নিক্ষেপকারী হিসাবে দেখিয়ে দেয়। তাওসীন হাতিয়া রহমানিয়া মাদ্রাসা থেকে আলীম পাস করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে মনোবিজ্ঞানে ভর্তি হয়। হাতিয়া থাকাকালে তাওসীন শিবিরের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। তাওসীনের ছোট বোন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরের মহিলা কর্মী বলে পুলিশ নিশ্চিত।
গতকাল ইমদাদুল হকের গ্রামের বাড়ি যশোরের শার্শা উপজেলার পাঁচকাঘরায় পুলিশ তল্লাশি চালায়। এএসআই রেজাউল হক মুন্সীকে ইমদাদুল হকের ছোট ভাই জাকির হোসেন জানান, গত মঙ্গলবার তার ভাই দুইবার বাড়িতে ফোন করেছে। জাকির জানায়, ইমদাদ বাড়িতে নিজেকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি পরিচয় দিতো। টিভি দেখে ইমদাদের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করলে তার ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। জাকির কৃষিকাজ করেন। তাদের বাবা আকরাম আলী বেঁচে নেই। মা জোহরা বেগমকে নিয়ে জাকির গ্রামের বাড়িতে থাকে। তার ভাই দ্রুত বড় লোক হওয়ার কারণে ছাত্রলীগ করে বলে জাকির পুলিশকে জানায়।
পটুয়াখালী প্রতিনিধি জানান, হত্যাকাণ্ডে জড়িত রফিকুল ইসলাম শাকিলের পটুয়াখালীর ফায়ার সার্ভিস রোডস্থ বাসায় তল্লাশী চালিয়েছে পুলিশ। গতকাল বেলা ১১টায় পটুয়াখালী সদর সার্কেল এএসপি আনছার উদ্দিনের নেতৃত্বে থানা পুলিশ এই তল্লাশী অভিযান চালানো হয়। এসময় বাসায় শাকিলের বড় ভাবী ও গৃহপরিচালিকা ছাড়া কোন পুরুষ সদস্য পাওয়া যায়নি। বিভিন্ন মিডিয়ায় শাকিলের পরিচয় প্রকাশিত হওয়ার পর তার বাবা ও ভাই গা ঢাকা দিয়েছে। তার পিতা আনসার আলী আয়কর বিভাগের একজন চতুর্থ শ্রেণীর (এমএলএসএস) অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী। শাকিল ৩ ভাই-বোনের মধ্যে সবার ছোট। তার বড় ভাই সফিকুল ইসলাম শাহিন ওরফে ট্যাক্স শাহিন পটুয়াখালী শহর যুবদলের যুগ্ম আহবায়ক ।
আনসার মিয়া আয়কর বিভাগের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী হলেও তার রয়েছে পটুয়াখালী শহরের ফায়ার সার্ভিস রোডে চারতলা বিশিষ্ট সুরম্য অট্টালিকা। তার গ্রামের বাড়ি বাকেরগঞ্জেও রয়েছে বিশাল সানসৈকত সম্পন্ন বাড়ি। সে চার বছর আগে আয়কর বিভাগের চাকুরী থেকে অবসর গ্রহণ করেন।
রংপুর থেকে ওয়াদুদ আলী এবং আমিনুল ইসলাম জুয়েল জানান, দরিদ্র পরিবারের ছেলে মীর মোঃ নূরে আলম লিমন ছাত্রলীগের রাজনীতির মাধ্যমে বড় নেতা ও ধন-সম্পদের মালিক হওয়ার স্বপ্নে বিভোর ছিলো। এ কারণে একের পর এক অপরাধ এবং অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছিলো। তার বাড়ি রংপুরের পীরগাছা উপজেলার কৈকুড়ি ইউনিয়নের শুল্লিপাড়া।
গতকাল বুধবার এলাকায় গিয়ে জানা যায়, শুল্লিপাড়া গ্রামের মীর মোঃ নুরুল ইসলামের পুত্র মীর মোঃ নূরে আলম লিমন গত ১২/১৩ বছর আগে মা নূরবানুর সঙ্গে এলাকা ছেড়ে ঢাকায় পাড়ি জমান। স্বামী-স্ত্রীর বনিবনা না হওয়ায় মা নূরবানু ঢাকায় গিয়ে আশ্রয় নেন আগারগাঁও এলাকায়। পরে লিমনের বাবা মীর মোঃ নুরুল ইসলাম ঢাকায় গিয়ে স্বামী-স্ত্রী মিলে গার্মেন্টসে কাজ শুরু করেন। রংপুরের পীরগাছা থেকে ঢাকা যাওয়ার আগে লিমন ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে পড়তো। পরে সে ঢাকায় গিয়ে আবার স্কুলে ভর্তি হয়। মাঝে-মধ্যে এলেও রংপুর মহানগরে নেতাকর্মীদের সঙ্গ দিতেন। গ্রামে তাদের কোন বাড়ি-ঘর নেই। মাত্র ৫ কাঠা পৈত্রিক ভিটা রয়েছে। অথচ রংপুর এলে সে একাধিক দামি মোবাইল ফোন ব্যবহারসহ রাজকীয় হালে চলাফেরা করতো। ২ বোন ও ১ ভাইয়ের মধ্যে লিমন সবার ছোট। স্ত্রীর সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় লিমনের পিতা মীর মোঃ নূরুল ইসলাম গত ৮ মাস আগে ঢাকা ছেড়ে আবার এলাকায় এসে হাট-বাজারে মসলা বিক্রি শুরু করেন।
এদিকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় আইন-শৃঙ্খলা কমিটি ও প্রক্টোরিয়াল বডির জরুরি সভায় বিশ্বজিত্ হত্যাকাণ্ডে জড়িত তিন ছাত্রকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার এবং দুইজনের সনদ বাতিল করা হয়। প্রাথমিকভাবে মাহফুজুর রহমান নাহিদ, ইমদাদুল হক, রফিকুল ইসলাম শাকিল, মীর মো. নূরে আলম ও মো. ওবাইদুল কাদের তাওসীনের বিরুদ্ধে বিশ্বজিত্ হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকায় প্রমাণ পায় প্রক্টোরিয়াল বডি। ২০০৮-২০০৯ শিক্ষাবর্ষে বাংলা বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর পাস করে মাহফুজুর রহমান নাহিদ ও একই শিক্ষাবর্ষে দর্শন বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর পাস করে ইমদাদুল হকের সনদ বাতিল করা হয়।
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্থায়ীভাবে ইসলামের ইতিহাসের চতুর্থ ব্যাচের ছাত্র রফিকুল ইসলাম শাকিল, রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম ব্যাচের ছাত্র নূরে আলম লিমন ও মনোবিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় ব্যাচের ছাত্র মো. ওবাইদুল কাদের তাওসীনকে বহিষ্কার করা হয়