দেশের বণিক ও শিল্প মালিকদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ (এফবিসিসিআই) নির্বাচনে জয়লাভ করেছে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের চেয়ারম্যান কাজী আকরাম উদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বাধীন প্যানেল।
পরিচালনা পর্ষদের ৩০টি পদের মধ্যে আকরাম উদ্দিন প্যানেল ২০টি ও আনিসুল হক সমর্থিত প্যানেল ১০টি পদ পেয়েছে।
অ্যাসোসিয়েশন গ্রুপের ১৫টি পদের মধ্যে আকরাম উদ্দিনের প্যানেল ৯টিতে ও আনিসুল হকের সমর্থিত গণতান্ত্রিক পরিষদ প্যানেল ৬টিতে জয়লাভ করেছে।
চেম্বার গ্রুপের ১৫টি পরিচালক পদের মধ্যে আকরাম উদ্দিনের প্যানেল ১১টিতে ও আনিসুল হকের সমর্থিত গণতান্ত্রিক পরিষদ প্যানেল ৪টিতে জয়ী হয়েছে।
রোববার ভোরে এফবিসিসিআই নির্বাচনের অ্যাসোসিয়েশন গ্রুপের ফলাফল প্রকাশ করা হয়। এর আগে শনিবার রাত সাড়ে ১০টায় চেম্বার গ্রুপের ফলাফল প্রকাশ করা হয়।
নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা করেন নির্বাচনী বোর্ডের চেয়ারম্যান সাবেক ডেপুটি স্পিকার সংসদ সদস্য আলী আশরাফ। এসময় উপস্থিত ছিলেন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি এ কে আজাদ, সাবেক সভাপতি সালমান এফ রহমান, প্রথম সহ সভাপতি মো. জসীমউদ্দিন, সহ সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু প্রমুখ।
নির্বাচিত ও মনোনীত পরিচালকরাই আগামী ২৬ নভেম্বর সভাপতি, প্রথম সহ-সভাপতি ও সহ-সভাপতি নির্বাচিত করবেন। ২৯ নভেম্বর নির্বাচিত পর্ষদের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করবে এ কে আজাদের নেতৃত্বাধীন বর্তমান কমিটি। নতুন কমিটি আগামী ২০১৪ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করবে।
চেম্বার গ্রুপের ফলাফল:-
নির্বাচিত হয়েছেন ময়মনসিংহ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির প্রতিনিধি আমিনুল হক শামীম (২৬২ ভোট) প্রথম অবস্থান, দ্বিতীয় জামালপুর চেম্বারের রেজাউল করিম রেজনু (২৪৯) , তৃতীয় হয়েছেন ভৈরব চেম্বারের বজলুর রহমান, চট্টগ্রাম উইমেন চেম্বারের মনোয়ারা হাকীম আলী (২৩৯), গাজীপুর চেম্বারের আনোয়ার সাদাত সরকার (২১৭), বগুড়া চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির মো. মমতাজ উদ্দিন (২১৩), পটুয়াখালী চেম্বারের গোলাম মোস্তফা তালুকদার (২১২), মুন্সীগঞ্জ চেম্বারের কহিনুর ইসলাম (২১০), নরসিংদী চেম্বারের প্রবীর কুমার সাহা ( ২০৯) , ফেনী চেম্বারের একেএম সাহিদ রেজা শিমুল ( ২০৮), চাঁপাইনবাবগঞ্জ চেম্বারের আবদুল ওয়াহেদ (২০৩), মাদারীপুর চেম্বারের জালাল উদ্দিন ইয়ামিন ( ১৯৭), মানিকগঞ্জ চেম্বারের তাবাররাকুল তোসাদ্দেক হোসেন টিটো
( ১৯৭), লালমনিরহাট চেম্বারের সিরাজুল হক ( ১৮৮), কুষ্টিয়া চেম্বারের বিজয় কুমার কেজরিওয়াল (১৮৫) ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন।
নির্বাচিতদের মধ্যে গণতান্ত্রিক প্যানেলের গাজীপুর চেম্বারের আনোয়ার সাদাত সরকার (২১৭), পটুয়াখালী চেম্বারের গোলাম মোস্তফা তালুকদার (২১২), মুন্সীগঞ্জ চেম্বারের কহিনুর ইসলাম (২১০) ও মানিকগঞ্জ চেম্বারের তাবাররাকুল তোসাদ্দেক হোসেন টিটো ( ১৯৭)। বাকি ১১ জন কাজী আকরাম প্যানেলের।
অ্যাসোসিয়েশন গ্রুপের ফলাফল:-
কাজী আকরাম উদ্দিন আহমদের নেতৃত্বাধীন প্যানেল থেকে অ্যাসোসিয়েশন গ্রুপের নির্বাচিত পরিচালকরা হলেন- ইলেকট্রিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের মীর নিজাম উদ্দিন আহম্মেদ (৮১৫), মেইজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের মো. হেলাল উদ্দিন (৭৫৯), প্লাস্টিক প্যাকেজিং ম্যানুফেকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের আবু মোতালেব (৭৪৯), ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প মালিক সমিতির আবদুর রাজ্জাক (৭৪৪), পেপার ইমপোটার্স অ্যাসোসিয়েশনের শফিকুল ইসলাম ভরসা (৭৩৮), কালি প্রস্তুতকারক সমিতির এমএ মোমেন (৭৩৭), গ্রে এন্ড ফিনিশড ফেব্রিক্স মিলস অ্যাসোসিয়েশনের হারুন-উর-রশিদ (৭১২), ফার্নিচার এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের কেএম আক্তারুজ্জামান (৭০৬) এবং প্লাস্টিক দ্রব্য প্রস্তুতকারক এবং রপ্তানিকারক অ্যাসোসিয়েশনের শাহেদুল ইসলাম (হেলাল) পেয়েছেন ৬৯৬ ভোট।
গণতান্ত্রিক প্যানেল থেকে অ্যাসোসিয়েশন গ্রুপের নির্বাচিত পরিচালকরা হলেন:-
বাংলাদেশ সুইং ম্যানুফেকচারার্স এন্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের আব্দুল হক (৮৫২), প্যানেলের প্যানেল লিডার ক্রাফটস অ্যান্ড গিফটওয়্যার এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের আবু আলম চৌধুরী (৮৩১), কম্পিউটার সমিতির সাফকাত হায়দার (৮১৪),জুয়েলারী ম্যানুফেকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের আনোয়ার হোসেন (৭৬৯), অ্যালুমিনিয়াম ম্যানুফেকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের ওবায়দুর রহমান (৭৪৪), ব্রেড, বিস্কুট ও কনফেকশনারী প্রস্তুতকারক সমিতির মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন (৭৪৪)।
আচণবিধি মানেনি কেউ: এফবিসিসিআই নির্বাচনের আচরণবিধি মানেননি কেউই।
প্রার্থী, প্রার্থীর সমর্থকরা এমনকি সাংবাদিকরাও নির্বাচন বোর্ডের অনুরোধ রাখেননি।
এ ব্যাপারে প্রচণ্ড ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন নির্বাচন বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. আলী আশরাফ এমপি।
তিনি বলেন, ‘‘আমাদের অনুরোধ সত্ত্বেও অনেক প্রার্থী ও প্রার্থীর সমর্থক আচরণবিধি মানছেন না। কয়েকজনকে মৌখিকভাবে সতর্ক করা হয়েছে। প্রয়োজনে প্রার্থিতা বাতিল করা হবে।’’
তিনি আরও বলেন, ‘‘আমি দুঃখ পেয়েছি যে, সাংবাদিকরাও আমাদের অনুরোধ রাখছেন না। সাংবাদিকরা ভোটকেন্দ্রের ভেতরেও সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন। সবচেয়ে সমস্যা করছেন টিভি সাংবাদিকরা। সাংবাদিকদের কাছে আরও দায়িত্বশীল আচরণ আশা করছি।’’
শুরু থেকেই নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের মতো ঘটনাও ঘটেছে এবার। অভিযোগ উঠেছে, সমর্থন আদায়ে ভোটারদের বাড়ি বাড়ি উপহার পাঠানোর পাশাপাশি বড় বড় রেস্তোরাঁয় আপ্যায়নের আয়োজন করা হয়।
সমর্থন আদায়ে নগদ অর্থের লেনদেন হয়েছে বলেও অভিযোগ করেছেন কেউ কেউ।কয়েকজন প্রার্থীকে এর আগে নির্বাচনী আচরণবিধি ভঙ্গের দায়ে জরিমানাও গুণতে হয়েছে
নির্বাচন প্রক্রিয়া: প্রতি দুই বছর পর এফবিসিসিআইর পরিচালনা পর্ষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সাধারণ ভোটারদের ভোটে নির্বাচিত হন পরিচালকরা। পর্যায়ক্রমে চেম্বার ও অ্যাসোসিয়েশন গ্রুপ থেকে সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। এর আগের নির্বাচনে পরিচালকদের ভোটে চেম্বার গ্রুপ থেকে এ. কে. আজাদ সভাপতি নির্বাচিত হন। এবারে অ্যাসোসিয়েশন গ্রুপ থেকে সভাপতি হবেন।
পরিচালনা পরিষদের মোট সদস্য ৪৮ জন। এদের মধ্যে সদস্য চেম্বার ও অ্যাসোসিয়েশনগুলোর মধ্যে নয়টি চেম্বার ও নয়টি অ্যাসোসিয়েশন রয়েছে যাদের মধ্য থেকে এফবিসিসিআইয়ের পরিচালনা পরিষদে একজন করে মোট ১৮ জন পরিচালক মনোনীত হন, যাদের সাধারণ সদস্যদের সমর্থন বা ভোটের দরকার হয় না।
এ ছাড়া বাকি ৩০ জন পরিচালককে সাধারণ সদস্যদের ভোটে নির্বাচিত হতে হয়। এই ৩০ জনের মধ্যে ১৫ জন চেম্বার গ্রুপ থেকে এবং ১৫ জন অ্যাসোসিয়েশন গ্রুপ থেকে নির্বাচিত করা হয়।
নির্বাচিত ও মনোনীত পরিচালকরা নিজেদের মধ্য থেকে ২৬ নভেম্বর সোমবার সভাপতি ও দু`জন সহসভাপতি নির্বাচিত করবেন।
নির্বাচনী বোর্ডের চেয়ারম্যান আলী আশরাফ এমপি শনিবার রাতে জানিয়েছেন, ভোট শতভাগ সুষ্ঠু হয়েছে। এটা নিরপেক্ষ ও সফল নির্বাচন।
নির্বাচনী বোর্ডজানিয়েছে, এফবিসিসিআইর ২০০১ ভোটারের মধ্যে ১৮২২ জন ভোট দিয়েছেন। অ্যাসোসিয়েশন গ্রুপের ১৬১১ ভোটারের মধ্যে ভোট দিয়েছেন ১৪৩৯ জন। চেম্বার গ্রুপের ৩৯০ ভোটারের মধ্যে ভোট দিয়েছেন ৩৮৩ জন।
এফবিসিসিআই চেম্বার গ্রুপে মনোনীত পরিচালকরা হলেন বাংলাদেশ চেম্বারের মহব্বত উল্লাহ, বরিশাল চেম্বারের শওকত হোসেন হিরন, চট্টগ্রাম চেম্বারের এম এ সালাম, ঢাকা চেম্বারের আসিফ ইব্রাহিম, খুলনা চেম্বারের কাজী আমিনুল হক, এমসিসিআইর গোলাম মাঈনুদ্দিন, রংপুর চেম্বারের মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু, সিলেট চেম্বারের সালাহ উদ্দিন আলী আহমেদ, রাজশাহী চেম্বারের মোহাম্মাদ আলী সরকার।
মতিঝিল থানায় জিডি:
অন্যদিকে শনিবার সন্ধ্যায় আমিরুদ্দীন বিপু মতিঝিল থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। আমিরুদ্দীন বিপু বাংলাদেশ কাগজ আমদানিকারক সমিতির প্রতিনিধি। তাঁর ভোটার নম্বর ৯৪৩। তিনি রাজধানীর নয়াবাজারের এইচ বি এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী।
তিনি জিডিতে উল্লেখ করেন, পরিচালক পদপ্রার্থী আবু নাসের ও এশিয়ান টেক্সটাইলের স্বত্বাধিকারী হারুন-অর-রশিদ এবং বাংলাদেশ মোবাইল ফোন ব্যবসায়ী সমিতির এলিফ্যান্ট রোডের ব্যবসায়ী নিজাম উদ্দিন জিতুর উসকানিতে তাঁদের সমর্থকেরা তাঁকে মারধর করেন। বিষয়টি নির্বাচন বোর্ডের চেয়ারম্যানের নজরে আনলে তিনি আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দেন। সে কারণেই তিনি জিডি করেছেন।
প্রত্যক্ষদশীরা জানান, শনিবার নির্বাচন চলাকালে দুপুরের দিকে আনিসুল হক সমর্থিত গণতান্ত্রিক প্যানেলের অ্যাসোসিয়েশন গ্রুপের সঙ্গে কাজী আকরাম উদ্দিন আহমেদ প্যানেলে অংশ নেয়া এগ্রো অ্যান্ড ফিনিশড ফেব্রিক্স মিলস এন্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন ও এশিয়ান গ্রুপের চেয়ারম্যান হারুন-অর-রশিদ সমর্থকদের সংঘর্ষ হয়। এছাড়া তেমন কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। পরে পুলিশ এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বেলা পৌনে একটার দিকে এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি আনিসুল হক নির্বাচনী ক্যাম্পের সামনে ভোটারদের সঙ্গে হাত মেলাচ্ছিলেন এবং তাঁদের কুশল জিজ্ঞাসা করছিলেন। এ সময় প্রতিপক্ষ প্যানেলের কয়েকজন সমর্থক তাঁকে উদ্দেশ করে নানা কটূক্তি করেন এবং স্লোগান দেন।
এ ব্যপারে শনিবার দুপুরে আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেন, আইন মেনেই আমি এসেছিলাম। নির্বাচন বোর্ড যে এলাকার মধ্যে সাধারণের প্রবেশ নিষেধ করেছে, আমি সেখানে যাইনি। তবে একজন সাবেক সভাপতি হিসেবে আমি অবশ্যই সেখানে যেতে পারি।তারপরও আমি এই বিষয় নিয়ে কোন সমস্যা করিনী। এরপর তিনি ডিসিসিআই ভবনে যান। তিনি যাবার পর এই সংঘর্ষ হয়।
প্রসঙ্গত, দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের এবারের নির্বাচনে দুটি মূল প্যানেলের মধ্যে একটির নেতৃত্বে রয়েছেন বেসরকারি স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের চেয়ারম্যান কাজী আকরাম উদ্দিন আহমেদ, যিনি বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) পক্ষ থেকে মনোনীত হয়ে ইতিমধ্যে সংগঠনটির পরিচালক হয়েছেন। তিনি সভাপতি প্রার্থী। অন্য প্যানেলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন ব্যবসায়ীদের সংগঠনের সাবেক সভাপতি আনিসুল হক।