এশিয়া সফরের অংশ হিসেবে আগামী সপ্তাহে মিয়ানমার সফরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা রোহিঙ্গা ইস্যুতে কথা বলবেন দেশটির প্রেসিডেন্ট থেইন সিয়েন এবং বিরোধী দলের নেত্রী অং সান সু চির সঙ্গে। এছাড়া বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন বিষয়ে কোন আলোচনা হবে কি-না সে বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া না গেলেও প্রেসিডেন্টের আলোচনায় রোহিঙ্গা সমস্যার একটি সামগ্রিক সমাধানকে গুরুত্ব দেয়া হবে বলে জানিয়েছেন স্টেট ডিপার্টমেন্টের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া বিষয়ক মিডিয়া মুখপাত্র ম্যারেন পাইন হোমস। বাংলাদেশের রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তনে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা চেয়ে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে কোন অনুরোধ আছে কি-না এবং থাকলে এ বিষয়ে প্রেসিডেন্টের আসন্ন সফরে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনার সম্ভাবনা আছে কি-না জানতে চাইলে মুখপাত্র ‘যুক্তরাষ্ট্র সব সময় রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে একটি সমন্বিত আঞ্চলিক উদ্যোগকে প্রাধান্য দেয়’ বলে মন্তব্য করে জানান প্রেসিডেন্টের আলোচনার বিষয়টি আমার এখতিয়ার বহির্ভূত, তবে এ বিষয়ে আপনার প্রশ্নটি হোয়াইট হাউসে প্রেসিডেন্টের সফর সংশ্লিষ্ট আমার সহকর্মীর কাছে পাঠানো হয়েছে। গতকালের কার্যদিবসের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত এ বিষয়ে আর কিছু জানা সম্ভব হয়নি।
এদিকে গত বুধবার অস্ট্রেলিয়ার পার্থে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন বলেছেন, প্রেসিডেন্ট ওবামার ঐতিহাসিক মিয়ানমার সফরে, দেশটির পশ্চিমাঞ্চলীয় রাখাইন রাজ্যে মুসলিম ও বৌদ্ধদের মধ্যে চলমান জীবনঘাতী সামপ্রদায়িক সংঘাতের বিষয়টি আলোচনার এজেন্ডায় রয়েছে। তিনি বলেন, আমরা সব সময় এ সংঘাতের নিন্দা জানিয়ে শান্তিপূর্ণ ও গঠনমূলক উপায়ে সমস্যার মূল কারণের একটি আইনসঙ্গত সমাধানের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেছি। ধারণা করা যাচ্ছে রোহিঙ্গাদের বার্মার নাগরিক স্বীকার করার পক্ষে প্রয়োজনীয় আইন সংস্কারের বিষয়টি প্রেসিডেন্টের আলোচনায় গুরুত্ব পাবে। ওবামার দ্বিতীয় মেয়াদে আন্তর্জাতিক কূটনীতির প্রথম পরীক্ষাটি হয়েছে চলতি সপ্তাহে জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদে যুক্তরাষ্ট্রের পুনর্নির্বাচনে। এ নির্বাচনে পশ্চিম ইউরোপ এ অন্যান্য গ্রুপের তিনটি আসনের জন্য জার্মানি, আয়ারল্যান্ড, গ্রিস ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় এবং নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র হেরে যেতে পারে বলেও নির্বাচনের আগের দিন বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ সব মিডিয়ায় সংবাদ পরিবেশিত হয়। কিন্তু পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারির ব্যক্তিগত নজরদারি, সম্ভাব্য পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দৌড়ে অনেকটা এগিয়ে থাকা এবং জাতিসংঘ কূটনীতিতে ওবামার পরম নির্ভরতার প্রতীক সুসান রাইসের দক্ষতায় শেষ পর্যন্ত অনেকটা ওবামা স্টাইলে যুক্তরাষ্ট্র এ গ্রুপে সর্বোচ্চ ১৩১ ভোটে প্রথম স্থান পেয়ে নির্বাচিত হয়। নির্বাচনোত্তর এক তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন এ তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নিবাচনে যুক্তরাষ্ট্রকে সমর্থনকারী সব সদস্যরাষ্ট্রকে ধন্যবাদ জানান এবং মানবাধিকার পরিষদের ভবিষ্যৎ কাজকর্মে ইসরাইলের প্রতি অতিমাত্রিক নেতিবাচক মনোযোগ থেকে সরে আসার আহ্বান জানান।
জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্রের বিজয়ের ফলে পররাষ্ট্রনীতিতে মূলত জয় দিয়েই ওবামা তার দ্বিতীয় মেয়াদ শুরু করলেন। আর এ রকমই আরেকটি জয়ের সম্ভাবনা মাথায় রেখে সর্বপ্রথম ক্ষমতাসীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে আগামী সপ্তাহে মিয়ানমার সফর করছেন ওবামা। ইতিপূর্বে বিশ শতকের প্রথম দশকে প্রেসিডেন্ট হার্ভার্ট হুভার ও প্রেসিডেন্ট ইউলায়সেস গ্রান্ট যখন মিয়ানমার সফর করেন তখন তারা ক্ষমতাসীন ছিলেন না। এছাড়া প্রেসিডেন্ট নিক্সনও ১৯৫৩ সালে প্রথমবার এবং ১৯৮৫ সালে শেষবারের মতো মিয়ানমার সফর করেন। সমগ্র এশিয়াজুড়ে এমনকি এশিয়া থেকে পশ্চিমের দেশগুলোতে মানুষ ও পণ্যের যাতায়াতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রুট হিসেবে প্রাচীনকাল থেকেই মিয়ানমারের সুখ্যাতি। তদুপরি ভারত মহাসাগরের কোলজুড়ে আঞ্চলিক পরাশক্তি ভারত ও উঠতি বিশ্বশক্তি চীনের মাঝখানে কৌশলগত ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে প্রেসিডেন্ট ওবামার পররাষ্ট্রনীতির মূল চালিকাশক্তি ‘এশিয়া পিভট’ এর অপরিহার্য অংশীদারে পরিণত হয়েছে মিয়ানমার। সমপ্রতি মিয়ানমার আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগে যথেষ্ট ব্যবসাবান্ধব নীতিমালা গ্রহণ করেছে। ফলে এতদিন অব্যবহৃত বাণিজ্য সম্ভাবনার সুযোগ পুরোপুরি কাজে লাগাতে পেপসি, কোকাকোলা, ভিসা কার্ড, মাস্টার কার্ড, জেনারেল ইলেকট্রিকের মতো মার্কিন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। দেশটিতে ওবামার জনপ্রিয়তা তার নিজদেশ আমেরিকার চেয়েও অনেক বেশি।
হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র জে কারনির মতে, ‘প্রেসিডেন্টের এশিয়া সফরে অনেক ইস্যুতে বিস্তারিত আলোচনা হবে। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, চাকরির সুযোগ সৃষ্টি, ব্যবসা-বাণিজ্য, জ্বালানি ও নিরাপত্তা সহযোগিতায় বর্ধিত অংশীদারিত্ব, মানবাধিকার, সমমূল্যবোধ এবং অন্যান্য আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক উদ্বেগের বিষয়ে সম-অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে তাৎপর্যপূর্ণ আলোচনা হবে।’
পূর্ব এশিয়া অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম পুরনো সামরিক মিত্র থাইল্যান্ড থেকে সফর শুরু করবেন ওবামা। যুক্তরাষ্ট্র-থাইল্যান্ড কূটনৈতিক সম্পর্কের ১৮০ বছর উদযাপন উপলক্ষে থাই প্রধানমন্ত্রী ইন্গ্লাক সিনাওয়াত্রার সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করবেন প্রেসিডেন্ট ওবামা এবং ট্রান্স-প্যাসিফিক স্ট্রেটেজিক ইকোনমিক পার্টনারশিপ এগ্রিমেন্টে স্বাক্ষর করার জন্য থাইল্যান্ডকে অনুরোধ জানাবেন বলে জানা গেছে। এ ছাড়া দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য, আঞ্চলিক নিরাপত্তা, সামরিক ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা বৃদ্ধির বিষয়েও আলোচনা হবে।
এরপর মিয়ানমার সফর করে শেষ ধাপে কম্বোডিয়া যাবেন ওবামা। কম্বোডিয়ার রাজধানী নমপেনে ওবামা মূলত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর আঞ্চলিক সংগঠন ‘আশিয়ান’-এর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ১৯তম বার্ষিক সম্মেলনে যোগ দেবেন। এই সুযোগে কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী হুন সেনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন।