প্রেসিডেন্ট নির্বাচন শেষ হতে না হতেই হারিকেন স্যান্ডির পর যুক্তরাষ্ট্রে আঘাত হেনেছে আরেকটি ঝড়। পেট্রাউস-পাওলা কেলেঙ্কারি নামের এই ঝড় ইতিমধ্যেই নাড়িয়ে দিয়েছে ওয়াশিংটনের ক্ষমতার দুর্গকে। প্রশ্নবিদ্ধ করেছে মার্কিন সামরিক বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের নৈতিক মানকে। যার প্রতিক্রিয়ায় ইতিমধ্যেই প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকে হারাতে হয়েছে তার ইরাক-আফগান পরিকল্পনা বাস্তবায়নের অন্যতম বিশ্বস্ত হাতকে। আরেক বিশ্বস্ত হস্ত জন অ্যালেনও এখন একই কেলেঙ্কারির জেরে কক্ষচ্যুত হওয়ার পথে বলে খবর বেরিয়েছে পত্রিকায়।
আর এত সব কাণ্ড, ঘটনা-অঘটনের পেছনে রয়েছে এক নারীর উপস্থিতি। জিল কেলি নামের এক নারীর এফবিআইয়ে করা নালিশ থেকেই পুরো ঘটনার সূত্রপাত বলে জানিয়েছে মার্কিন সংবাদমাধ্যম।
এফবিআইয়ের তদন্তেও তাকে উল্লেখ করা হয়েছে টাম্পার রহস্যময় নারী হিসেবে। মূলত এই কেলির করা হত্যা প্রচেষ্টার একটি অভিযোগের ভিত্তিতেই শুরু হয় এফবিআইয়ের তদন্ত। উন্মোচিত হয় যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর অভ্যন্তরের নৈতিক অধঃপতনের এক কালিমালিপ্ত অধ্যায়ের।
‘অজ্ঞাত কেউ তাকে ই মেইলে হত্যার হুমকি দিচ্ছে’, এফবিআইয়ের কাছে এমনই অভিযোগ করেন জিল কেলি। তদন্তের সূত্র ধরে বেরিয়ে আসে পাওলা ব্রডওয়েলের নাম। এরপরই কেচো খুড়তে গিয়ে গর্ত থেকে বেরিয়ে এলো একের পর এক সাপ। উদঘাটিত হলো পেট্রাউসের সঙ্গে পাওলা ব্রডওয়েলের গোপন সম্পর্কের বিষয়টিও।
এদিকে মার্কিন সংবাদমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী চমক এখনও শেষ হয়নি। তাদের ধারণা এই কেলেঙ্কারির পানি গড়াবে আরও বহুদূর অব্দি। এফবিআইয়ের তদন্তেও নাকি বেরিয়ে এসেছে আরও অনেক রথী মহারথীর নাম। আফগানিস্তানে মোতায়েন মার্কিন বাহিনীর বর্তমান প্রধান জন অ্যালেন যাদের মধ্যে অন্যতম ।
২০১০ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে কেলি ও জন অ্যালেনের মধ্যে অসংখ্য ইমেইল চালাচালি হয়েছে। এগুলোই এখন তদন্ত করছে এফবিআই। ইমেইলের বিষয় বস্তু এখনও প্রকাশিত না হলেও হৃদয়ঘটিত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি বলে ধারণা করা হচ্ছে।
প্রায় অখ্যাত ও অচেনা জিল কেলি এখন এই কেলেঙ্কারির সূত্র ধরে হয়ে প্রতিদিনই স্থান পাচ্ছেন মার্কিন সংবাদমাধ্যমের প্রথম পাতায়। সবার মধ্যেই প্রশ্ন ,কে এই জিল কেলি? কি এমন তার সম্মোহনী শক্তি যার প্রভাবে একের পর এক কক্ষচ্যুত হচ্ছেন মার্কিন সামরিক বাহিনীর নক্ষত্ররা।
জিল এবং স্কট কেলি দম্পতি ফ্লোরিডার টাম্পায় বসত গাড়েন প্রায় এক দশক আগে। ধনীদের আবাসস্থল হিসেবে পরিচিত এই অবকাশ নগরীর সবচেয়ে অভিজাত এলাকায় ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ স্বামীকে নিয়ে বসবাস শুরু করেন কেলি।
সমুদ্রাভিমুখী লাল ইটে মোড়া বিশাল এই ভিলার বারান্দা থেকে সরাসরি উপভোগ করা যায় গালফ অব মেক্সিকোর নয়নাভিরাম দৃশ্য।
নগরীর অভিজাত সমাজে কেলি দম্পতি খুব অল্প সময়ের মধ্যেই পরিচিতি পান তাদের দেওয়া বিলাসী সব পার্টির জন্য। সেখানে নিয়মিত পদধূলি দিতেন নগরীর রথী মহারথীরা, যাদের মধ্যে ছিলেন নিকটস্থ মার্কিন ঘাঁটির শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তারাও।
মদ ও মদিরায় ভেসে যেতো এসব পার্টি। পার্টির বুফে আয়োজনে উপচে পড়া দামী খাবারের পাশাপাশি বৃষ্টির জলধারার মত ঝড়তো শ্যাম্পেইন। সঙ্গে থাকতো সুবেশী সুন্দরীদের পদচারণা।
শহরের টক অব দি টাউন ছিলো এসব পার্টি। যার আকর্ষণে সেখানে আতিথ্য গ্রহণে খুব সহজেই প্রলুব্ধ হতেন নিকটস্থ ম্যাকডিল বিমান ঘাঁটির কর্তারা।
এসব পার্টির সুবাদে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই কেলি পরিবারের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে ওঠে ওই ঘাঁটিতে কর্মরত যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তাদের। যাদের মধ্যে অন্যতম ডেভিড পেট্রাউস ও জন অ্যালেন। পেট্রাউস সস্ত্রীক বহুবার জিল কেলির ভিলায় আতিথ্য গ্রহণ করেছেন। এছাড়া জন অ্যালেনের জন্যও তাদের মধুকুঞ্জের দ্বার অবারিত ছিলো বলে জানা গেছে।
জানা গেছে টাম্পার সামরিক ও বেসামরিক এলিট কমিউনিটির সামাজিক সম্পর্কই এখন অপ্রকাশিত ওয়াশিংটন স্কান্ডালের মূল আলোচ্য বিষয়।
কেলেঙ্কারির সূত্রপাত ঘটে ২০০৮ সালে। পেট্রাউস তখন সদ্য বদলি হয়ে এসেছেন টাম্পায়। আর তার ডেপুটি ছিলেন আফগান যুদ্ধের বর্তমান কমান্ডার জন অ্যালেন।
এই ফ্লোরিডাতেই যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ সেন্ট্রাল কমান্ডের হেড কোয়ার্টার অবস্থিত। এছাড়া ইরাক ও আফগান যুদ্ধের অনেক কলকাঠিই নাড়ানো হয় এখানে।
পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের লোভনীয় সামরিক কন্ট্রাক্ট এবং অস্ত্র ব্যবসারও অনেকখানিই নাকি নিয়ন্ত্রিত হয় এখান থেকেই। টাম্পার ভীড়ে ঠাসা আকর্ষণীয় স্ট্রিপ ক্লাব ও নাইটক্লাবগুলোতে নর্তকীদের উদ্দাম নৃত্য উপভোগের পাশাপাশি গোপন সলা পরামর্শ হয় সামরিক খাতের বিভিন্ন ব্যবসার। হাত বদল হয় মিলিয়ন মিলিয়ন অর্থের। মার্কিন সংবাদমাধ্যমগুলোর অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসছে এমনই মুখরোচক সব তথ্যের।
অনেকের মনেই প্রশ্ন কেলি কেন সরাসরি এফবিআইয়ের কাছে তার অভিযোগ জানাতে গেলেন। হত্যার হুমকি সংক্রান্ত অভিযোগগুলো যেখানে যুক্তরাষ্ট্রে বড়জোর পৌঁছায় স্থানীয় পুলিশ স্টেশন অব্দি।
তবে নিন্দুকরা বলছেন অন্যকথা। তাদের ধারণা পাওলার পাশাপাশি পেট্রাউসের সঙ্গে হৃদয় ঘটিত সম্পর্কে জড়িয়েছিলেন জিল কেলি। কিন্তু আরেক নারী পাওলা ব্রডওয়েল বাধা হয়ে দাঁড়ানোতেই শেষ পর্যন্ত সফল হতে পারেননি তিনি। তাই প্রতিশোধ নিতেই এফবিআইকে সূত্র দেন তিনি। যার পথ ধরে এফবিআইয়ের তদন্তে উন্মোচিত হয় আলোচিত ওই কেলেঙ্কারি।
এদিকে আবার জন অ্যালেনের সঙ্গে জিল কেলির ইমেইল চালাচালির ঘটনাতেও সৃষ্টি হয়েছে ধুম্রজালের। তবে এক্ষেত্রে নিন্দুকরা বলছেন পেট্রাউসকে পেতে ব্যর্থ হয়েই জিল হাত বাড়িয়েছিলেন জন অ্যালেনের দিকে। যার মূলে মূখ্য ছিলো প্রতিশোধটাই। তবে যেহেতু এখনও তদন্তের পুরো ফলাফল প্রকাশিত হয়নি তাই নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না কিছুই।
এদিকে এই দুর্বিপাকে পড়ে পেট্রাউসের পাশাপাশি জন অ্যালেনের ক্যারিয়ারও এখন হুমকির সম্মুখীন। ইউরোপে ন্যাটো কমান্ডার হিসেবে তার যোগদান এখন অনিশ্চিত। অথচ মাত্র কিছুদিন আগেই ওই দায়িত্বে তাকে নিয়োগের কথা ঘোষণা করেন প্রেসিডেন্ট ওবামা। শুধু বাকি ছিলো সিনেটের অনুমোদন।
তবে আফগানিস্তানের চলতি দায়িত্বে বহাল থাকছেন তিনি। কিন্তু তদন্তের ফলাফল সুখকর না হলে তাকেও যে পেট্রাউসের পথ অনুসরণ করতে হবে তা অনেকটাই নিশ্চিত।