ভারতীয় ইনস্টিটিউট ফর ডিফ্রে স্টাডিজ এন্ড অ্যানালাইসিস জার্নালে সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে বেগম খালেদা জিয়ার এক ই-মেইল সাক্ষাৎকার। ভাষান্তর করা ওই সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরা হলো-
বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি কি?
খালেদা জিয়া: বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহাসিক। সঠিক মানসিকতা ও রাজনৈতিক দৃঢ়তা দিয়ে আমাদের জনগণের সুবিধার্থে এ সম্পর্ককে আরও জোরদার করা খুবই সম্ভব।
ভারত : বাংলাদেশ সম্পর্কের উন্নয়নে এগিয়ে যাওয়ার পথে কি কি চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান বলে আপনার মনে হয়?
খালেদা জিয়া: আমাদের সম্পর্ক উন্নয়নের পথে প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক নিয়ে আমাদের জনগণের মধ্যে বিশ্বাস ও ভরসার অভাব।
ভারত : বাংলাদেশ সম্পর্ক আরও জোরদার করতে এই দুই দেশের কি করণীয় বলে আপনার মনে হয়?
খালেদা জিয়া: প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত যে পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা বজায় রেখে আমাদের মধ্যকার অমীমাংসিত বিষয়গুলোর যত দ্রুত সম্ভব এমনভাবে সমাধান করা যেন পরস্পরের স্বার্থরক্ষা সম্ভবপর হয়। যে বিষয়গুলো সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও অধিকার পাওয়া উচিত সেগুলো হলো আমাদের দুই দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত নদীগুলোর পানিবণ্টন, সীমান্ত এলাকায় নিরস্ত্র সাধারণ নাগরিকদের হত্যা বন্ধ এবং অমীমাংসিত সীমান্ত নির্ধারণ ও একে অপরের নিরাপত্তা বিষয়ক সমস্যাগুলো উপলব্ধি করা।
নিজ নিজ সীমান্ত ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে দুই দেশের কি কি পদক্ষেপ নেয়া উচিত?
খালেদা জিয়া: বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ৪০০০ কিলোমিটারেরও অধিক সীমান্ত এলাকা রয়েছে। ঔপনিবেশিক শাসকগণও ভুল নীতির ভিত্তিতে আমাদের সীমান্ত চিহ্নিত করেছে। আমাদের এ সমস্যা সমাধান করতে হবে। এই সীমান্ত এলাকাজুড়ে অনেক মানুষের আসা-যাওয়া হয়। এটা একটি ঐতিহাসিক সত্য। এই আন্তর্জাতিক সীমান্ত এলাকা ও সেখান দিয়ে লোকজনের আসা-যাওয়ার ব্যবস্থাপনার দিকনির্দেশনা করা সম্ভব এমন অনেক আন্তর্জাতিক আইন, কনভেনশন ও পদ্ধতি চালু রয়েছে। এখানে সেই আইন, কনভেনশন ও পদ্ধতিগুলো অনুসরণ করা উচিত। বিশেষ করে আমাদের দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্কের প্রকৃতি এক্ষেত্রে আমাদের বিবেচনায় রাখতে হবে।
ভারত : সন্ত্রাসবাদ বিষয়ে কি এই দুই দেশ পরস্পর সহযোগিতা করতে পারে?
খালেদা জিয়া: আমাদের দুই দেশের মধ্যে ব্যাপক পরিসরে সহযোগিতা গড়ে তোলার সুযোগ রয়েছে। এর মধ্যে বিপুলসংখ্যক পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় জড়িত। সর্বপ্রকার সন্ত্রাসবাদের মোকাবিলা করা এগুলোর অন্যতম। আমরা সবাই জানি, আমাদের এই অঞ্চলে সন্ত্রাসবাদের হুমকি বড় সমস্যার চেহারা নিয়েছে। এটা রোধ ও উৎপাটনে আমাদের একসঙ্গে কাজ করতে হবে। সার্ক রিজিওনাল কনভেনশন অন সাপ্রেশন অব টেরোরিজম ১৯৮৭ এবং এই কনভেশনের এডিশনাল প্রটোকল, ২০০৪ এ ধরনের একটি সহযোগিতার জন্য এক চমৎকার আইনি ও রাজনৈতিক অবকাঠামো বিদ্যমান। সেটার ওপর আমাদের মনোনিবেশ করতে হবে।
ভারত : দুই দেশের মধ্যে বিশ্বাসের অভাবের বিষয়টি মোকাবিলা করতে কি করণীয় বলে আপনার মনে হয়?
খালেদা জিয়া: আমি আগেও বলেছি পারস্পরিক স্বার্থরক্ষা করার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে টেকসই আলোচনা ও দুই দেশের জনগণের মধ্যে আরও উন্নত যোগাযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে আমাদের দ্বিপক্ষীয় অমীমাংসিত বিষয়গুলো সমাধানের জন্য এগিয়ে গেলেই আমাদের মধ্যকার বিশ্বাস ও আস্থার অভাব দূর করা সম্ভব।
ভারত : আঞ্চলিক সহযোগিতায় বাংলাদেশের ভূমিকাকে আপনি কিভাবে দেখছেন?
খালেদা জিয়া: প্রাতিষ্ঠানিক আঞ্চলিক অর্থনৈতিক সহযোগিতার বিষয়ে বাংলাদেশ অগ্রণী ভূমিকা রাখে যখন ১৯৭৯ সালে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এই ধারণাটি সূত্রপাত করেন। এর ধারাবাহিকতায়ই ১৯৮৫ সালে সার্কের উৎপত্তি ঘটে। একথা স্বীকার করি যে, সার্কের অগ্রগতি মানুষের প্রত্যাশা পুরোপুরি পূরণে সফল হয়নি। কারণ, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো অব্যাহতভাবে নানামাত্রার জাতিগত দরিদ্রতায় ধুঁকছে। এছাড়াও অন্যান্য সামাজিক চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করা বাকি রয়েছে। তবে কয়েকটি ক্ষেত্রে আমরা উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছি। সার্কের দ্রুত অগ্রগতির লক্ষ্যে আমাদের আরও রাজনৈতিক সদিচ্ছা দেখাতে হবে। এর আপাত দুর্বলতা সত্ত্বেও সার্ক এখন দক্ষিণ এশিয়ায় কার্যকরী আঞ্চলিক অর্থনৈতিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে একটি টেকসই হাতিয়ার হিসেবে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত।
ভারত : দুই দেশই পূর্বমুখী নীতি মেনে চলে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে বাংলাদেশ ও ভারত কি তাদের নিজ নিজ প্রাচ্যমুখী নীতি এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে বলে আপনার মনে হয়?
খালেদা জিয়া: কেবল দক্ষিণ এশিয়াতেই নয়, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও চীন, জাপান এবং কোরিয়াতেও আরও ঘনিষ্ঠ ঐক্যের লক্ষ্যে আমরা যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রতি জোরালো সমর্থন ব্যক্ত করেছি। এটা আমাদের পূর্বমুখী নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এটা আমাদের সবার মধ্যে বাণিজ্য ও পরিবহন সম্ভাবনাকে বাড়াতে সাহায্য করবে।
ভারত : এই দুই দেশ কি এমন প্রতিরক্ষা সহযোগিতা বিষয়ে চিন্তা করতে পারবে যেটা দুই দেশের অবৈধ পাচার, সন্ত্রাসবাদ ইত্যাদি সমস্যা মোকাবিলা করতে পারবে?
খালেদা জিয়া : আমাদের দুই দেশের মধ্যে অবৈধ পাচার ও সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলা করতে প্রতিরক্ষাসহ সব ধরনের সহযোগিতা সম্ভব।
ভারত : বাংলাদেশ ও এই অঞ্চলে তার ভূমিকার ভবিষ্যৎকে আপনি কিভাবে দেখেন?
খালেদা জিয়া: এই অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সমঝোতা বাড়ানোর জন্য ইতিবাচক ভূমিকা রাখার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ একটি শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশের সঙ্গে আমাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বপূর্ণ ও উষ্ণ সম্পর্ক রয়েছে। জাতি হিসেবে অন্য সব দেশের জনগণের জন্য এই সম্পর্ক বজায় রাখা ও আরও শক্তিশালী করার প্রতি আমরা প্রতিশ্রতিবদ্ধ।
ভারত : ভারতের জনগণের প্রতি আপনি কি বার্তা দেবেন?
খালেদা জিয়া: ভারতের জনগণের প্রতি আমার বার্তা হলো বন্ধুত্ব ও সমঝোতার। একেবারে নিকট প্রতিবেশী হওয়ায় আমরা একসঙ্গে বসবাস করতে নিয়তি দ্বারা আবদ্ধ। এবং এটা আমাদের করতে হবে শান্তিপূর্ণ ও সমনিতভাবে। আমাদের মধ্যে কোন বিরূপ ও বিদ্বেষপূর্ণ আচরণ থাকাটা সঙ্গতিপূর্ণ নয়। আমাদের নিজ নিজ সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য থেকে শিখতে হবে, দুই দেশের জনগণের মধ্যে যোগাযোগের মাত্রা বাড়াতে হবে, বিরাজমান সমস্যাগুলো সমাধানের লক্ষ্যে কাজ করতে হবে এবং দুই দেশের মানুষের মধ্যে বিশ্বাসের ঘাটতি পূরণ করে আস্থার পরিবেশের প্রসার ঘটাতে হবে। আমাদের পারস্পরিক স্বার্থ সুরক্ষা ও সমঝোতার লক্ষ্যে টেকসই ও উন্মুক্ত সংলাপ, আলোচনাই আমাদের সম্পর্কের কেন্দ্রীয় অংশ হওয়া উচিত। একই সঙ্গে একটি সার্বভৌম সত্তা হিসেবে একে অপরের স্বাধীনতার প্রতি সর্বক্ষেত্রে শ্রদ্ধা বজায় রাখাটা অব্যাহত রাখতে হবে।