দুর্নীতি দমন কমিশন বা দুদক একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। সাংবিধানিকভাবে যেসব প্রতিষ্ঠানের স্বাধীন সত্ত্বার স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে দুদক তাদের মধ্যে একটি। স্বাভাবিকভাবেই উপলব্ধি করা যায়, প্রতিষ্ঠানটি সরকার নয় রাষ্ট্রের কাছে দায়বদ্ধ।
চারদলীয় জোট সরকারের আমলে গঠিত হয় দুদক। ঠুঁটো জগন্নাথ করে তখন রাখা হয়েছিল এ প্রতিষ্ঠানটিকে। বিগত সেনা শাষিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দুদক পুনর্গঠিত হয়। অরাজনৈতিক ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দুদক পুনর্গঠিত করায় আশা করা হয়েছিল এ সংস্থাটি সত্যিকারভাবে স্বাধীন সত্তা হিসেবে ভূমিকা রাখবে। কিন্তু বর্ণচোরা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অভিলাষ পূরণ করতে গিয়ে দুদক কি ধরনের অবিমৃষ্যকারিতার পরিচয় দিয়েছে ওই সময় দায়েরকৃত মামলাগুলোই তার সাক্ষী।
ঐ সময় মূলত রাজনীতিক ও ব্যবসায়ীদের হয়রানির জন্য দুদকের নামে অসংখ্য মামলার অবতারণা ঘটে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং তার আড়ালের অদৃশ্য সরকারের হুকুম তামিল করতে গিয়েই যে এসব মামলা দায়ের করা হয়েছিল। মামলাগুলো দিয়ে হয়রানির উদ্দেশ্য শতভাগ পূরণ হলেও সেগুলো এখন দুদকের গলায় কাঁটা হয়ে বিঁধছে।
দেশের সর্বোচ্চ আদালতের বিবেচনায় নিম্ন আদালতের রায় একের পর এক প্রত্যাখ্যাত হওয়ায় দুদকের ভাবমূর্তির জন্য তা সংকট সৃষ্টি করেছে। সাংবিধানিক একটি প্রতিষ্ঠান যে আকাশ ছোঁয়া মর্যাদা ধারণ করে তত্ত্বাবধায়কী দূরাচারদের হিজ মাস্টার্স ভয়েসের ভূমিকা পালন করতে গিয়ে তা ইতোমধ্যে ধূলায় মিশে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে।
ক্ষমতাসীন মহাজোট সরকার, বিগত বর্ণচোরা তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং তার আগের জোট আমলে অসংখ্য মামলা দায়ের করা হয়। যার মধ্যে এমন কিছু মামলা রয়েছে যেগুলোর অভিযোগ কেবল অর্বাচীনদের কাছেই বিশ্বাসযোগ্য। এভাবে রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়িদের বিরুদ্ধে উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে দায়েরকৃত বিপুল মামলা উচ্চ আদালতে বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে।
জানা যায়, মামলা অনুমোদনে ত্রটি, অনুসন্ধান ও তদন্তে আইন অনুসরণ না করার জন্য মামলাগুলোতে দুদকের উত্থাপিত অভিযোগ দেশের সর্বোচ্চ আদালতের কাছে বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হচ্ছেনা। ইতোমধ্যে উচ্চ আদালতের অর্ধশতাধিক রায় দুদকের বিরুদ্ধে যাওয়ায় প্রমাণ হয়েছে যাদের নাজেহাল করা হয়েছে সেখানে আইনি প্রক্রিয়ার ত্রটি রয়েছে।
দুদকের একাধিক সূত্রে জানা যায়, ক্ষমতাসীন মহাজোট সরকারের শেষ এসে দুদক নিরপেক্ষ ভূমিকা দেখাতে চায়। প্রতিষ্ঠানটি রাজনৈতিক প্রভাবমুক্তভাবে কাজ করে জনসম্পৃক্ততা বাড়াতে চায় কমিশন। এ লক্ষ্যে দুদক কিছু কার্যক্রমও হাতে নিয়েছে। এরমধ্যে রয়েছে সরকার ও বিরোধী দলের নেতাকর্মী, প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী, সরকারী ঊর্ধতন কর্মকর্তাসহ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অনুসন্ধান কার্যক্রম শুরু ও অব্যাহত রাখা।
জানা যায়, নতুন বছরের শুরুতেই নতুন মিশনে নামতে যাচ্ছে দুদক। এ জন্য কমিশনকে ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। প্রকৃত দুর্নীতিবাজদের খুঁজে বের করতে দুদকের অনুসন্ধান ও তদন্ত টিম শক্তিশালী করা হচ্ছে।
এ ব্যাপারে দুদক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান বলেন, নতুন বছরে আরও স্বচ্ছতার ছাপ রাখতে চাইবে দুদক। অনুসন্ধান ও তদন্ত টিমকে শক্তিশালী করা হবে। প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি রোধে তৎপর থাকবে দুদক। দুর্নীতি রোধে তৃণমূল পর্যায়েও দুদক কাজ করবে বলে তিনি জানান।
দুদক চেয়ারম্যান বলেন, দুদককে এমনভাবে সাজানো হচ্ছে যাতে দুর্নীতি প্রতিরোধ কাজে জনসম্পৃক্ততা বৃদ্ধি পায় এবং দুর্নীতি প্রতিরোধ অভিযান একটি গণআন্দোলনে রূপ নেয়। দুর্নীতির ব্যাপকতা কমাতে বেসরকারি খাতের দুর্নীতিকেও আইনের আওতায় আনা হচ্ছে।
জানা গেছে, অনুসন্ধান ও তদন্ত কমিটিকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আরও দক্ষ করা হবে। সাংগঠনিক কাঠামো শক্তিশালী করার পাশাপাশি আধুনিকায়ন ও যুগোপযোগী করা হবে প্রতিষ্ঠানটিকে। দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধান ও তদন্তে অপারেশনাল কাজ নির্বিঘ� করতে বিভিন্ন পরিকল্পনা ইতোমধ্যে হাতে নিয়েছে দুদক। তবে আগামী বছরের শুরুতে এসব বাস্তবায়ন করবে এ সংস্থাটি।
সূত্র জানায়, বর্তমানে মাত্র ২২ জেলায় দুদকের সমনি�ত কার্যালয় রয়েছে। দুর্নীতিবিরোধী কাজের বিস্তৃতি ঘটাতে দেশের সবক�টি জেলায় দুদকের অফিস স্থাপন করা হবে।
পদ্মা সেতু প্রকল্পের দুর্নীতির অনুসন্ধান, হলমার্ক কেলেঙ্কারি, ডেসটিনি ইস্যুতে দুদক যে প্রভাবমুক্তভাবে সুষ্ঠু অনুসন্ধান করেছে তার প্রমাণ দেবে দুদক। ইতিমধ্যে ডেসটিনি ও হলমার্ক কেলেঙ্কারির হোতাদের গ্রেফতার করেছে। বাকিদেরকে ধরতে গ্রেফতার অভিযান চলছে।
দুদক সূত্রটি আরো জানায়, নতুন বছরের শুরুতে মহাজোট সরকারের কয়েকজন সংসদ সদস্য এবং আলোচিত কয়েকজন ব্যবসায়ীর সম্পদের অনুসন্ধান শুরু করবে দুদক। রাজনীতিক, ব্যবসায়ী ও সরকারি কর্মকর্তাদের জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদের অভিযোগে নোটিশ পাঠানো হবে।
দুদক জানায়, মহাজোট সরকারের আমলে শেয়ার কেলেঙ্কারির হোতাদের বিরুদ্ধে জোরালো তদন্ত শুরু করে আইনুনাগ ব্যবস্থা নেবে। ইতোমধ্যে ৫ সদস্যের অনুসন্ধান টিম শীর্ষ ১২ অভিযুক্ত ব্যক্তির মধ্যে কয়েকজনের বক্তব্য নিয়েছে। বাকি কয়েকজনের বক্তব্য নিতে আগামী বছর জানুয়ারির মাঝামাঝি সময় লাগতে পারে।
ফেব্রয়ারির মধ্যে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মামলার অনুমোদন চাওয়া হতে পারে। কমিশনের অনুমোদন মিললে আলাদা আলাদা মামলা দায়ের করবে বলে জানা গেছে।
এছাড়া এনবিআর, ভূমি অফিস, সিটি কর্পোরেশন, বিআইডব্লিউটিএ, এলজিইডির প্রভাবশালীকয়েক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে জোরালো তদন্ত চলবে।
দুদক কর্মকর্তারা জানান, এক সময় দুদকের অবস্থান ছিল মামলা দায়েরের পর চার্জশীট, পরে গ্রেফতার। কিন্তু সেই অবস্থান থেকে দুদক সরে এসেছে। এখন মামলা দায়েরের পর মামলার গুরুত্ব বিবেচনা করে আসামিদের গ্রেফতার করা হবে এবং সুষ্ঠু তদন্তের জন্য আসামিদের রিমান্ডে আনা হবে।
সূত্র জানায়, দুদককে আধুনিকায়ন ও যুগোপযোগী করতে নানামুখি পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। আসামিদের অবস্থান শনাক্ত করতে মোবাইল ট্রেকিং মেশিন ব্যবহার করবে দুদক। আসামি গ্রেফতারসহ বিভিন্ন অপারেশনাল কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের জন্য ক্রয় করা হবে প্রয়োজনীয় সংখ্যক ওয়াকিটকি। তদন্ত সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে গ্রেফতারকৃত ও রিমান্ডের আসামিদের নিজেদের তত্ত্বাবধানে রাখার জন্য দুদকের অধীনে গড়ে তোলা হবে আলাদা হাজতখানা। দুদকের প্রধান কার্যালয়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে স্থাপন করা হবে সিসি ক্যামেরা। নিজস্ব চৌকস বাহিনী ও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে অনুসন্ধান ও তদন্তকাজ পরিচালনার বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হবে।
স্বাধীন সত্ত্বার স্বীকৃতি পাওয়া এ প্রতিষ্ঠানটি ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারে বেসরকারি খাতের দুর্নীতিকেও আইনের আওতায় আনতে জনসম্পৃক্ততা বৃদ্ধির উপর গুরুত্ব দিচ্ছে।