সিরাজগঞ্জ ১৫০ মেগাওয়াট পিকিং পাওয়ার প্ল�্যান্ট বাণিজ্যিক উৎপাদনে যাচ্ছে

দেশের বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো উৎপাদনে আসতে শুরু করেছে। বিগত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে চুক্তি করা ২০টিসহ বর্তমান মহাজোট সরকারের আমলে ৫১টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র উৎপাদন শুরু করেছে।
এর আগে দ্রুত বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর জন্য সরকার ঝুঁকি নিয়ে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের মাধ্যমে ১৪টি বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্প নিয়ে বিপাকে পড়েছিল। এর মধ্যে চারটি বিদ্যুৎকেন্দ্র কবে চালু হবে তা পুরোপুরি অনিশ্চিত। বাকি আটটি কেন্দ্র চালু হয়েছে। তবে ক্ষমতার অর্ধেক বিদ্যুৎও উৎপাদন হচ্ছে না। পিডিবি বলছে, এ কেন্দ্রগুলো থেকে সরকার চুক্তি অনুযায়ী বিদ্যুৎ পেলে বর্তমানে তেমন লোডশেডিং থাকত না। বিদ্যুৎ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকার দক্ষ উদ্যোক্তা বেছে নিতে ভুল করার কারণে এ সমস্যার মধ্যে পড়েছে।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, নতুন বেশ ক�টি কেন্দ্রে জেনারেটরের সমস্যাসহ যান্ত্রিক ত্র�টি লেগেই আছে। পুরনো জেনারেটরের পাশাপাশি ত্র�টিপূর্ণ এবং নিম্নমানের সরঞ্জাম ব্যবহার করায় ক্ষমতা অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে না। সময়মতো উৎপাদনে আসতে ব্যর্থতা এবং পুরোমাত্রায় বিদ্যুৎ উৎপাদন না হওয়ায় সরকারের বিদ্যুৎ পরিকল্পনা বাস্তবায়নও হোঁচট খাচ্ছে। বেসরকারি খাতের এ ১৪টি ভাড়াভিত্তিক (রেন্টাল) এবং কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র সঠিক মাত্রায় উৎপাদনে থাকলে জনগণ আরও ৬০০ থেকে ৬৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ বাড়তি পেত। এর ফলে দেশে বিদ্যুৎ ঘাটতি অনেক কমে যেত। লোডশেডিং তেমন থাকত না বলে মনে করছে পিডিবি।
তবে এত কিছুর পরও সরকার এরই মধ্যে জাতীয় গ্রিডে নতুন ২ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ যোগ করেছে। বর্তমান সরকারের মেয়াদে আরও ৩ থেকে ৪ হাজার মেগাওয়াট যোগ হতে পারে বলে আশা করছে বিদ্যুৎ বিভাগ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দক্ষ উদ্যোক্তা নির্বাচন ও সরকারের সঠিক পর্যবেক্ষণ না থাকলে পাইপলাইনে থাকা এসব প্রকল্পও যথাসময়ে চালু করা যাবে না। ফলে নজরদারি বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছেন তারা।
বেসরকারি উদ্যোক্তাদের ব্যর্থতার কারণে এরই মধ্যে ছয়টি বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্প বাতিল হয়েছে। এগুলোতে সরকারের অনর্থক সময় ব্যয় হয়েছে। দক্ষ কোম্পানি নির্বাচন করতে পারলে এ সমস্যা হতো না বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। সময়মতো উৎপাদনে আসতে না পারায় পিডিবি বেশ ক�টি কোম্পানিকে জরিমানা করেছে। কোনো কোনোটির কাছ থেকে জরিমানার অর্থ আদায় করা হয়েছে। কেউ কেউ জরিমানা দেয়নি। তারা আদালত থেকে স্থগিতাদেশ নিয়েছে।
২০১৩ সালের মধ্যে দেশকে লোডশেডিংমুক্ত করার ঘোষণা রয়েছে সরকারের। সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের জন্য নেওয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ। দ্রুত বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে ঝুঁকি নেয় সরকার।
দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত বিদ্যুৎ সমস্যা দ্রুত দূর করতেই বর্তমান সরকারের এ ঝুঁকি নেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। তাদের মতে, প্রথম থেকে নানামুখী পরিকল্পনা গ্রহণ করা হলেও সমন�য়ের অভাব ছিল। এ কারণে বহুমুখী পরিকল্পনা গ্রহণ করা হলেও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কাক্সিক্ষত সাফল্য আসছে না।
এত কিছুর পরেও সিরাজগঞ্জ ১৫০ মেগাওয়াট পিকিং পাওয়ার প্ল�্যান্ট বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনের জন্য প্রস্তুত হওয়ায় বিশেষজ্ঞরা আশার আলো দেখছেন। এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি বর্তমান সরকারের আমলে স্থাপিত অন্যতম বড় বিদ্যুতকেন্দ্র। একমাসেরও অধিক সময় ধরে পরীক্ষামূলক উৎপাদন চালিয়ে আগামী ২০ নভেম্বর থেকে কেন্দ্রটিতে উৎপাদন শুরু হবে।
এ কেন্দ্রটির মালিকানা প্রতিষ্ঠান নর্থ ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এএম খোরশেদুল আলম জানান, গত ১৮ অক্টোবর থেকে আমরা এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রে পরীক্ষামূলক উৎপাদন শুরু করেছি। আগামী ২০ নভেম্বর থেকে এর বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হবে।
গ্যাস ও ডিজেলভিত্তিক (ডুয়েল ফুয়েল) এই কেন্দ্রটিকে কম্বাইন্ড সাইকেলে পরিণত করার কাজ চলছে। কাজ শেষ হলে আগামী বছরের অক্টোবরে এই কেন্দ্রের উৎপাদন ক্ষমতা বেড়ে দাঁড়াবে ২২৫ মেগাওয়াটে।
বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব আবুল কালাম আজাদ সাংবাদিকদের জানান, গ্যাসের স্বল্পতা দেখা দিলে এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে ডিজেল ইঞ্জিনে যাবে। গ্যাস সংকটের বিষয়টি মাথায় রেখেই এ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
কম্বাইন্ড সাইকেল পদ্ধতিতে পাওয়ার প্ল্যান্টের নিঃসরিত জ্বালানি দিয়ে হিট রিকভারি স্টিম জেনারেটরের মাধ্যমে তৈরি বা দিয়ে স্টিম টারবাইন চালানো হবে। আর তাতেই বাড়তি ৭৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হবে।
সিম্পল সাইকেল থেকে কম্বাইন্ড সাইকেলে পরিণত করতে বাড়তি ব্যয় হবে প্রায় ৬০০ কোটি টাকা। সিম্পল সাইকেল পাওয়ার প্ল্যান্ট স্থাপনে ব্যয় হয়েছিল ৭৯৯ কোটি টাকা। সে হিসেবে মোট খরচ হবে প্রায় ১৪শ কোটি টাকা।
নর্থ ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানির প্রকল্প পরিচালক এটিএম জাহাঙ্গীর কবির জানান, সাধারণত এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্রের লাইফ টাইম ১৫ থেকে ২০ বছর ধরা হলেও দেশে সার্ভিসিংয়ের মাধ্যমে ৩০ বছর পর্যন্ত চালানো হয়।
নর্থ-ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি ও চায়না ন্যাশনাল মেশিনারি ইমপোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট করপোরেশন (সিএমসি) প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। কেন্দ্রটি নর্থ-ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানির ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হবে। এখান থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ কিনবে পিডিবি।
জানা যায়, গ্যাস দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হলে প্রতি ইউনিটের উৎপাদন খরচ পড়বে ১.৯০ টাকা। এর মধ্যে জ্বালানি খরচ ৯৯ পয়সা এবং নির্মাণ ও পরিচালনার ব্যয় ৯০ পয়সা ধরা হয়েছে।
খোরশেদুল আলম জানান, প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ ২.৫০ টাকা দরে বিক্রির জন্য পিডিবির কাছে প্রস্তাব দেয়া হয়েছে।
সূত্র জানায়, সরকারি মালিকানায় এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি স্থাপনের জন্য ২০১০ সালের ১২ অক্টোবর চুক্তি সাক্ষর হয়। এরপর কেন্দ্রটির ভিত্তিপ্রস্থর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রকল্পটির জন্য মোট ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ১৪০০ কোটি টাকা। ব্যয়ের ৫২ দশমিক ৩৮ শতাংশ যোগান দেবে বাংলাদেশ সরকার। আর বাকী তহবিল সরবরাহ করেছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিউবো) তথ্য অনুযায়ী, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৫৯টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের জন্য চুৃক্তি সাক্ষর করেছে, যাদের উৎপাদন ক্ষমতা ৭,৬৪৯ মেগাওয়াট। এরমধ্যে রেন্টাল ৩টি, কুইক রেন্টাল ১৭টি, আইপিপি ১৯টি এবং সরকারি মালিকানাধীন ২০টি কেন্দ্র রয়েছে।
চারদলীয় জোট সরকারের আমলে চুক্তি করা ২০টিসহ বর্তমান সরকারের আমলে উৎপাদন শুরু করেছে ৫১টি কেন্দ্র, যাদের মোট উৎপাদন ক্ষমতা ৩৫৯৫ মেগাওয়াট। বতর্মান সরকারের আমলে চালু হওয়া ৫১ টি কেন্দ্রের মধ্যে তিনটি কেন্দ্র ১৫০ মেগাওয়াট বা তার বেশি উৎপাদন ক্ষমতার। এগুলো হলো শিকলবাহা ১৫০ মেগাওয়াট পিকিং পাওয়ার প্ল্যান্ট, সিলেট গ্যাসভিত্তিক ১৫০ মেগাওয়াট কম্বাইন্ড সাইকেল এবং চাঁদপুর গ্যাসভিত্তিক ১৫০ মেগাওয়াট কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎ কেন্দ্র।
বিউবোর তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে বিদ্যুতের চাহিদা ৬,৬০০ মেগাওয়াট (ডিমান্ড-সাপ্লাই ম্যানেজমেন্টসহ)। এর বিপরীতে গড় উৎপাদন ৫,৭০০ থেকে ৬,০০০ হাজার মেগাওয়াট। বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা আরো বেশি থাকলেও জ্বালানি স্বল্পতার কারণে উৎপাদন কম হচ্ছে।
বিদ্যুৎ সচিব বলেন, বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো উৎপাদনে আসতে শুরু করেছে। আমরা আশা করছি আগামী ছয় মাসের মধ্যে আরো ৬০০ থেকে ৮০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়বে।

অর্থ বাণিজ্য