মার্কিন নির্বাচন : আলোর বাইরে থাকা প্রার্থীরা

মার্কিন নির্বাচন : আলোর বাইরে থাকা প্রার্থীরা

যুক্তরাষ্ট্রের এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রধান দুই দলের বাইরেও আরো কয়েকজন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। তাদের সম্পর্কে মূলধারার সংবাদ মাধ্যমগুলোতে আলোচনা নেই বললেই চলে।

যদি প্রশ্ন করা হয় তাদের কয়জনের নাম জানেন আপনি?

পারলেন না, মাথাটা একটু চুলকে নিলেন তো! অথবা অনেকেই ভাবছেন, ‘দুর! ওবামা-রমনির বাইরে আবার কেউ এবারের নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন নাকি, কই কারও নাম তো কোনো পত্রিকায় দেখতে পেলাম না?’

আসলে খুব কম ব্যক্তিই আছেন যারা যুক্তরাষ্ট্রের এবারের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী তৃতীয় একজন প্রার্থীর নাম বলতে পারবেন প্রথমবারেই। তবে এজন্য পাঠকদের দোষ দেওয়া যায় না। কারণ সত্যিই রমনি ও ওবামার বাইরে অন্য প্রার্থীদের ব্যাপারে সংবাদমাধ্যমে আলোচনা হয়েছে খুব কমই।

আসলে বিশ্বের মূলধারার সংবাদমাধ্যমসহ আনাচে কানাচের অখ্যাত পত্রিকাগুলোতেও এবারের নির্বাচন নিয়ে যা আলোচনা হয়েছে তার সবটুকুই কিন্তু ওবামা ও রমনিকে ঘিরেই।

অন্যান্য প্রার্থীদের নিয়ে দু`কলম লেখারও গরজ বোধ করেনি কেউ। যুক্তরাষ্ট্রে দুই দলের আধিপত্য দেখতে দেখতে ক্লান্ত হওয়া পাঠকদের জন্য অন্য কোনো রাজনৈতিক দল বা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের খবর পাওয়াই আশ্চর্র্যের ব্যাপার।

এ যেনো অনেকটাই প্রদীপের নিচে অন্ধকার। চারদিকে নির্বাচন নিয়ে এত উন্মাদনা, নির্বাচনী প্রচারণা, রঙিন ঝলমলে সব খবরে ঝক ঝক করছে পত্রিকার প্রথম পাতাগুলো। অথচ সেখানে নির্বাচনে অংশ নেওয়া এই তৃতীয় ধারার প্রার্থীদের নিয়ে নেই কোনো আলোচনা।

সব দিক দিয়েই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রধান দুই দলের বাইরে প্রার্থী হওয়াটা একটু দুঃসাহস কিংবা পাগলামিই বটে।

সংবাদমাধ্যম ও ভোটারদের মাঝে অবহেলিত এই প্রার্থীরা এমনকি ব্যালট পেপারে নিজের নাম ওঠাতেও বেগ পান। প্রার্থী হিসেবে বক্তব্য উপস্থাপনের জন্য প্রেসিডেন্সিয়াল ডিবেটেও ডাকা হয় না তাদের। কারণ জনমত জরিপ অনুযায়ী অন্তত ১৫ শতাংশ সমর্থন না পেলে কাউকে বিতর্কে ডাকারই যোগ্য বলে মনে করে না বিতর্কের আয়োজক প্রতিষ্ঠান।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এই অনালোচিত অবহেলিত-অনাদৃত প্রার্থীদের বিবেচনা করা হয় ‘থার্ড পার্টি ক্যান্ডিডেট’ হিসেবে।

এবারের নির্বাচনে অংশ নেওয়া এই ঘরানার প্রার্থীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন জাস্টিস পার্টির রকি অ্যান্ডারসন, কনস্টিটিউশনাল পার্টির ভারজিল গুডি, লিবারটারিয়ান পার্টির গ্যারি জনসন এবং গ্রিন পার্টির জিল স্টাইন।

এই লেখাটি আসলে এই চার থার্ড পার্টি ক্যান্ডিডেটকে পাঠকদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার একটি প্রয়াস:

রকি অ্যান্ডারসন, (জাস্টিস পার্টি)
সল্ট লেক সিটির এই সাবেক মেয়র নবগঠিত রাজনৈতিক দল জাস্টিস পার্টির মনোনয়ন নিয়ে এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।

সাবেক ডেমোক্র্যাট অ্যান্ডারসন গত বছরের ডিসেম্বরে একটি আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, তার সাবেক দল প্রমাণ করেছে তারা রিপাবলিকান দলের একই মুদ্রার ওপিঠ মাত্র। উভয় দলই একই ধরণের দুর্নীতি ও জরাগ্রস্ততায় আক্রান্ত বলে দাবি করেন তিনি। এবারের নির্বাচনে অ্যান্ডারসন অবশ্য আছেন ১৫টি রাজ্যের ব্যালট পেপারে।

যুক্তরাষ্ট্রের কোনো গুরুত্বপূর্ণ শহরের মেয়র হিসেবে অ্যান্ডারসনই প্রথম ইরাকে অন্যায় যুদ্ধে জড়ানোর অভিযোগ তুলে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশকে ইমপিচ করার আওয়াজ তুলেছিলেন।

এছাড়া মেয়র হওয়ার পর সল্টলেক নগরের গ্রিন হাউজ গ্যাস নিঃসরণ মাত্র তিন বছরের মধ্যে ৩১ শতাংশ কমাতে সমর্থ হয়েছেন বলেও তার ওয়েবসাইটে দাবি করা হয়েছে।

প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি আর্থিক লেনদেনের বিবরণের ওপর ভিত্তি করে কর আদায় এবং দেশের অভিবাসন পদ্ধতির সংস্কার করতে চান।

তার রানিংমেট লুইস রদ্রিগেস একজন মানবাধিকারকর্মী ও প্রসিদ্ধ লেখক। এপর্যন্ত তার ১৫টি বই প্রকাশিত হয়েছে এদের মধ্যে বেশ কয়েকটি বেস্টসেলিং। এসবের মধ্যে অন্যতম অলওয়েজ রানিং লা ভিদা লোকা, গ্যাং ডেইজ ইন এলএ ইত্যাদি।

ভার্জিল গুডি (কনস্টিউশন পার্টি)
ভার্জিল গুডি নিজের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন একজন রক্ষণশীল ডেমোক্রেটিক কংগ্রেসম্যান হিসেবে। তার নির্বাচনী এলাকা ছিলো মধ্য ও দক্ষিণ ভার্জিনিয়া।

২০০০ সালে ডেমোক্রেটিক পার্টির সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করে মার্কিন কংগ্রেসে চতুর্থ মেয়াদে রিপাবলিকান দলীয় সদস্য  হিসেবে প্রতিনিধিত্ব করেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে অবশ্য গুডি তার আসনটি হারান। নির্বাচনে হারার পর রিপাবলিকান দল ত্যাগ করে ২০১০ সালে কন্সটিটিউশনাল পার্টিতে যোগ দেন তিনি। এবারের নির্বাচনে মোট ২৬ টি রাজ্যের ব্যালট পেপারে থাকবে গুডির নাম।

অবৈধ অভিবাসনের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেওয়া গুডি সীমান্তে বেড়া ও প্রয়োজনে সেনা ব্যবহার করে মেক্সিকো থেকে অবৈধ অভিবাসী আসা বন্ধের দাবি জানিয়েছেন।

এছাড়া তিনি ইংরেজিকেই একমাত্র সরকারি ভাষা করার সমর্থক। এছাড়া ওবামার স্বাস্থ্যসেবা কর্মসূচি এবং আফগানিস্তান থেকে সেনা ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধেও অবস্থান নেন গুডি।

তবে রিপাবলিকান পার্টির তরফে অবশ্য ‘সুইং স্টেট’ হিসেবে বিবেচিত ভার্জিনিয়ার ব্যালট পেপার থেকে গুডির নাম সরিয়ে ফেলার আবেদন করা হয়েছিলো। তবে রাজ্যের প্রধান অ্যাটর্নি গুডির নাম ব্যালট পেপারে থাকবে বলে গত সেপ্টেম্বরে রায় দেন। রিপাবলিকান পার্টির ভয়, যত কম ভোটই পান না কেনো গুডি আসলে ভাগ বসাবেন রমনির ভোটে।

গুডির রানিংমেট জেমস ক্লেমার। পেনসিলভ্যানিয়ায় আইনজীবী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ক্লেমার অবশ্য এর আগেও আইন পরিষদের নির্বাচনে কয়েক দফা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন, তবে প্রত্যেকবারই তার প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।

২০০৮ সালের নির্বাচনে অবশ্য কনস্টিটিউশনাল পার্টি পেয়েছিলো ১ লাখ ৯৯ হাজার ৪২৭ টি ভোট বা মোট ভোটের দশমিক ১৫ শতাংশ।

গ্যারি জনসন, লিবারটিয়ান পার্টি
মঙ্গলবারের নির্বাচনে অংশ নেওয়া ‘থার্ড পার্টি’ প্রার্থীদের মধ্যে গ্যারি জনসনই একমাত্র প্রার্থী যিনি এর আগেও সাংবিধানিকভাবে কোনো রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে নির্বাচিত হয়েছিলেন।

১৯৯৫ থেকে ২০০৩ পর্যন্ত নিউ মেক্সিকোর গভর্নর হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করেন। উদার রক্ষণশীল হিসেবে পরিচিত গ্যারি জনসন নিজের মেয়াদকালে নিউ মেক্সিকোতে আনা অর্ধেক বিলে নিজের ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগ করেন।  সারা যুক্তরাষ্ট্রের সব গভর্নর মিলেও ওই মেয়াদে এত বেশি বিলে ভেটো দেননি।

ব্যালট পেপারে জনসন আছেন ৪৮ টি রাজ্যে। জনসন অবশ্য প্রথমে রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন লাভের দৌড়ে অংশ নিয়েছিলেন, কিন্তু দলীয় প্রাইমারিতে ছিটকে পড়ে অবশেষে লিবারটারিয়ান পার্টি থেকে থেকে মনোনয়ন নেন তিনি।

এর আগে বিভিন্ন সামাজিক ইস্যুতে প্রচলিত রিপাবলিকান দৃষ্টিভঙ্গির বিরোধিতা করে খ্যাতি পান তিনি। মারিজুয়ানা ও সমকামী বিয়ে বৈধ করার পক্ষে মত দেন তিনি। তাছাড়া সামরিক ব্যয় কমানোর পক্ষে অবস্থান নেওয়ার পাশাপাশি তথাকথিত প্যাট্রিয়ট আইনের বিরুদ্ধেও সরব তিনি।

গুয়ানতানামো দ্বীপের বন্দী এবং যুক্তরাষ্ট্রের হাতে বিচার বহির্ভূতভাবে আটক সব বন্দীর ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকারের পক্ষেও সোচ্চার ভূমিকা পালন করেন তিনি।

রাজনীতির পাশাপাশি জনসন একজন দক্ষ পবর্তরোহীও বটে। এমনকি এভারেস্ট পর্বতশৃঙ্গেও আরোহন করেছিলেন তিনি।

তার ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রার্থী সাবেক বিচারক জিম গ্রে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রচলিত ওষুধ আইন সংস্কারের পক্ষে প্রচারণা চালিয়ে আলোচনায় আসেন তিনি।  ক্যালিফোর্নিয়ার অরেঞ্জ কাউন্টির সুপিরিয়র জাজ হিসেবে দীর্ঘ ২০ বছর সফলতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ২০০৮ এর নির্বাচনে তাদের লিবারটিয়ান পার্টি দশমিক ৪০ শতাংশ ভোট লাভ করতে সক্ষম হয়।

জিল স্টাইন, গ্রিন পার্টি
একজন চিকিৎসক ও পরিবেশবাদী হিসেবে জিল স্টাইনই একমাত্র ‘থার্ড পার্টি’ প্রার্থী যার মিট রমনির বিরুদ্ধে নির্বাচন করার পূর্ব অভিজ্ঞতা আছে। ২০০২ সালে ম্যাসাচুসেটসের গভর্নর পদে রমনির বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন তিনি। তার নাম থাকবে ৩৮টি রাজ্যের ব্যালটে।

তার রাজনৈতিক দল গ্রিন পার্টি ক্ষুদ্র ব্যবসার মাধ্যমে চাকরির সুযোগ সৃষ্টি, এবং সমবায়ের মাধ্যমে স্থানীয় পর্যায়ে ‘সবুজ অর্থনীতি’ বাস্তবায়ন করে অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে আগ্রহী।

এছাড়া স্টাইন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করা কাগজপত্রহীন অভিবাসীদের ক্ষমা করে দেওয়ার পক্ষে। পররাষ্ট্রনীতিতে স্টেইন সামরিক ব্যয় কমিয়ে অর্ধেকে নামিয়ে আনা এবং ড্রোন হামলা বন্ধ করে আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার ও বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে যুক্তরাষ্ট্র পরিচালিত ১৪০টি সামরিক ঘাঁটি বন্ধ করে দেওয়ার পক্ষে।

গ্রিন দলের ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রার্থী চেরি হোংকালা। মিনোসোটার একটি দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে আসা হোংকালা একজন প্রখ্যাত দারিদ্র বিরোধী প্রচারণা কর্মী।

এর আগেও ২০১১ সালে ফিলাডেলফিয়ার শেরিফ পদে দাঁড়িয়ে পরাজিত হন তিনি। এছাড়া তিনি প্রতিষ্ঠা করেন মানবাধিকার সংগঠন ‘পুওর পিপলস ইকোনোমিক হিউমান রাইটস ক্যাম্পেইন’।

গত মাসে হফস্ট্রা বিশ্ববিদ্যালয়ে জোর করে ঢোকার চেষ্টার সময় গ্রেফতার হয়ে অবশ্য কিছুটা আলোচিত হয়েছিলেন স্টাইন ও হোংকালা। সেখানে তখন ওবামা ও রমনির মধ্যে দ্বিতীয় প্রেসিডেন্সিয়াল বিতর্ক চলছিলো।

গত নির্বাচনে গ্রিন পার্টি পেয়েছিলো ১ লাখ ৬১ হাজারের কিছু বেশি ভোট।

আন্তর্জাতিক