মাল্টি লেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) কোম্পানি ডেসটিনি ইউনিপেটুইউসহ ১১টি প্রতিষ্ঠানের প্রায় দশ হাজার কোটি টাকা উদ্ধারের প্রস্তুতি নিতে যাচ্ছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। প্রাথমিকভাবে ডেসটিনির তিন হাজার ২৮৫ কোটি উদ্ধারের চেষ্টা করা হবে তারপর ক্রমান্বয়ে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের টাকা উদ্ধারের জন্য আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
দুদকের অনুসন্ধান ও তদন্ত বিভাগ এসব তথ্য জানায়।
দুদক মনে করছে টাকা পাওয়ার ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা থাকায় এমএলএম কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে জনগণের ক্ষোভ বাড়ছে তাই প্রতিষ্ঠানগুলোর সম্পদ চুরি বা খোয়া যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। অথচ ওই সব সম্পদ বিক্রি করেই আত্মসাৎকৃত জনগণের টাকা ফেরত দেওয়া যায়। জনগণের বিনিয়োগকৃত টাকা ফেরত দিতেই শিগগিরই আদালতের দারস্থ হচ্ছে দুদক।
সূত্র জানায়, এমএলএম প্রতিষ্ঠানগুলোর সম্পদ সরকারের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করতে শিগগির আদালতে আবেদন করবে দুদক। আদালতের আদেশ অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোর দখলে থাকা বাড়ি, জমি, ফ্ল্যাট, শিল্প প্রতিষ্ঠান ও ব্যাংক-ব্যালান্স সরকারের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করা হবে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী দেশে বর্তমানে এমএলএম প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৬২টি। ডেসটিনি ২০০০ লিমিটেডের গ্রাহক প্রায় ৫০ লাখ। আর গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের প্রতিবেদন অনুসারে প্রায় এক কোটি গ্রাহক এমএলএম প্রতারণার ফাঁদে পা দিয়েছেন। বিনিয়োগকারীদের বেশিরভাগই স্বল্প আয় ও মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্যরা।
দুদকের অনুসন্ধান ও তদন্ত বিভাগ জানায়, এ পর্যন্ত ৫৫টি এমএলএমের বিরুদ্ধে দুদকে অভিযোগ এসেছে। তারমধ্যে যাচাই-বাছাই করে বর্তমানে ডেসটিনিসহ এগারটি এমএলএমের বিরুদ্ধে দুদকের অনুসন্ধান ও তদন্ত চলছে।
ডেসটিনি ছাড়া অন্যান্য এমএলএমগুলোর হচ্ছে ইউনিপে টু ইউ, ইউনিগেট ওয়ে টু ইউ, ইউনিরুট ফাইন্যান্স ও মা পলিকম লিমিটেড, ইজেন্ট ইন্টারন্যাশনাল, র্যাবন এক্স, ল অ্যট ভিশন এবং পিক এশিয়া অনলাইন বাংলাদেশ লিমিটেডসহ ছোট দুটি কোম্পানি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে দুদকের একজন সিনিয়র আইনজীবী বলেন, “দুর্নীতির টাকায় অর্জিত সম্পদ বিক্রি করে জনগণের ওই সব টাকা ফেরত দেওয়ার আইনগত বিধান রয়েছে। আইনগত সে প্রক্রিয়া বাস্তবায়নের লক্ষ্যেই তাদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে ব্যবস্থাপক নিয়োগের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।“
চলতি মাসেই দুদক আদালতে আবেদন করতে পারে বলে তিনি জানান।
এ আইনজীবী বলেন, “প্রথমে ডেসটিনির সম্পদ বাজেয়াপ্ত করতে আদালতে আবেদন করা হবে। এরপর ইউনিপেটুইউ এবং পর্যায়ক্রমে অন্য এমএলএমগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।“
যোগাযোগ করা হলে দুদক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান বলেন, “এসব এমএলএম কোম্পানিগুলো সাধারণ মানুষের সরলতাকে পুঁজি করে কোটি কোটি টাকা প্রতারণার মাধ্যমে আত্মসাৎ করেছে। প্রত্যক্ষভাবে এখানে সাধারণ মানুষের স্বার্থ যুক্ত। জনগণ কীভাবে তাদের টাকা ফেরত পায় সে দিকটি দুদক গুরুত্ব সহকারে দেখছে।”
অনুসন্ধান ও তদন্ত বিভাগ জানায়, ডেসটিনির বিরুদ্ধে তিন হাজার ২৮৫ কোটি ২৬ লাখ ৮৮ হাজার ৫২৪ টাকা, ইউনিপেটুইউ বিডির বিরুদ্ধে এক হাজার ২০০ কোটি ৭৪ লাখ ৮৫ হাজার ৮৬ টাকা, ইউনিগেটওয়েটুইউ ট্রেডিং প্রাইভেট লিমিটেডের বিরুদ্ধে ২৯ কোটি ২২ লাখ ৪০ হাজার ২২৭ টাকা, ইউনি রুট ফাইন্যান্স অ্যান্ড কমার্স লিমিটেডের বিরুদ্ধে ১৬ কোটি তিন লাখ ৭৯ হাজার ৫৩০ টাকা ও মা পলিকম লিমিটেডের বিরুদ্ধে ৩৪ কোটি ৭৮ লাখ ৬৮ হাজার ৫০৮ টাকা পাচারের অভিযোগ আনা হয়েছে। এ ছাড়া স্পিক এশিয়া নামে একটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ২৫০ কোটি টাকা ও ইজেন ইন্টারন্যাশনালের বিরুদ্ধে ২ কোটি ৫১ লাখ ২৯ হাজার টাকা পাচারের অভিযোগে মামলার প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।
এসব কোম্পানির বিরুদ্ধে অভিযোগ খতিয়ে দেখছেন দুদকের উপপরিচালক তৌফিকুল ইসলামের নেতৃত্বাধীন গঠিত একটি তদন্ত দল।
প্রয়োজনীয় আইন ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার অভাবে গত কয়েক বছরে দেশে বেশ কিছু এমএলএম কোম্পানি গজিয়ে ওঠে। মোটা অংকের মুনাফার লোভ দেখিয়ে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে বিপুল অর্থ সংগ্রহ করে। পরে অনেক ক্ষেত্রেই এসব প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা লাপাত্তা হয়ে যাওয়ায় ব্যবসার নামে প্রতারণার বিষয়টি সবার নজরে আসে।
২০১০ সালের শেষ দিকে ইউনিপেটুইউর বিরুদ্ধে এভাবে প্রতারণার অভিযোগ ওঠে। বিনিয়োগকারীরা রাস্তায় নেমে সরকারের কাছে প্রতিকার চাইলে অর্থমন্ত্রীর নির্দেশে বাংলাদেশ ব্যাংক উদ্যোগী হয়।
এরপর গত বছর জানুয়ারিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক বিজ্ঞপ্তিতে জনগণকে সতর্ক করে বলা হয়, এমএলএম ব্যবসায় কিছু প্রতিষ্ঠান বিদেশে সোনার বাজার কিংবা মুদ্রা বাজারে বিনিয়োগের নামে মাসে ১০ শতাংশেরও বেশি মুনাফার আশ্বাস দিয়ে প্রতারণামূলকভাবে অর্থ সংগ্রহ করছে।
ওই সময় দুর্নীতি দমন কমিশন কিছু এমএলএম প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা করে এবং বাংলাদেশ ব্যাংক বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম স্থগিত করে।
সর্বশেষ অবৈধ ব্যাংকিংয়ের অভিযোগে ডেসটিনি ২০০০ লিমিটেডের প্রেসিডেন্ট, চেয়ারম্যান, এমডি, পরিচালকসহ শীর্ষ ২২ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করে। বর্তমানে এমডি, চেয়ারম্যান ও একজন পরিচালক কারাগারে আছেন।