বিমান হামলার নিন্দার মধ্যেই যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা নেতানিয়াহুর

বিমান হামলার নিন্দার মধ্যেই যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা নেতানিয়াহুর

রোববার রাফায় ইসরায়েলি বিমান হামলায় বহু হতাহতের ঘটনায় নিন্দার মধ্যেই ফিলিস্তিনে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা আবার দিয়েছেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু।

হামাস পরিচালিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে, রবিবারের ওই হামলায় কমপক্ষে ৪৫ জন নিহত হয়েছে। যাতে আরও শতাধিক মানুষ গুরুতরভাবে আগুনে পুড়ে গেছে, হাত পা ভেঙ্গে অনেকে চিকিৎসা নিচ্ছে হাসপাতালে।

ইসরায়েলের পার্লামেন্টে বক্তৃতায় নেতানিয়াহু বলেছেন, ‘হামলাটি ছিল একটি দুঃখজনক ভুল। আমরা লক্ষ্য অর্জনের আগে আমি যুদ্ধ শেষ করতে চাই না।’

তিনি বলেন, ইসরায়েল বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষার জন্য সম্ভাব্য সব ধরনের সতর্কতা নিয়েছে। ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) নিরীহ মানুষদের ক্ষতি না করতে তাদের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।

গত বছরের ৭ অক্টোবরের হামলার সময় হামাসের হাতে জিম্মি ব্যক্তিদের তাদের পরিবারের সদস্যদের কাছে ফিরিয়ে দেয়ার বিষয়ে একটি চুক্তি ব্যর্থ হওয়ায় ইসরায়েলিদের অনেকে প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর সমালোচনা করেছেন।

‘রাফাহ থেকে আমরা ইতিমধ্যে প্রায় এক মিলিয়ন বেসামরিক বাসিন্দাদের সরিয়ে নিয়েছি এবং তাদের ক্ষতি না করার জন্য আমাদের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা সত্ত্বেও, দুর্ভাগ্যবশত কিছু দুঃখজনকভাবে ভুল হয়েছে’, জোর দিয়ে বলছিলেন নেতানিয়াহু।

‘আমরা ঘটনাটি তদন্ত করছি এবং এটি নিয়ে একটা সমাধানে পৌঁছাতে চাই। কারণ, এটা আমাদের নীতি।’

আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো এরই মধ্যে এই হামলার নিন্দা জানিয়েছে। ইইউ জোর দিয়ে বলেছে, ইসরায়েলকে গত সপ্তাহে রাফাহতে হামলা বন্ধ করতে আন্তর্জাতিক বিচার আদালত যে রায় দিয়েছে তার প্রতি সম্মান করা উচিত। ইইউর শীর্ষ কূটনীতিক জোসেফ বোরেল এই বিমান হামলাকে ‘ভীতিকর’ বলে বর্ণনা করেছেন।

ইসরায়েল রাফায় আক্রমণ চালিয়ে যাওয়ার যে ঘোষণা পুনরায় দিয়েছে, কর্মকর্তারা তার পক্ষে দাবি করছেন যে, আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের রায় সত্ত্বেও আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ীই তাদের অভিযান চালানোর সুযোগ রয়েছে।

তবে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক প্রধান ভলকার তুর্ক বলেছেন, ‘এ হামলা প্রমাণ করে ইসরায়েল সেই আগের পদ্ধতিতেই যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল। যে কারণে এরই মধ্যে অনেক বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছে।’

গত জানুয়ারির পর রোববার প্রথমে তেল আবিবে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় হামাস। এর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই রাফাহতে পাল্টা হামলা চালায় ইসরায়েল।

ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা জানান, রাফাহ হামলায় হামাসের দুই সিনিয়র কমান্ডার নিহত হয়েছে এবং তারা ওই এলাকায় বেসামরিক মানুষের মৃত্যুর বিষয়ে তদন্ত করছে।

তবে ফিলিস্তিনি রেড ক্রিসেন্ট বলেছে, রাফাহ কেন্দ্র থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে তাল আল-সুলতানে বাস্তুচ্যুতদের জন্য নির্মিত জাতিসংঘ পরিচালিক বেসামরিক সহায়তার তাবু লক্ষ্য করে এই হামলাটি চালানো হয়।

প্রথমে বড় বিষ্ফোরণ ও পরে তীব্র আগুন জ্বলতে দেখা গেছে তাল সুলতান এলাকার একটি ভিডিওতে।

মেডিসিন্স স্যান্স ফ্রন্টিয়ার্স বলছে, এই বিমান হামলার পর নারী ও শিশুসহ অন্তত ২৮ জন নিহত হয়েছে, তাদের অনেকেই চিকিৎসার জন্য ভর্তি করা হয়েছে।

সেখানে আরও ১৮০ জনের চিকিৎসা চলছে যাদের বেশিরভাগই বোমায় স্প্রিন্টারবিদ্ধ, ভাঙ্গা হাত পা ও আঘাতজনিত পোড়ায় ভুগছে।

লক্ষ্যবস্তু ভুল ছিল বলে ইসরায়েল যে বক্তব্য দিয়েছে তা প্রত্যাখ্যান করে মেডিসিনস স্যান্স ফ্রন্টিয়ার্স বলছে, হামলাটি সুনির্দিষ্ট ছিল। কথিত নিরাপদ রাফাহতে একটি জনবহুল ক্যাম্পে চালানো আক্রমণ প্রমাণ করছে, গাজার বেসামরিক নাগরিকদের জীবন তাদের কাছে মূল্যহীন।

এই চিত্রকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ‘হুদয় বিদারক’ বলছে। তবে তারা এটাও বলেছে যে ইসরায়েলেরও আত্মরক্ষার অধিকার রয়েছে।

হোয়াইট হাউসের জাতীয় নিরাপত্তা বিভাগের একজন মুখপাত্র বলেন, হামাসকে প্রতিহত করার অধিকার আছে ইসরায়েলের। আমরা যতটুকু জানতে পেরেছি, এই হামলায় হামাসের দুই সিনিয়র কমান্ডার নিহত হয়েছে, যারা ইসরায়েলি বেসামরিক মানুষদের ওপর হামলার জন্য দায়ী।

তবে তিনি এটাও স্বীকার করেন, ইসরায়েলকে অবশ্যই বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষার জন্য সম্ভাব্য সব সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।

রোববার রাফাহর ওই হামলায় কী ভুল হয়েছে তা খুঁজে বের করতে ইসরায়েলি কর্মকর্তারা সোমবারের বেশিরভাগ সময় পার করেছেন। তারা বুঝতে চেয়েছেন একটি নির্ভুল হামলায় কিভাবে এত আগুন ধরলো আর এত প্রাণহানিও বা কেন হল।

আন্তর্জাতিক বিচার আদালত গত সপ্তাহে একটি রায়ে ইসরায়েলকে রাফাহ এলাকায় যে কোনও ধরনের অপারেশন বন্ধের নির্দেশ দিয়েছিল। যেখানে বলা হয়েছিল, ইসরায়েলের এই হামলা ফিলিস্তিনি সাধারণ মানুষকে আরও ক্ষতি করতে পারে।

রবিবারের ওই বিমান হামলাটি গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে করা হয়েছিল। ধারণা করা হয়েছিল এই হামলায় হামাসের অনেক নেতাই মারা যাবে।

কিন্তু এতে বিপুলসংখ্যক বেসামরিক নাগরিক মারা যায়। ধারণা করা হচ্ছে এর সাথে বিপুল পরিমাণে দাহ্য পদার্থ ছিল। সেটি কীভাবে আসলো সেটি নিয়েই নানা প্রশ্ন তৈরি হয়েছে।

ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল ইফাত তোমের ইয়েরুশালমি সহ শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তারা এই ঘটনার নির্ভুল তদন্তের কথা বলেছে। তিনি বলেছেন, আমরা খুব শীঘ্রই আরও বিস্তারিত ব্যাখ্যা আশা করতে পারি।

রবিবারের হামলাকে নেতানিয়াহু রাফাহতে ‘সম্পূর্ণ বিজয়’ বলে অভিহিত করেছিলেন। কিন্তু ভুল লক্ষ্যবস্তু হওয়ার পরও তিনি তার অবস্থান থেকে সরে আসেননি।

আগের রাতের ভয়ঙ্কর ঘটনার পরও ইসরায়েলি স্থল বাহিনী এখনও রাফাহ শহরের কাছাকাছি অবস্থান করছে। তবে, এখন তারা কিছুটা সতর্কতা অবলম্বন করছে। স্থল বাহিনীর এই অভিযানে কোনো রক্তপাত ঘটেনি।

কিন্তু রবিবারের বিমান হামলার ঘটনায় ইসরায়েলের ভাবমূর্তিকে আরও ক্ষুণ্ণ করেছে।

গত ৭ অক্টোবর হামাসের বন্দুকধারীরা ইসরায়েলে হামলা চালানোর পরই গাজায় সামরিক অভিযান শুরু হয়। তখন প্রায় ১,২০০ জনকে হত্যা এবং ২৫২ জনকে জিম্মি করে গাজায় নিয়ে যাওয়া হয়।

গাজার হামাস পরিচালিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মতে, সেই থেকে ইসরায়েলের পাল্টা হামলায় এখন পর্যন্ত ৩৬০০০ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে।

আন্তর্জাতিক শীর্ষ খবর