চট্টগ্রামে চাঞ্চল্যকর ট্রিপল মার্ডার মামলায় দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দেয়ার পরও গৃহশিক্ষক তারেক চৌধুরীকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ডের আবেদন এবং তা মঞ্জুর করা নিয়ে আইনজীবীদের মধ্যে প্রশ্ন উঠেছে।
চট্টগ্রাম আদালতের জেষ্ঠ্য আইনজীবীদের কেউ কেউ এ বিষয়টিকে সরাসরি আইনের লঙ্ঘন বলে অভিহিত করেছেন। আবার কোন কোন আইনজীবী এতে আইনের ধারাবাহিকতা ক্ষুন্ন হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন।
চট্টগ্রাম আদালতের জেষ্ঠ্য আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজুর আহমেদ আনসারি বলেন, `সুপ্রিম কোর্টের রুলস আছে যে, কোন আসামীর যদি ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি নেয়া হয়, তাহলে সে দায় স্বীকার করুক বা না করুক, তাকে আর কোন জিজ্ঞাসাবাদ করা যাবেনা। আর জবানবন্দি নেয়ার যে ছক বিচারককে লিপিবদ্ধ করতে হয় সেখানেও বিষয়টি উল্লেখ আছে।`
তিনি বলেন, `সুতরাং ট্রিপল মার্ডার মামলায় গৃহশিক্ষককে যে রিমান্ডের আবেদন সেটাও বেআইনী এবং মঞ্জুরের বিষয়টিও বেআইনী।`
তবে চট্টগ্রাম আদালতের প্রবীণ আইনজীবী অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত বলেন, `রিমান্ড আবেদন কিংবা মঞ্জুরের ক্ষেত্রে আইনের তেমন কোন ব্যত্যয় হয়নি। তবে এটি সাধারণত নজিরবিহীন। গ্রেপ্তারের পর রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ এবং তারপর ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি নিলে বিষয়টি স্বাভাবিকতার পর্যায়ে পড়ত।`
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নগর পুলিশ কমিশনার মো.শফিকুল ইসলাম বলেন, `গ্রেপ্তারের পর গৃহশিক্ষক তারেক আমাদের কাছে, আপনাদের (সাংবাদিক) সামনে এবং আদালতে যেসব তথ্য দিয়েছে সেগুলো যাচাইবাছাই করার জন্যই তাকে রিমান্ডে নেয়া হচ্ছে। বিষয়টি আমরা রিমান্ড আবেদনেও উল্লেখ করেছি।`
এক্ষেত্রে আইনের ব্যত্যয় হয়েছে কিনা প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, `বিষয়টি আদালত দেখবে। আর আদালত সবকিছু বিচার-বিশ্লেষণ করেই রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন।`
গত ২৩ অক্টোবর চট্টগ্রাম নগরীর পাঁচলাইশ থানার খতিবের হাট এলাকায় মা-মণি ভিলা নামে একটি বাসায় নৃশংসভাবে খুন হন আবুধাবি প্রবাসী আনোয়ার হোসেনের স্ত্রী ডলি আক্তার (৩০), ছেলে আলভি (১০) ও মেয়ে পায়েল (৫)।
এ ঘটনার দু`দিনের মাথায় ২৫ অক্টোবর দুপুরে আলভি এবং পায়েলের গৃহশিক্ষক তারেককে (২২) গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরদিন ২৬ অক্টোবর তারেককে আদালতে হাজির করে জবানবন্দি নেয়া হয় এবং ওইদিনই আবার ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন জানানো হয়। মঙ্গলবার আদালত চারদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
আদালত সূত্রে জানা গেছে, ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি নেয়ার পর আবার রিমান্ড আবেদনের যৌক্তিকতা নিয়ে রিমান্ড মঞ্জুরকারী বিচারক মহানগর হাকিম মুনতাসির আহমেদও পরোক্ষভাবে প্রশ্ন তুলেছেন। রিমান্ড মঞ্জুরের আদেশে ওই বিচারক এ বিষয়ে পরোক্ষ ইঙ্গিতও দিয়েছেন। আর রিমান্ড মঞ্জুর করলেও বিচারক হত্যাকান্ডের মোটিভ পরিস্কার করা এবং অন্য কারও প্ররোচণায় হত্যাকান্ড কিনা সুনির্দিষ্টভাবে এ দু`টি বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদের কথা আদেশে উল্লেখ করে দিয়েছেন।
চট্টগ্রাম আদালতের জেষ্ঠ্য আইনজীবী অ্যাডভোকেট ইব্রাহিম হোসেন চৌধুরী বাবুল বলেন, `আমার দীর্ঘদিনের ফৌজদারি আইন পেশার অভিজ্ঞতায় দেখেছি, সাধারণত জবানবন্দি নেয়ার পর কোন আসামীকে আবারও রিমান্ডে নেয়ার নজির আমাদের আইন অঙ্গনে নেই। এক্ষেত্রে পুলিশ রিমান্ডের আবেদন করে ধারাবাহিকতা ভঙ্গ করেছে। তবে বিচারক রিমান্ড মঞ্জুরের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট গ্রাউন্ড উল্লেখ করে দিয়ে যৌক্তিক কাজ করেছেন। কারণ আইনে বাধা না থাকলেও দীর্ঘদিনের প্রথা দিয়ে তো শুধু তিনি রিমান্ড ঠেকাতে পারবেন না।`
উল্লেখ্য গ্রেপ্তারের পর তারেক সাংবাদিকদের জানিয়েছিল, গত এপ্রিল মাসে বাচ্চাগুলোকে পড়ানো শুরুর পর প্রথম দু`মাস ঠিক সময়ে শিক্ষকের বেতন দু`হাজার টাকা করে পরিশোধ করেন ডলি। এরপর থেকে বেতন অনিয়মিত হয়ে যায়। টাকা খুঁজলেও দিতে গড়িমসি শুরু করেন। এছাড়া টাকা খোঁজার সঙ্গে সঙ্গে পড়ালেখার বিভিন্ন খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে তার সঙ্গে ঝগড়াঝাটি শুরু করেন। তারেক প্রতিদিন দু`ঘণ্টা পড়াত। ডলি এতে আপত্তি তুলে আরও বেশি সময় নিয়ে পড়ানোর কথা বলেন। আবার বেতনও পাঁচশ টাকা করে কমিয়ে দেন। এতে তারেকের মনে ক্ষোভ ও প্রতিশোধস্পৃহা জন্ম নেয়। আর সেটা থেকেই হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটে।
এসময় সিএমপি কমিশনার মো.শফিকুল ইসলাম সাংবাদিকদের হত্যাকান্ডের কারণ হিসেবে আরও কিছু তথ্য দেন। তিনি জানান, ডলি`র বাসায় বিদেশি দু`টি দামী মোবাইল সেট ছিল। তারেকের দীর্ঘদিনের ইচ্ছে ছিল সে একটি দামী মোবাইল সেট ব্যবহার করবে। কিন্তু সামর্থ্য না থাকায় মোবাইল সেট কিনতে পারছিল না। এজন্য তারেক ডলির বাসার মোবাইল সেটগুলো চুরি করার পরিকল্পনা করে। এরপর এ হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটায়।
এদিকে হত্যাকান্ডের মোটিভ খুঁজতে মাঠ পর্যায়ে কাজ করা এক উর্দ্ধতন পুলিশ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, গত এপ্রিলে ডলি`র ছেলেমেয়েদের পড়ানো শুরুর পর থেকেই ডলির উপর কুনজর পড়ে তারেকের। ডলি তার বিভিন্ন অনৈতিক প্রস্তাবে রাজি না হয়ে এক পর্যায়ে নভেম্বর থেকে তাকে আর পড়াতে না যাবার কথা বলে দেন। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে তারেক এ নৃশংস হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটিয়েছে।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, নৃশংস খুনের শিকার ডলির সুরতহাল রিপোর্টে ধর্ষণ কিংবা ধর্ষণের চেষ্টার কিছু আলামত পাওয়া গেছে। কিন্তু পুলিশের কাছে কিংবা আদালতের জবানবন্দিতে এ ধরনের কিছু বলেনি তারেক। এ বিষয়েও জিজ্ঞাসাবাদ করা প্রয়োজন বলে পুলিশ মনে করছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নগর পুলিশ কমিশনার মো.শফিকুল ইসলাম বলেন, `বিভিন্ন বিষয় আমাদের খতিয়ে দেখতে হবে। তারেক তাকে টিউশনি ঠিক করে দেয়ার ক্ষেত্রে যাদের নাম বলেছে, তাদের সম্পর্কে তথ্য প্রয়োজন। না হলে, বিচার প্রক্রিয়ায় গেলে এ মামলা টিকবেনা।`