রাষ্ট্রের অধিপতি হিসেবে ভাতা পান সাড়ে চার হাজার ডলারের কম; অথচ হাতে পড়েন ৫ লাখ ডলারের ঘড়ি। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে রোলেক্স ব্র্যান্ডের বিলাসবহুল ঘড়িটি শোভা পায় পেরুর প্রেসিডেন্ট দিনা বোলুয়ার্তের হাতে। এবার এ ঘড়ির কারণেই অস্বস্তিকর এক পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছেন ৬১ বছর বয়সী এ সরকার প্রধান।
প্রেসিডেন্ট হিসেবে বোলুয়ার্তের বেতন-ভাতা আর হাতে পরা ঘড়িটির দামের মধ্যে আকাশ-পাতাল ব্যবধানে দুর্নীতির গন্ধ পাচ্ছে পেরুর বিচার বিভাগ। ফলে প্রেসিডেন্টের বাসভবনে অভিযান চালানোর অনুমতি দিয়েছে বিভাগ। এই পরিপ্রেক্ষিতে বিলাসবহুল ঘড়িটির খোঁজে সেখানে যৌথ অভিযান চালিয়েছে পুলিশ এবং প্রসিকিউটর অফিস।
অভিযান পরিচালনাকালে রাজধানী লিমার সুরকিলো জেলায় প্রেসিডেন্টের বাসভবন ঘেরাও করার সঙ্গে সঙ্গে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেন সরকারি সংস্থার কর্মকর্তারা। এ সময় প্রেসিডেন্টকে অবশ্য তার বাসভবনে দেখা যায়নি।
শনিবার (৩০ মার্চ) ভোরে পরিচালিত অভিযানটি সম্প্রচারিত হয়েছে স্থানীয় টেলিভিশন চ্যানেল লাতিনায়। বার্তা সংস্থা দ্য অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, টেলিভিশনে সম্প্রচারিত ছবিতে তদন্তকারী দলের এজেন্টদের প্রেসিডেন্টের বাসভবনে একটি স্লেজহ্যামার নিয়ে প্রবেশ করতে দেখা গেছে।
পুলিশের নথির বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থা এএফপির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিলাসবহুল রোলেক্স ঘড়িটির সন্ধানে প্রেসিডেন্টের বাসভবনে অভিযান চালায় অন্তত ৪০ জন কর্মকর্তা। নিজের সম্পদ বিবরণীতে এ ঘড়িটির কথা উল্লেখ করেননি প্রেসিডেন্ট বোলুয়ার্তে।
অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিসের অনুরোধে বিচার বিভাগ কর্তৃক অনুমোদিত এই অভিযান সম্পর্কে পুলিশ জানায়, ‘তল্লাশি ও জব্দ করার উদ্দেশ্যেই অভিযান চালানো হয়েছে।’
এদিকে এ বিষয়ে এক্স প্ল্যাটফর্মে প্রেসিডেন্ট বোলুয়ার্তে বলেন, ‘অভিযানে বাসভবনের কর্মীরা কর্মকর্তাদের সহযোগিতা করেছেন। এটি স্বাভাবিক, কোনো ঘটনা ছাড়াই অভিযানটি শেষ হয়েছে।’
প্রেসিডেন্টের বাসভবনে এ ধরনের অভিযানকে ভালো চোখে দেখছেন না পেরুর প্রধানমন্ত্রী গুস্তাভো আদ্রিয়ানজেন। এক্স হ্যান্ডলে তিনি বলেছেন, ‘যে রাজনৈতিক গোলমাল তৈরি করা হচ্ছে, এটি গুরুতর ব্যাপার। এতে বিনিয়োগ এবং সমগ্র দেশ প্রভাবিত হচ্ছে। গত কয়েক ঘণ্টায় যা কিছু ঘটেছে তা বাড়াবাড়ি এবং অসাংবিধানিক।’
এছাড়া অভিযানকালে প্রেসিডেন্ট বোলুয়ার্তেকে দেখতে পাওয়া না গেলেও তিনি ওইসময় তার বাসভবনেই ছিলেন বলে দাবি প্রধানমন্ত্রী আদ্রিয়ানজেনের। বোলুয়ার্তের পক্ষে নিজের শক্ত অবস্থান জাহির করে তিনি বলেন, তলব করা হলে প্রেসিডেন্ট প্রসিকিউটরের অফিসে গিয়ে বিবৃতি দেবেন। মন্ত্রিপরিষদ বা প্রেসিডেন্ট বোলুয়ার্তের পদত্যাগের কোনো প্রশ্নই নেই!
জানা যায়, পেরুর স্থানীয় নিউজ আউটলেট লা এনসাররোনাতে প্রেসিডেন্ট বোলুয়ার্তের ঘড়ি আর আয় নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশের পর চলতি মাসে তার সম্পদের বিষয়ে তদন্ত শুরু করে কর্তৃপক্ষ।
সরকারি বেতনে কীভাবে এত ব্যয়বহুল ঘড়ি পরতে পারেন সে প্রশ্নের জবাবে প্রেসিডেন্ট বোলুয়ার্তে সংবাদমাধ্যমটিকে বলেছিলেন, ১৮ বছর বয়স থেকে কঠোর পরিশ্রমের ফল এটি। এ সময় তার ব্যক্তিগত বিষয়গুলো ঘাঁটাঘাঁটি না করার জন্য সংবাদমাধ্যমটিকে অনুরোধও করেছিলেন তিনি।
আল জাজিরার সাংবাদিক মারিয়ানা সানচেজ জানান, বিশেষজ্ঞদের অনুমান অনুযায়ী, বোলুয়ার্তের ওই ঘড়ির দাম প্রায় ৫ লাখ মার্কিন ডলার। প্রেসিডেন্ট বা ভাইস প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগে একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রধান ছিলেন তিনি। সেখানে তার মাসিক বেতন ছিল ১ হাজার ডলার। আর এখন প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রতি মাসে প্রায় ৪ হাজার ৩০০ ডলার ভাতা পান। ফলে অনেকে বলছেন, এই ঘড়ি কেনার সামর্থ্য রাখেন না পেরুর প্রেসিডেন্ট।
এদিকে তদন্তে সহযোগিতা এবং ঘড়ি কেনার প্রমাণপত্র সরবরাহ করার জন্য বোলুয়ার্তেকে নির্দেশ দিয়েছেন অ্যাটর্নি জেনারেল হুয়ান ভিলেনা। পেরুর সরকারি নিয়ন্ত্রক সংস্থা জানিয়েছে, কোনো অনিয়ম হয়েছে কি না, খতিয়ে দেখতে বোলুয়ার্তের গত দুই বছরের সম্পদ বিবরণী পর্যালোচনা করবেন তারা।
বোলুয়ার্তে অবশ্য সব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, ‘আমি পরিষ্কার হাতে সরকারি প্রাসাদে প্রবেশ করেছি এবং আমি পরিষ্কার হাতে এখান থেকে বের হবো।’
উল্লেখ্য, ২০২১ সালের জুলাইয়ে পেরুর ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং সামাজিক অন্তর্ভুক্তি মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পান দিনা বোলুয়ার্তে। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট পেদ্রো কাস্তিলো কংগ্রেস ভেঙে দিয়ে ডিক্রি জারি করার চেষ্টা করলে ক্ষমতাচ্যুত এবং গ্রেপ্তার হন। এরপর ২০২২ সালের ডিসেম্বরে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ করেন বোলুয়ার্তে। ওই ঘটনার পরে বিক্ষোভ সংঘটিত হলে অন্তত ৪৯ জন নিহত হন তাতে।
সমালোচকদের মতে, ক্রমেই কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠছে বোলুয়ার্তের সরকার। কারণ আগাম নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন কঠোর হস্তে দমন করেছে এ সরকার। শুধু তাই নয়, পেরুর বিচার ব্যবস্থার স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন করে, এমন আইন পাসেরও চেষ্টা করছে বোলুয়ার্তে সরকার।