মার্কিন ভোটারদের মধ্যে বিতর্কের প্রভাব পড়েছে কি?

মার্কিন ভোটারদের মধ্যে বিতর্কের প্রভাব পড়েছে কি?

মার্কিন প্রেসিডেন্সিয়াল বিতর্কের পালা তো শেষ হলো। এবার ভোটের লড়াই। কিন্তু এত এত উত্তপ্ত বাগযুদ্ধের পরও একটি ব্যাপার অমীমাংসিতই থেকে গেলো। আর তা হলো, এ বিতর্ক কি অদৌ মার্কিন ভোটারদের মধ্যে কোনো প্রভাব ফেলতে পেরেছে।

ওবামার আক্রমণ, নিজের অবস্থানে সংযত রমনি এবং বব শিফারের আড়ষ্ট সঞ্চালনা, ফ্লোরিডার বোকা রাতোতে অনুষ্ঠিত তৃতীয় ও শেষ বিতর্ক দর্শকদের চোখে ধরা পড়েছে এভাবেই।

বোকা রাতোতে হয়ে যাওয়া সোমবার রাতের শেষ বিতর্কের সাতটি মূল বিষয়ের ওপর আলোকপাত করা হয়েছে মার্কিন মুল্লুকের জনপ্রিয় রাজনীতি বিষয়ক পত্রিকা পলিটিকোতে। এর ভাষ্য অবলম্বনেই পাঠকদের জন্য একটি বিশ্লেষণ তুলে ধরা হলো—

কে জিতলো, কে হারলো?
বিতর্কের পরপর করা দুটো জনমত জরিপ অবশ্য দেখাচ্ছে রমনিকে পরিষ্কার ব্যবধানে পেছনে ফেলেছেন ওবামা। তবে পণ্ডিতরা অবশ্য ওবামাকে এতটা কৃতিত্ব দিতে নারাজ।

ওবামার আক্রমণাত্মক রূপ দেখে সহযোগীরা হয়তো পুলকিত হতে পারেন তার কৃতিত্বে। বিতর্কের পুরোটা সময় জুড়েই রমনির ওপর আক্রমণের ঝড় বইয়ে দিয়েছেন ওবামা। রমনিকে চেপে ধরেছেন তার অবস্থানেই।

তবে ওবামা যে এ বিতর্কে আক্রমণাত্মক হবেন, তা আগেই ভাবা হয়েছিলো। পয়েন্ট ধরে ধরে এগিয়েছেন তিনি। রমনির উপস্থাপিত তথ্যগুলোকে পরিসংখ্যান ও পাল্টা তথ্য দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছেন তিনি।

তারপরও রিপাবলিকান শিবির ও অনেক নিরপেক্ষ ভাষ্যকারের বিশ্বাস, নিজস্ব মাঠ ধরে রাখতে সফল হয়েছেন রমনি। প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে নিজের গ্রহণযোগ্যতা উপস্থাপনের ক্ষেত্রে তিনি সফল হয়েছেন। এছাড়া তাকে অযোগ্য প্রমাণের ওবামার প্রচেষ্টাকেও তিনি ভালোভাবেই সামলেছেন বলে মনে করছেন তারা।

তার মূল কৃতিত্ব হলো যুদ্ধবাজ হিসেবে নিজেকে চিত্রিত করতে ওবামাকে সুযোগ না দেওয়া। এ ছাড়া পুরো বিতর্কেই তাকে দেখা গেছে ঠাণ্ডা মাথায়। মেজাজ চড়াননি তিনি। অপরদিকে বরং ওবামাকে কিছুটা উত্তেজিত বলে মনে হয়েছে।

এটা এখনও পরিষ্কার নয়, ভোটারদের ওপর এই বিতর্কের প্রভাব কি। উভয় শিবিরই মনে করছে নিজেদের অবস্থানে তারাই জিতেছে।

এবারের নির্বাচনী লড়াইয়ের গতি পথ নির্ধারণ, পররাষ্ট্র না অভ্যন্তরীণ নীতি?
নির্বাচনী বিতর্কের পুরো সময় জুড়ে পররাষ্ট্রনীতির প্রসঙ্গে সুবিধাজনক অবস্থায় ছিলেন ওবামা। এমনকি বেনগাজীতে সন্ত্রাসীদের হামলায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত মারা যাওয়ার পরও তাকে খুব একটা ধকল পোহাতে হয়নি।

তবে লিবিয়া ইস্যুকে বাগাতে না পারা রমনির জন্য ব্যর্থতা হিসেবেই দেখা হচ্ছে। দ্বিতীয় বিতর্কে ভুল তথ্য উপস্থাপন করে বিব্রত হওয়ার প্রসঙ্গ স্মরণ করে তিনি হয়তো তৃতীয় বিতর্কেও এ ব্যাপারে অনেকটা নীরব থাকলেন।

পররাষ্ট্রনীতিকে এক পাশে সরিয়ে রেখে যখনই সুযোগ এসেছে তখনই অভ্যন্তরীণ ব্যাপারগুলোতেই নিজেদের মধ্যে তর্কে মেতে উঠেছেন দুই প্রার্থী। শিক্ষা, রমনির ট্যাক্স পরিকল্পনা এবং ‘ফেডারেল অটো বেইল আউট’ ইত্যাদি প্রসঙ্গেই কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেছেন উভয় প্রার্থীই।

ইরান ও ইসরায়েল বিষয়ে তাদের দৃষ্টিভঙ্গিতেই মূলত কিছুটা ভিন্নতা দেখা গেলো। ইরানের ব্যাপারে ওবামার অবস্থানকে দুর্বলতা আখ্যা দেন রমনি। অপরদিকে পররাষ্ট্র বিষয়ে রমনিকে ‘অপরিপক্ক’ দাবি করে ওবামা বলেন, মধ্যপ্রাচ্যের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার ক্ষেত্রে তিনিই উপযুক্ত ব্যক্তি।  পাশাপাশি ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি আলোচনা বিষয়ক পত্রিকায় বের হওয়া খবরকেও ডাহা মিথ্যাচার হিসেবে উড়িয়ে দেন তিনি।

উভয় প্রার্থীই প্রয়াত প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির নীতিকেই আঁকড়ে ধরেছেন এবারের নির্বাচনে, ‘আগে ঘর সামলাও’। অর্থনৈতিক ইস্যুটিই বড় করে দেখছেন ওবামা। তাছাড়া তার মূল লক্ষ্য নারী ভোটার।  এছাড়া পররাষ্ট্রনীতিতে নিজের অপরিপক্কতা প্রমাণিত হওয়ায় এ মুহূর্তে নিজের জন্য অপেক্ষাকৃত নিরাপদ অভ্যন্তরীণ ইস্যুই আঁকড়ে ধরে আছেন রমনি।

সবকিছু ছাপিয়ে মধ্যপ্রাচ্য
পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ে যে টুকু আলোচনা হয়েছে তার প্রায় পুরোটা জুড়ে ছিল লিবিয়া, সিরিয়া, ইসরায়েল, মিশর, মূলত মধ্যপ্রাচ্যই।

এই এলাকায় মার্কিন স্বার্থ বর্তমানে অতীতের যে কোনো সময়ের থেকে বেশি ঝুঁকির মধ্যে। অবশ্যই বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি বড় মাথাব্যথা।

‘৯/১১’ প্রেসিডেন্ট
শেষ বিতর্কে উভয় প্রার্থীই কোনো নাটকীয় মুহূর্ত উপহার দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। কিন্তু যখন ওবামা ১১ সেপ্টেম্বর মারা যাওয়া এক ব্যক্তির মেয়ের গল্প শোনালেন, তখন দর্শকদের পুরো মনোযোগই কিন্তু ছিলো সেখানে।

সময়ের বেশ খানিকটা ধুলো জমলেও যুক্তরাষ্ট্রবাসীর মনে নাইন ইলেভেন এখনও জাগরুক। এখনও ভোটারদের আলোড়িত করে সেই বিভীষিকাময় দিনটি। তাই সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধে বিশেষ করে আল কায়েদার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক সফলতাকে নিজের পক্ষে নিতে চেষ্টার কমতি ছিল না ওবামার।

রিপাবলিকানরা যদিও দাবি করে আসছে, আল কায়েদা মোকাবেলায় ওবামার ব্যবস্থাই যথেষ্ট নয়। তবে এবার ভোটারদের মাঝে বিন লাদেনের মৃত্যু একটি আলাদা অনুভূতি বয়ে আনবে তা বলাই বাহুল্য। মধ্যপ্রাচ্যের বিষয়ে কোনো পরিষ্কার নীতি উপস্থাপন করতে রমনির ব্যর্থতাও ওবামাকে এ ব্যাপারে সুযোগ করে দিয়েছে বলে মনে করেন অনেকেই।

জর্জ বুশের ছায়া থেকে বেরোতে রমনির চেষ্টা
রমনির নীতিগুলোকে সাবেক রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট বুশ ও তার সহযোগী ডিক চেনির গৃহীত নীতির সঙ্গে তুলনা করে নিজের নির্বাচনী প্রচারণায় উপস্থাপন করতে একবারেরও জন্যও ভোলেননি ওবামা। তবে রমনি প্রাণপণে চেষ্টা করেছেন এ নির্বাচনে বুশের ছায়া থেকে বের হওয়ার।

তবে শেষ বিতর্কে এ প্রসঙ্গে কোনো অস্বস্তিকর পরিস্থিতির শিকার হননি রমনি। সঞ্চালক শিফারও বুশ ও তার নীতির প্রসঙ্গে কোনো প্রশ্ন তোলেননি।

যদিও বুশ জামানার সঙ্গে নিজের দূরত্ব দক্ষতার সঙ্গেই উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছেন রমনি, তারপরও আগামী দুই সপ্তাহের নির্বাচনী প্রচারণায় বুশ নীরব প্রভাবক হিসেবে কাজ করবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

উত্তেজনা, ঘাম আর ক্রোধ
শেষ বিতর্কে রমনিকে কিছুটা নারভাস মনে হয়েছে। পাশাপাশি কিছুটা অপ্রস্তুতও মনে হয়েছে তাকে। কিন্তু ওবামাকে টেলিভিশনে উত্তেজিত ও ক্রুদ্ধই দেখাচ্ছিলো। পুরোটা সময়ই রমনির উদ্দেশ্যে আক্রমণাত্মক মনোভাবই প্রদর্শন করেন তিনি। তবে এ বিষয়টি অনেকেই ভালোভাবে নিচ্ছেন না। বরং দ্বিতীয় বিতর্কেই তার উপস্থাপন ভালো ছিলো বলে মত দিয়েছেন অনেকেই।

শিফারই কি সবচেয়ে কম বিতর্কিত সঞ্চালক?
সঞ্চালক বব শিফার, সিবিএসের জনপ্রিয় ‘ফেস দি নেশন’ অনুষ্ঠানের উপস্থাপক। পুরো বিতর্কে তার কৃতিত্ব নিয়ে আলোচনা সমালোচনার ঝড় বয়ে গেলো টুইটারে। প্রশ্নের ক্ষেত্রে তিনি ধারালো ছিলেন না বলেই মনে করছেন অনেকে। পাশাপাশি বারবারই অভ্যন্তরীণ প্রসঙ্গকে আলোচনায় আনতে পরোক্ষ প্রশ্রয় দিয়েছেন তিনি।

এমনকি মুখ ফসকে ‘ওবামার বিন লাদেন’ বলেও ফেললেও বিশেষজ্ঞদের মতে প্রেসিডেন্সিয়াল ডিবেটের চার সঞ্চালকের মধ্যে তিনিই সবচেয়ে কম বিতর্কিত হয়েছেন।

আন্তর্জাতিক