ঢাকা, ৩১ অক্টোবর: নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্রথম মেয়র নির্বাচিত হলেন নাগরিক কমিটির প্রার্থী ডা. সেলিমা হায়াৎ আইভী। দোয়াত-কলম প্রতীক নিয়ে তিনি বেসরকারিভাবে মেয়র নির্বাচিত হন।
২০০৩ সালে অনুষ্ঠিত পৌর চেয়ারম্যান নির্বাচনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে তার সক্রিয় রাজনৈতিক জীবনের সূত্রপাত। তিনি ২০০৩ সালের ১৬ জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়লাভ করে প্রথম মহিলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন এবং চলতি বছরের ২৭ জুন পর্যন্ত তিনি মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
তিনি এক লাখ তিন হাজার ২৮৯ ভোটের ব্যবধানে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী শামীম ওসমানকে পরাজিত করে মেয়র নির্বাচিত হন। আইভী পেয়েছেন এক লাখ ৮৩ হাজার ৭৯৪ ভোট। শামীম ওসমান পেয়েছেন ৮০ হাজার ৫০৫ ভোট।
রোববার সকাল আটটায় ভোটগ্রহণ শুরু হয়ে একটানা বিকাল চারটা পর্যন্ত চলে। পরে শুরু হয় গণনা। রাত –টায় রিটানিং অফিসার বিশ্বাস লুৎফর রহমান মেয়র হিসাবে বেসরকারিভাবে ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভীকে বিজয়ী ঘোষণা করেন।
নির্বাচন পরবর্তী এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এটিএম শামসুল হুদা (সিইসি) বলেন, “নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যেসব আশঙ্কা করা হয়েছিল তা ভুল প্রমাণিত হয়েছে।”
তিনি বলেন, “নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়েছে। ভোটারদের উপস্থিতি ছিল সন্তোষজনক।”
এদিকে, নির্বাচনে মাত্র সাত ঘণ্টা আগে নির্বাচন থেকে সড়ে দাঁড়ান বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকার। সেনা মোতায়েন না করা ও ভয় ভীতি প্রদর্শনের অভিযোগ এনে নির্বাচন বয়কট করেন তৈমূর আলম খন্দকার।
২৭ সাধারণ ওয়ার্ড ও ৯ সংরক্ষিত ওয়ার্ডের ১৬৩ কেন্দ্রে আড়াই লাখেরও বেশি ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেন।
এর মধ্যে ৯ ওয়ার্ডের ৫৮ কেন্দ্রের ৪৫০টি বুথে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোটগ্রহণ হয়।
এ নির্বাচনে প্রার্থী ও নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে সেনা মোতায়েনের দাবি উঠলেও শেষ পর্যন্ত সরকার তা করা থেকে বিরত থাকেন।
গত ২২ সেপ্টেম্বর প্রধান নির্বচন কমিশনার এটিএম শামসুল হুদা নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের তফসিল ঘোষণা করেন। ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার শেষ সময় ছিল ২ অক্টোবর। মনোনয়নপত্র বাছাই ৪ ও ৫ অক্টোবর। প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ তারিখ ছিল ১২ অক্টোবর।
চিকিৎসক থেকে রাজনীতিবিদ
নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার সাবেক মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী ১৯৬৬ সালের ৬ জুন নারায়ণগঞ্জের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। মাতা- মমতাজ বেগম ও পিতা সাবেক পৌর চেয়ারম্যান আলী আহাম্মদ চুনকা।
চুনকা পরিবারের পাঁচ সন্তানের মধ্যে ডা. আইভী হলেন প্রথম সন্তান। তিনি দেওভোগ আখড়া প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শিক্ষা জীবন শুরু করেন। পরবর্তীতে তিনি নারায়ণগঞ্জ প্রিপারেটরী স্কুলে ভর্তি হন এবং ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। তারপর তিনি মর্গ্যান বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৯৭৯ সালে ট্যালেন্টপুলে জুনিয়র স্কলারশিপ পান এবং ১৯৮২ সালে মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষায় স্টারমার্কসহ উত্তীর্ণ হন।
এরপর তিনি ১৯৮৫ সালে রাশিয়ান সরকারের স্কলারশিপ নিয়ে চিকিৎসা বিজ্ঞানে শিক্ষাগ্রহণের জন্য ওডেসা পিরাগোব মেডিক্যাল ইনস্টিটিউটে ভর্তি হন এবং ১৯৯২ সালে কৃতিত্বের সাথে এমডি ডিগ্রি লাভ করেন। পরবর্তীতে ১৯৯২-৯৩ সালে ঢাকা মিডফোর্ট হাসপাতালে ইন্টার্নি সম্পন্ন করেন। ডা. আইভী তার সুদীর্ঘ শিক্ষা জীবনের পর ১৯৯৩-৯৪ সালে মিডফোর্ট হাসপাতালে এবং ১৯৯৪-৯৫ সালে নারায়ণগঞ্জ ২০০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালে অনারারি চিকিৎসক হিসেবে কাজ করেন। ডা. আইভী ১৯৯৫ সালের ১৫ নভেম্বর রাজবাড়ী নিবাসী কাজী আহসান হায়াৎ-এর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। স্বামী কাজী আহসান হায়াৎ বর্তমানে কম্পিউটার প্রোগ্রামার হিসেবে নিউজিল্যান্ডে কর্মরত আছেন।
পারিবারিক জীবনে তিনি দুই পুত্র সন্তানের জননী। কাজী সাদমান হায়াত সীমান্ত (জন্ম ৫ মে ১৯৯৮) ও কাজী সারদিল হায়াত অনন্ত (জন্ম ২০ জুন ২০০২)। তিনি ১৯৯৫ সাল থেকে নিউজিল্যান্ডে বসবাস শুরু করেন। সেখানে তিনি নিউজিল্যান্ডের অকল্যান্ডে মেডিক্যাল ল্যাবরেটরি সায়েন্সে অধ্যয়ন শুরু করেন। তিনি অধ্যয়নরত অবস্থায় ২০০২ সালের ডিসেম্বরে দেশে ফিরে আসেন। তার এই দীর্ঘ প্রবাস জীবনে তিনি দেশের মানুষ ও সর্বোপরি নিজের সেই পরিচিত শহর ও শহরবাসীর জন্য এক প্রগাঢ় হৃদয়ের আকর্ষণ অনুভব করেন। তিনি অধ্যয়নকালীন সময়ে ও প্রবাস জীবনের ফাঁকে ফাঁকে ছুটে এসেছেন জন্মভূমিতে। এছাড়া তিনি গরীব ও দুঃখী লোকদের বিনামূল্যে চিকিৎসা এবং আর্থিকভাবে সাহায্য করেন। তার এই কর্মকাণ্ডে পৌরপিতা আলী আহাম্মদ চুনকার দানশীলতা, মানবপ্রেম ও একই সঙ্গে মানব সেবার প্রতিফলন ঘটে।
ডা. আইভী তার শিক্ষাগত ও পেশাগত জীবনে বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্র ভ্রমণ করেছেন, যেমন- জার্মান, হল্যান্ড, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ইতালি, শ্রীলংকা, চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ব্রাজিল ও ভারত।
তিনি স্কুল ও কলেজ জীবন থেকে বাবার সঙ্গে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করতেন। ১৯৯৩ সালে তিনি নারায়ণগঞ্জ শহর আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্য ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদিকা ছিলেন। ২০০৩ সালে অনুষ্ঠিত পৌর চেয়ারম্যান নির্বাচনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে তার সক্রিয় রাজনৈতিক জীবনের সূত্রপাত ঘটে। তিনি ১৬ জানুয়ারি ২০০৩ তারিখে নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়লাভ করে নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার প্রথম মহিলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন এবং ২০১১ সালের ২৭ জুন পর্যন্ত তিনি মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে তিনি নারায়ণগঞ্জ শহর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতির দায়িত্বে আছেন।
তিনি আলী আহাম্মদ চুনকা ফাউন্ডেশন এবং নারায়ণগঞ্জ হার্ট ফাউন্ডেশন-এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এবং তিনি স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ)-এর নারায়ণগঞ্জ জেলার আহ্বায়কের দায়িত্বে আছেন। এছাড়াও বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত আছেন।