এক বছরেরও বেশি সময় ধরে বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত পর্যালোচনা শেষে ফুলবাড়ি কয়লাখনি নিয়ে বিতর্ক ও আন্দোলনের মধ্যে গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটি উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের পক্ষে মতামত তৈরি করেছে সরকার। যা সরকারের কাছে শিগগিরই জমা দেয়া হবে।
এদিকে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের বিরোধিতাকারী বামপন্থী নাগরিক সংগঠন তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ, বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি আন্দোলনের হুমকি দিয়েছে।
বিশেষজ্ঞ কমিটির প্রধান পেট্রোবাংলার সাবেক চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন শনিবার বলেন, আমাদের মনে হয়েছে ফুলবাড়ি কয়লাখনি ও বড়পুকুরিয়ার উত্তর অংশে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন করা সম্ভব।
দেশে পাঁচটি কয়লা খনি থাকলেও সিদ্ধান্ত না থাকায় শুধু একটি খনি থেকে স্বল্প মাত্রায় কয়লা তোলা হচ্ছে, যা বিদ্যুৎ উৎপাদনে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহারের জন্য অপর্যাপ্ত। গত এক দশকে কয়লা নীতিও চূড়ান্ত করতে পারেনি সরকার।
এ অবস্থায় শিল্পোন্নয়নে ভারত ও চীনের মতো কয়লানির্ভর বিদ্যুৎ কেন্দ্র বাড়াতে কয়লা উত্তোলন বৃদ্ধির জন্য সরকারের ওপর চাপ দিচ্ছে ব্যবসায়ীরা।
মোশাররফ হোসেন বলেন, যেখানে মাটির কাছাকাছি কয়লা আছে সেখানে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন করাই ভালো। ফুলবাড়ি ও বড়পুকুরিয়ার উত্তর অংশে ১৭৫ মিটার গভীরতায় কয়লা রয়েছে। উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তুললে মোট মজুদের ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশ এবং ভূগর্ভস্থ পদ্ধতিতে ৬৫ থেকে ৭০ শতাংশ কয়লা তোলা যাবে।
এশিয়া এনার্জির হিসাবে, ফুলবাড়িতে ৫৭২ মিলিয়ন টন কয়লার মজুদ রয়েছে, দক্ষিণে খনন করলে যার পরিমাণ আরো বাড়তে পারে। প্রতিবছর ১৫ মিলিয়ন টন উৎপাদন ক্ষমতা ধরা হয়েছে।
উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তোলার বিষয়ে সবচেয়ে বেশি সমালোচনা হয়েছে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা নিয়ে।
এ সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাবে মোশাররফ হোসেন বলেন, কূপ থেকে যে পানি উঠবে তা আলাদা নালা দিয়ে অন্যত্র সরিয়ে দেওয়া সম্ভব। সেটা কীভাবে সরানো হবে তা দেখার বিষয়। উন্মুক্ত পদ্ধতি করার সময় কয়লার ওপরের মাটির স্তর কোথায় রাখা হবে সেটাও দেখার বিষয়।
তিনি জানান, ফুলবাড়িতে উন্মুক্ত পদ্ধতি করতে হলে খনি এলাকায় ২৮ বর্গকিলোমিটারের মতো জায়গা ৩০ বছরের জন্য অকেজো হয়ে যাবে। পরিবেশের বিষয়টা অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে। পাশাপাশি অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার বিষয়টাও ভাবতে হবে। তবে পুনর্বাসন প্রক্রিয়া ভালোভাবে সম্পন্ন হলে ক্ষয়ক্ষতিও কম হবে।
তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ, বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সাবেক সদস্য সচিব ও বর্তমান সদস্য অধ্যাপক এমএম আকাশ বলেন, ফুলবাড়িতে আন্দোলনে হতাহতের পর সরকারের সঙ্গে আমাদের কমিটির একটি চুক্তি হয়েছিল। তাতে বলা হয়েছিল, ফুলবাড়িতে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তোলা যাবে না এবং এশিয়া এনার্জিকেও কাজ দেয়া হবে না।
বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) সাবেক সভাপতি আনিসুল হক বলেন, কয়লা ব্যবহার করে দীর্ঘস্থায়ী অবকাঠামো চালানো সম্ভব। কিন্তু আমাদের যথেষ্ট কয়লা মজুদ থাকার পরও এ সম্পদ ব্যবহার করতে পারছি না। সারা পৃথিবীতে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন করা হচ্ছে। এ পদ্ধতিতে আমরা যদি বেশি কয়লা পাই এবং অর্থনৈতিক উন্নতি ত্বরানি�ত হয় তাহলে সমস্যা কোথায়।
আনিসুল হক আরো বলেন, ভূগর্ভস্থ পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন করলেও মানুষের পুনর্বাসন করতে হবে। তাহলে উন্মুক্ত পদ্ধতির সমস্যা কি?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির এই অধ্যাপক বলেন, তখনকার বিরোধীদলীয় নেতা এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও ওই চুক্তির পক্ষে মত দিয়েছিলেন। সুতরাং চুক্তি থেকে সরে আসার কোন সুযোগ নেই। এরইমধ্যে গত ২৭ জুন বেসরকারি খাতে আমদানি করা কয়লাভিত্তিক এক হাজার ৮৮ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার তিনটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের চুক্তি করে সরকার। এর আগে গত ২৯ জানুয়ারি বাগেরহাটের রামপালে সুন্দরবনের কাছে এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে ভারতের সঙ্গে চুক্তি হয়।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রতিষ্ঠান এশিয়া এনার্জির সঙ্গে সরকারের চুক্তির পর বহুজাতিক এ প্রতিষ্ঠানটি ২০০৫ সালে ফুলবাড়ি থেকে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তোলার প্রস্তাব দেয়। এরপর ২০০৬ সালে ফুলবাড়িতে এশিয়া এনার্জি ও উন্মুক্ত পদ্ধতির বিরুদ্ধে বিক্ষোভে নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে স্থানীয় কয়েকজন নিহত হওয়ার পর সেখান থেকে চলে আসে প্রতিষ্ঠানটি।
পরিবেশের ক্ষয়ক্ষতি এবং ঘরবাড়ি হারানোর কারণ দেখিয়ে ফুলবাড়িতে আন্দোলন এখনো চলছে।
এই প্রেক্ষাপটে গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে ফুলবাড়ি কয়লা খনি �উপযুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন, আর্থ সামাজিক উন্নয়ন, পানি ব্যবস্থাপনা ও পরিবেশ ইস্যুর বিষয়ে মতামত দেওয়ার জন্য বিশেষজ্ঞ কমিটি� গঠন করে সরকার।
কমিটি প্রধান মনে করছেন, ফুলবাড়ি এবং বড়পুকুরিয়ার উত্তর অংশে উন্মুক্ত পদ্ধতি করা গেলেও অন্য তিনটি খনি খালাশপীর, দীঘিপাড়া ও জামালগঞ্জে ভূগর্ভস্থ পদ্ধতিতেই কয়লা তুলতে হবে।
তেল-গ্যাস, রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য জোনায়েদ সাকী বলেন, ফুলবাড়িতে মাটির স্তর ও পানির স্্েরাত এমন অবস্থায় রয়েছে যে, সেখানে উন্মুক্ত পদ্ধতি করা সম্ভব নয়। এর বিরুদ্ধে জনগণ আন্দোলন করেছে।