বিশ্ব ইজতেমা ময়দান, টঙ্গী থেকে: রোববার আখেরি মোনাজাত ও হেদায়তি বয়ানের মধ্য দিয়ে শেষ হচ্ছে এবারের বিশ্ব ইজতেমার তিন দিনের প্রথম দফা।
ইজতেমার দ্বিতীয় দিন শনিবার গোটা টঙ্গী শহর জনসমুদ্রে পরিণত হয়। যতদূর চোখ যায় শুধু মানষ আর মানুষ। টঙ্গীর তুরাগ তীরে বিশ্ব ইজতেমায় আগত লাখ লাখ মুসল্লির পদভারে মুখরিত হয়ে উঠেছে। শিল্পনগরী টঙ্গী এখন যেন ধর্মীয় নগরীতে পরিণত হয়েছে। শনিবার টঙ্গী অভিমুখী বাস, ট্রাক, ট্রেন, লঞ্চসহ বিভিন্ন যানবাহনে মানুষের উপচেপড়া ভীড় ছিল। রোববার আখেরি মোনাজাতের আগ পর্যন্ত মানুষের এ ঢল অব্যাহত থাকবে। ইতিমধ্যে ইজতেমা ময়দান পূর্ণ হয়ে গেছে। মূল প্যান্ডেলে স্থান না পেয়ে অনেক মুসল্লি নিজ উদ্যোগেই প্যান্ডেলের বাইরে পলিথিন ও কাপড়ের সামিয়ানা টানিয়ে অবস্থান নিয়েছেন।
বিদেশি নিবাসের পূর্বপাশে বিশেষ মোনাজাত মঞ্চ থেকেই রোববার বেলা ১২টা থেকে সাড়ে ১২টার মধ্যে শুরু হবে আখেরি মোনাজাত। এর আগে অনুষ্ঠিত হবে হেদায়তি বয়ান। হেদায়তি বয়ান করবেন ভারতের মাওলানা সাদ এবং দোয়া পরিচালনা করবেন একই দেশের প্রখ্যাত আলেম ও বিশ্ব তাবলিগ জামায়াতের শীর্ষ মুরব্বি মাওলানা জোবায়েরুল হাসান। জোবায়েরুল হাসান হলেন তাবলিগের সাবেক বিশ্ব আমির মাওলানা এনামুল হাসানের ছেলে।
মোনাজাতে অংশ নেবেন রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও, বিরোধীদলীয় নেত্রী
দোয়া মঞ্চের পাশে রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান, বাটা সু ফাক্টরির ছাদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং হোন্ডা (এটলাস) কারখানার ছাদে বিশেষভাবে তৈরি মঞ্চে বসে বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া আখেরি মোনাজাতে অংশ নেয়ার কথা রয়েছে বলে জানিয়েছেন গাজীপুরের পুলিশ সুপার মোঃ আবদুল বাতেন। তবে মুসল্লিদের ভিড় বেশি হলে প্রধানমন্ত্রী তুরাগ নদীর অপর পাড়ে উত্তরা এলাকায় অবস্থান নিয়ে মোনাজাতে অংশ নেবেন।
আরও ৩ জনের মৃত্যু
বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় দিনে আরও তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। তারা হলেন কুষ্টিয়ার আলিমুজ্জামান (৫৫), দিনাজপুরে সামসুল আলম (৬০) ও বরিশালের আঃ মজিদ (৬০)।
যৌতুক বিহীন বিয়ে
শনিবার বিশ্ব ইজতেমার অন্যতম আকর্ষণ ছিল যৌতুকবিহীন বিয়ে। সম্পূর্ণ শরিয়ত মেনে তাবলিগের রেওয়াজ অনুযায়ী ইজতেমার দ্বিতীয় দিন (শনিবার) আসরের নামাজের পর ইজতেমার বয়ান মঞ্চের পাশেই বসে যৌতুকবিহীন বিয়ের আসর। কনের সম্মতিতে বর ও উভয়পক্ষের লোকজনের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত হয় ওই বিয়ে। এদিন সকাল থেকেই অভিভাবকরা দম্পতিদের নাম তালিকাভুক্ত করান। বিয়ের পর বয়ান মঞ্চ থেকে মোনাজাতের মাধ্যমে নব দম্পতিদের সুখ-সমৃদ্ধিময় জীবন কামনা করা হয় এবং মঞ্চের আশেপাশের মুসল্লিদের মাঝে খোরমা-খেজুর ছুঁড়ে দেওয়া হয়। ইজতেমার প্রথম দফার দ্বিতীয় দিন শনিবার আসর নামাজের আগে ওই যৌতুকবিহীন বিয়ের জন্য ১০৪টি বিয়ে তালিকাভুক্ত হয়। বিয়েতে মোহরানা ধার্য করা হয় ‘মোহরে ফাতেমি’র নিয়ম অনুযায়ী। এ নিয়ম অনুযায়ী মোহরানার পরিমাণ ধরা হয় দেড়শ তোলা রুপা বা উহার সমমূল্য অর্থ (এক লাখ পাঁচ হাজার টাকা)।
শনিবার যারা বয়ান করলেন
নির্ধারিত কর্মসূচি অনুযায়ী শনিবার বাদ ফজর থেকে সাধারণ মুসল্লিদের উদ্দেশে বয়ান শুরু হয় এবং তা চলে সকাল ১০টা পর্যন্ত। শনিবার বাদ ফজর বয়ান করেন পাকিস্তানের মাওলানা এহসান। বাদ জোহর বয়ান করেন বাংলাদেশের মাওলানা নুরুল হক। বাদ আসর বয়ান করবেন ভারতের মাওলানা জোবায়েরুল হাসান। বাদ মাগরিব বয়ানে অংশ নেন ভারতের আহম্মেদ লাট।
টঙ্গীবাসীর ঘরে ঘরে ইজতেমার মেহমান
টঙ্গীবাসীর ঘরে ঘরে এখন ইজতেমার মেহমান। বিভিন্ন সময় দাওয়াত দিয়েও যাদের আনা সম্ভব হয় না, তাদের অনেকেই আখেরি মোনাজাতে অংশ নিতে এসে টঙ্গীতে আত্মীয়ের বাসায় উঠেছেন।
সাংবাদিকদের ওপর মুসল্লিদের কড়া নজরদারি
বিশ্ব ইজতেমার খবর ও ছবি নিতে এসে সাংবাদিকরা অনেকেই হয়রানির শিকার হন। কারণ ইজতেমার মুরব্বিদের মাঠের মুসল্লিদের ছবি ওঠানোয় নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। শুধু তাই নয় কারও সঙ্গে ক্যামেরা থাকলে তাদের কৌশলে ইজতেমাস্থলে বসিয়ে রাখা হয় অথবা তাদের ক্যামেরাটি নিয়ে নেওয়া হয়। এছাড়া তারা ইজতেমাসংক্রান্ত কোনো তথ্য দিতেও তারা নারাজ।
তাশকিলের কামরায় চিল্লাভুক্ত মুসল্লি
ইজতেমার প্যান্ডেলের উত্তর-পশ্চিমে তাশকিলের কামরা স্থাপন করা হয়েছে। বিভিন্ন খিত্তা থেকে বিভিন্ন মেয়াদে চিল্লায় অংশ নিতে ইচ্ছুক মুসল্লিদের এ কামরায় আনা হচ্ছে এবং তালিকাভুক্ত করা হচ্ছে। পরে কাকরাইলের মসজিদের তাবলিগি মুরব্বিদের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এলাকা ভাগ করে তাদের দেশের বিভিন্ন এলাকায় তাবলিগি কাজে পাঠনো হবে।
নারীদের ভিড়
বিশ্ব ইজতেমায় নারীদের অংশগ্রহণ ও অবস্থানের কোনো সুযোগ নেই। ইজতেমাস্থলে আসার ব্যাপারে আয়োজক কর্তৃপক্ষের নিষেধ রয়েছে। তারপরও ইজতেমা মাঠের বাইরে স্থানে স্থানে বিভিন্ন স্থান থেকে এসে নারীদের জটলা করতে দেখা গেছে।
হাসপাতালে ভর্তি
টঙ্গী হাসপাতালে শনিবার বিকেল চারটা পর্যন্ত মোট ১৯০ জন মুসল্লি চিকিৎসা নিয়েছেন। অ্যাজমা ও পেটের পীড়াসহ বিভিন্নরোগে আক্রান্ত ৩২ জন মুসল্লি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এবং ১১ জনকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন হাসপাতালের জরুরি বিভাগ।
বিশ্ব ইজতেমায় গাড়ি পার্কিং ব্যবস্থা
১৩ থেকে ১৫ জানুয়ারি ও ২০ থেকে ২২ জানুয়ারি পর্যন্ত দুপর্বের ইজতেমা উপলক্ষে মুসল্লিদের নিরাপদ যাতায়াত ও সুষ্ঠুভাবে যানবাহন চলাচলের জন্য ১৪ জানুয়ারি সন্ধ্যা ছয়টা হতে ১৫ জানুয়ারি সন্ধ্যা ছয়টা এবং ২১ জানুয়ারি সন্ধ্যা ছয়টা থেকে ২২ জানুয়ারি সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত টঙ্গী ও এর আশেপাশের এলাকায় গাড়ি পার্কিং করতে ঢাকা মহানগর পুলিশ ঢাকা ও গাজীপুর জেলা পুলিশ ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে নিম্নোক্ত ব্যবস্থা নিয়েছে:
উল্লিখিত সময়ে ধৌর ব্রিজ থেকে আব্দুল্লাহপুর হয়ে প্রগতি সরণি এবং টঙ্গী ব্রিজ থেকে গাজীপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত (বিমানযাত্রী, ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ও অ্যাম্বুলেন্স ব্যাতিত) সব যানবাহন বন্ধ থাকবে।
ঘোড়াশাল থেকে পুবাইল-কালীগঞ্জ হয়ে আগত যানবাহন টঙ্গী রেলওয়ে স্টেশনের পূর্বে মরকুন (কে-২) পর্যন্ত চলাচল করতে পারবে। ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক থেকে ঘোড়াশাল হয়ে ঢাকাগামী যানবাহন কাচপুর/যাত্রাবাড়ী সড়ক ব্যবহার করবে।
ইজতেমায় গমনেচ্ছুক মুসল্লি, উত্তরার অধিবাসী, বিমানযাত্রী, ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি, অ্যাম্বুলেন্স ছাড়া অন্য সব যানবাহনের চালকদের বিমানবন্দর সড়কের পরিবর্তে মিরপুর-সাভার সড়ক ব্যবহার করতে বলা হয়েছে।
ঢাকা মহনগরের যেসব মুসল্লি পায়ে হেটে ইজতেমা স্থলে যাবেন তাদের শাহজালাল বিমানবন্দর গোলচত্বর আজমপুর-আব্দুল্লাহপুর হয়ে টঙ্গী ব্রিজ পরিহার করে তুরাগ নদীর ওপর নির্মিত বেইলি ব্রিজ অথবা কামারপাড়া ব্রিজ ব্যবহার করতে হবে।
মুসল্লিদের গাড়ি পার্কিং স্থান
ঢাকা মহানগর এলাকা: সাধারণ পার্কিং-১, নিকুঞ্জ-১ আবাসিক এলাকার খালি জায়গা। সাধারণ পার্কিং-২, উত্তরা ৬নং সেক্টর ও রাজউক কলেজের আশেপাশের খালি জায়গা। এছাড়া সিলেট বিভাগ পার্কিং উত্তরা ১২ নং সেক্টর, বরিশাল বিভাগ পার্কিং ধৌর ব্রিজ ক্রসিং সংলগ্ন এলাকা, ঢাকা বিভাগ পার্কিং সোনারগাঁও সড়ক ও জনপথ সড়কের পূর্ব থেকে পশ্চিম প্রান্ত, খুলনা বিভাগ পার্কিং উত্তরা ১০ ও ১১ নং সেক্টর সড়কের উভয় পাশে, রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের পার্কিং উত্তরা ১০ নং সেক্টরের খালি জায়গা এবং কামারপাড়া হাউজিং মাঠ, চট্রগ্রাম বিভাগ পার্কিং উত্তরা ১৩ নং সেক্টরের গাউছুল আজম ও গরীবে নেওয়াজ রোডের উভয় পাশে এবং বরিশাল ও খুলনা বিভাগের গাড়ি উত্তরা ১৮ নং সেক্টরের খালি জায়গায় পার্কিং করা হবে।
গাজীপুর জেলা: টঙ্গীর কে-২/নেভী সিগারেট কারখানা সংলগ্ন এলাকা, কাদেরিয়া টেক্সটাইল মিলের প্রাঙ্গণ ও সংলগ্ন এলাকা, মেঘনা টেক্সটাইল মিল সংলগ্ন রাস্তার উভয় পাশে, শফিউদ্দিন সরকার একাডেমি মাঠ, গাজীপুর সদরে চান্দনা চৌরাস্তা ট্রাক টার্মিনাল, চান্দনা হাই স্কুল মাঠ, ভাওয়াল বদরে আলম কলেজের মাঠ।
ঢাকা জেলা: আশুলিয়া কলেজ এবং আশুলিয়া স্কুল মাঠ।
ভ্রাম্যমাণ আদালত
ভেজাল খাবার পরিবেশনের অভিযোগে এই পর্যন্ত ৪২ হাজার চারশ টাকা জরিমানা আদায় ও ২৮টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। তিনটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে তৌহিদ বিন হাসান, শহিদুজ্জামান ও শামসুল হক ভ্রাম্যমাণ আদালতগুলো পরিচালনা করেন।