ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত অসাধু কর্মকর্তাদের সঙ্গে গোপনে আপোস মীমাংসা করতে যাচ্ছে ইউনাইটেড কমার্সিয়াল ব্যাংক লিমিটেড (ইউসিবিএল)।
একই সঙ্গে কার্ড জালিয়াতি চক্রের এসব অসাধু ও দুষ্কৃতকারী কর্মকর্তাদের ব্যাংকের চাকরিতে পুনর্বহাল করতে চাচ্ছে ব্যাংকটি।
ব্যাংকটি ক্রেডিট কার্ড ব্যবসায় টিকে থাকতে এটি করতে চাচ্ছে বলে জানা গেছে। উপেক্ষিত থাকছে ক্রেডিট কার্ড গ্রাহকদের স্বার্থ।
ইউনাইটেড কমার্সিয়াল ব্যাংক এবং মামলার তদন্তের দায়িত্বে নিয়োজিত গোয়েন্দা পুলিশের একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্র ব্যাংকের এই আপোস মীমাংসার উদ্যোগের বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। চক্রটি জালিয়াতির মাধ্যমে সাড়ে দশ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। যা দেশের ব্যাংকিং ইতিহাসে প্রকাশিত সবচেয়ে বড় ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতি।
এদিকে. অপরাধ করার পরও শাস্তি না দিয়ে উল্টো তাদের চাকরিতে পুনর্বহাল করা হলে ভবিষ্যতে আরো বড় ধরনের জালিয়াতির ঘটনা ঘটাতে পারে এই চক্রটি। গ্রাহকদের উৎকণ্ঠা নিয়ে কার্ড ব্যবহার করতে হবে।
সূত্র বলছে, আপোস মীমাংসার বিষয়টি আদালতে উপস্থাপন করে কার্ড জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত চার আসামির তিনজন এরইমধ্যে জামিন পেয়েছেন। এরা হলেন ব্যাংকের কার্ড বিভাগের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ফারুক হায়দার, শহীদুল ইসলাম ও নির্বাহী কর্মকর্তা জাহিদ হোসেন ঠাকুর। তবে এখনো জেল হাজতে রয়েছেন ব্যাংকের সহকারী ভাইস প্রেসিডেন্ট নাহিদুল হক।
এদিকে মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, গোয়েন্দা পুলিশের কাছে জিজ্ঞাসাবাদে অভিযুক্ত চার কর্মকর্তা কার্ড জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়টি স্বীকার করেছেন। ইউনাইটেড কমার্সিয়াল ব্যাংকের কার্ড বিভাগের প্রধানও এর সঙ্গে জড়িত বলে গোয়েন্দা পুলিশকে তথ্য দিয়েছেন তারা। তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ব্যাংকের কার্ড বিভাগের প্রধান শাহাদত হোসেনকে আটক করে গোয়েন্দা পুলিশ। পরে তাকে মামলায় অভিযুক্ত করে গ্রেফতার দেখানো হয়। তিনিও এখন জেল হাজতে রয়েছেন।
জানা গেছে, গত জুলাই মাসের শুরুর দিকে গুলশান থানাপুলিশ ব্যাংকের দায়ের করা মামলাগুলো মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের কাছে ন্যস্ত করে। এরপর সাড়ে দশ কোটি টাকার এই কার্ড জালিয়াতির ঘটনাটি তদন্ত করছে গোয়েন্দা পুলিশ।
জালিয়তির সঙ্গে জড়িত ব্যাংক কর্মকর্তারা তদন্ত কর্মকর্তাদের কাছে দায় স্বীকার করে নিয়ে জানান, তারা ২০০৭ সালে এ জালিয়াতি শুরু করেন। ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ড গ্রাহকদের কাছ থেকে সাড়ে ৫ বছরে তারা পর্যায়ক্রমে এই পরিমাণ অর্থ জালিয়াতি করে। আর এজন্য তারা ২০ জন গ্রাহকের কার্ড বেছে নিয়েছিলো।
তদন্ত সূত্রে জানা গেছে, ব্যাংকের কার্ড নেওয়া এই গ্রাহকরা হলেন, গোলাম দস্তগীর, ফকরুজ্জামান মৃধা, এসএম আহসান, সাইফুজ্জামান, নাহিদুল ইসলাম, মাহবুবুল ইসলাম, শাহীদুল ইসলাম, ওয়াহিদুল হক, সাব্বীর হোসেন, মারুফ হায়দার, আনোয়ার শামীম, লিটন তালুকদার, শামীমা সুলতানা, এবিএম ফজলুল, এসএস আহমেদ, জিএম আজাদ, মুশফিকুল সালেহীন, মোরশেদ তুহিন এবং ফারজানা চৌধুরি। তবে কোন গ্রাহকের কার্ড থেকে কত টাকা হাতিয়ে নিয়েছে চক্রটি তার হিসাব পাওয়া যায়নি।
সূত্র জানায়, কার্ড জালিয়াতির সঙ্গে কার্ড বিভাগের প্রধান থেকে শুরু করে এর শীর্ষ ৫ কর্মকর্তার সবাই জড়িত। তাই বিষয়টি প্রকাশ পায়নি। তাছাড়া ব্যাংককে তারা কার্ড বিভাগ থেকে মুনাফাও দেখাতো মোটা অংকের। ফলে ব্যাংক সন্তুষ্ট ছিলো তাদের প্রতি। আর এই সুযোগে তারা জালিয়াতি শুরু করে গ্রাহকদের সঙ্গে।
সূত্র জানায়, চক্রটি ব্যাংকের গ্রাহকদের কাছ থেকে কার্ডের টাকা পরিশোধের নামে অর্থ সংগ্রহ করলেও তা ব্যাংকে জমা না দিয়ে গ্রাহককে ভূয়া জমা ভাউচার দিতো। প্রযুক্তি ব্যবহার করে গ্রাহকের কার্ড সচল রেখেছে এ চক্র।
ব্যাংকের একটি সূত্র জানায়, জালিয়াতি চক্রের সঙ্গে আপোসের বিষয়টি প্রায় চূড়ান্ত করে ফেলেছে ব্যাংক। হাতিয়ে নেওয়া অর্থ পরিশোধের শর্তে তাদের চাকরিতে বহাল রাখার জন্য উদ্যোগ নিচ্ছে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। ঠিক একই তথ্য জানা গেছে তদন্ত কর্মকর্তাদের কাছ থেকেও।
জানা গেছে, এ মর্মে তদন্তে চুড়ান্ত প্রতিবেদন দিতে তদন্ত কর্মকর্তাদের নানাভাবে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে ব্যাংক।
প্রসঙ্গত, জালিয়াতির মাধ্যমে সাড়ে দশ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার বিষয়টি নজরে আসায় চলতি বছরের জুন মাসের ৪ তারিখ ইউসিবির উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আবু আব্দুল্লাহ এবং সরদার আকতার হামিদ বাদী হয়ে গুলশান থাকায় তিনটি পৃথক মামলা করেন। এতে ব্যাংকের কার্ড বিভাগের চারজনকে আসামি করা হয়। তার একমাস পরে মামলাটি গোয়েন্দা পুলিশের কাছে দেওয়া হয় তদন্তের জন্য।
ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতি চক্রের সাথে আপোস মীমাংসা এবং জড়িত কর্মকর্তাদের চাকরিতে বহাল রাখার বিষয়ে ব্যাংকের বক্তব্য জানতে দুইদিন ধরে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম শহিদুল ইসলামের দপ্তরে ফোন করে তার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।
এক পর্যায়ে তিনি তার ব্যক্তিগত কর্মকর্তাদের মাধ্যমে প্রতিবেদককে এ ব্যাপারে সরাসরি ব্যাংকে এসে কথা বলতে বলেন।