বুধবার মধ্যরাতে আকস্মিক ঝড়ে দেশের উপকূলীয় অঞ্চল লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে। ঘরবাড়ি, গাছপালা উপড়ে গেছে। ঝড়ের কবলে বৃহস্পতিবার দুপুর পর্যন্ত ২২ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে স্থানীয় প্রশাসন। এছাড়া অসংখ্য জেলে নিখোঁজ রয়েছে।
ঘূর্ণিঝড়কবলিত লোকজন ও প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, আবহাওয়ার পূর্বাভাস না থাকায় শত শত ট্রলারে করে জেলেরা মেঘনা নদীতে নির্বিঘ্নে মাছ ধরার কাজ করছিলেন। এসময় বুধবার দিনগত রাত ১টার দিকে ঘূর্ণিঝড় আকস্মিকভাবে লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে যায় পুরো উপকূলীয় অঞ্চল। ট্রলারগুলোয় থাকা বহু জেলের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।
স্থানীয় প্রশাসন জানিয়েছে, নোয়াখালীর হাতিয়া, সুবর্ণচরে ও কোম্পানীগঞ্জ ১৩ জন ও ভোলার মনপুরা, চরফ্যাশনসহ কয়েকটি স্থানে পাঁচজন, চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ ও মিরসরাইয়ে চারজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।
নোয়াখালীতে ১৩ জনের প্রাণহানি
হাতিয়া, সুবর্ণচর ও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় ১৩ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত হওয়া গেছে। নিহতদের মধ্যে আছে হাতিয়ার জাহাজমারা ইউনিয়নের চরহেয়ার গ্রামের নাজিম উদ্দিনের মেয়ে সীমা আক্তার (১২) ও ছেলে মামুন উদ্দিন (৮), তমরুদ্দি ইউনিয়নের দাসপাড়া গ্রামের বজেন্দ্র কুমার দাসের স্ত্রী রাজেশ্বী বালা দাস (৪৫) ও জেলে বজ লাল মাঝি (৫৫), সুবর্ণচর উপজেলার মহম্মদপুর ইউনিয়নের চরকনক গ্রামের নুরজাহান (৫৫) ও তার মেয়ে শারমিন আক্তার (১০) এবং কোম্পানীগঞ্জের চর এলাহী ইউনিয়নের গাংচিল গ্রামের সামছুল আলমের ছেলে আমির হোসেন (৩৭), একই গ্রামের জামাল মাঝির ছেলে বাবুল মিয়া (২০), নুরুল আলমের ছেলে নুর ইসলাম (৪৫) ও রিয়াজ (২৪)। তিনজনের পরিচয় পাওয়া যায়নি।
হাতিয়ার বুড়িরচর ইউনিয়নের মেঘনা নদী থেকে ৩০ থেকে ৪০টি মাছধরা ট্রলার নিখোঁজ হয়েছে। প্রতিটি ট্রলারে ১০ থেকে ১২ জন মাঝি রয়েছে। এটি নিশ্চিত করেছেন বুড়িরচর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জিয়া আলী মোবারক কল্লোল।
হাতিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাহেদুর রহমান ও সুবর্ণচর ইউএনও খালিদ মেহেদী হাসান নিজ নিজ উপজেলার মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করে জানান, ঘূণিঝড়ে দুটি উপজেলার দুই সহস্রাধিক বাড়ি-ঘর বিধ্বস্ত হয়েছে।
স্থানীয় ও প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, হাজার হাজার গাছ উপড়ে পড়ায় উদ্ধারকাজ মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে। হাতিয়া থেকে মেঘনায় শত শত ট্রলার নিয়ে মাছ ধরতে যাওয়া জেলেরা কূলে ফিরে আসেনি।
বিভিন্ন জায়গা থেকে নিহত ও নিখোঁজ লোকজনের খবর আসছে। জেলে পল্লীগুলোয় চলছে শোকের মাতম। একদিকে তাদের বসতবাড়ি ধ্বংস হয়েছে, অন্যদিকে মাছ শিকারে ব্যস্ত স্বজনরা নিখোঁজ রয়েছে।
কোম্পানীগঞ্জের চরএলাহীর মেঘনা নদীর শাখা বামনীয়া নদীতে মাছ ধরার সময় বয়ে যাওয়া ঝড়ে বামনীয়া নদী থেকে একটি মাছধরা ট্রলার ও এতে থাকা ১০/১২ জন জেলে নিখোঁজ হয়। এ ঘটনায় কয়েকজন জেলে সাঁতরে পাড়ে উঠলেও বৃহস্পতিবার দুপুর দেড়টার দিকে চরএলাহী ইউনিয়নের বামনীয়া নদীতে চারজনের ভাসমান লাশ পাওয়া যায়।
কোম্পানীগঞ্জ ইউএনও আবদুল আউয়াল বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, জেলা প্রশাসকের ত্রাণ তহবিল থেকে তাৎক্ষণিকভাবে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য নগদ ৪০ হাজার টাকা, গৃহ-নির্মাণ বাবদ এক লাখ টাকা ও ১৫ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
ভোলায় নিহত ৫
নিহত পাঁচজনের মধ্যে আছেন মনপুরার জেলে শাহে আলম (৩০) ও আবদুল খালেক (৩৫) ও চরফ্যাশনের আমেনা বেগম (৩২)। অন্য দুইজনের পরিচয় পাওয়া যায়নি।
এছাড়া বেলায়েত, জসিম, নীরব, মালেক, হেজু, খালেক, জলিল ও খোরশেদ নিখোঁজ রয়েছে বলে জানা গেছে।
মনপুরা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নরেশ কর্মকার জানান, মনপুরায় নিহত তিনজনের মধ্যে মেঘনা নদীর মনপুরার হাজির হাট এলাকা থেকে শাহে আলম ও দাসের হাট এলাকা থেকে আবদুল খালেকের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। ঘরচাপায় অপরজনের মৃত্যু হয়েছে।
চরফ্যাশনের ঢালচর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান কালাম পাটোয়ারী জানান, রাত দেড়টার দিকে মনপুরা ও চরফ্যাশনে ঝড় শুরু হয়। ভোর পর্যন্ত থেমে থেমে বয়ে যাওয়া প্রচণ্ড ঝড়ে চরফ্যাশনের চর কুকরি-মুকরি, ঢালচর, চরপাতিলা ও মনপুরা উপজেলার হাজিরহাট ও দাসেরহাটসহ বেশ কিছু এলাকার আট শতাধিক কাঁচা-পাকা ঘড়-বাড়ি বিধ্বস্ত হয়। ঢালচরে ঘরচাপা পড়ে আমেনা বেগম নামের এক নারী নিহত হয়েছেন।
এদিকে, ভোরের দিকে মনপুরা-তজুমদ্দিন রুটের সরকারি সি ট্রাক ও সারবাহী একটি ট্রলার ডুবে যায় বলে খবর পাওয়া গেছে।
চট্টগ্রামে নিহত ৪, ক্ষয়ক্ষতি
ঘূর্ণিঝড়সহ দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় চট্টগ্রামে মোট চারজনের প্রাণহানির খবর পাওয়া গেছে। এর মধ্যে উপকূলীয় এলাকা সন্দ্বীপ উপজেলায় দুই নারী সহ তিনজন নিহত হয়েছেন। মিরসরাইয়ে নিহত হয়েছেন আরও একজন।
এছাড়া সন্দ্বীপ, ফটিকছড়ি, হাটহাজারী, মিরসরাই, সীতাকুন্ড, বাঁশখালীসহ চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলায় গাছপালা, ঘরবাড়ি ভেঙ্গে এবং ফসলি জমি ও পানের বরজের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া গেছে।
চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক জয়নুল বারী বাংলানিউজকে বলেন, “বিকেল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত আমরা চারজনের মৃত্যুর খবর পেয়েছি। বিভিন্ন উপজেলা থেকে আমরা ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে খোঁজখবর নিচ্ছি।”
লক্ষ্মীপুরে জেলে নিখোঁজ
লক্ষ্মীপুরের রামগতি উপজেলায় মেঘনা নদীতে বুধবার রাতের ঝড়ে মাছ ধরার ২০টি ট্রলার ও ৫ জেলে নিখোঁজ হয়েছে।
রামগতির চরগাজী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মীর আক্তার হোসেন বাচ্চু জানান, মেঘনায় মাছ ধরতে গিয়ে রাতের ঝড়ে চরগাজী এলাকার মাছ ধরা ৩০টি ট্রলার নিয়ে প্রায় ৫০ জন জেলে নিখোঁজ হয়। পরে বৃহস্পতিবার দুপুর পর্যন্ত নোয়াখালীর হাতিয়া, লক্ষ্মীপুরের বয়ারচর ও চর গজারিয়ায় কিছু ট্রলারসহ অনেক জেলেই ফিরে এসেছে।
তবে দুপুর দেড়টা পর্যন্ত চর গজারিয়ার মাছ ধরা ২০টি ট্রলারসহ বেলাল মাঝি, শাহাবুদ্দিন মাঝি, কাদের মাঝি, শহীদ মাঝি ও আব্দুর রহমান মাঝির কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।
দুপুর ২টায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত নিখোঁজ জেলেদের খোঁজে নৌকা ও ট্রলারে করে মাইকিং করা হচ্ছিল।
ফেনীতে লণ্ডভণ্ড ঘরবাড়ি
বৃহস্পতিবার ভোর ৫টার দিকে প্রচণ্ড ঘূর্ণিঝড়ে ফেনীতেও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। আধা ঘণ্টাব্যাপী ঘূর্ণিঝড়ে শত শত গাছপালা উপড়ে রাস্তা ও বসতঘরের উপর পড়েছে। এতে জেলার বিভিন্ন স্থানে প্রায় শতাধিক বাড়ি-ঘর বিধ্বস্ত হয়েছে।
এদিকে, ঘূর্ণিঝড়ে রাস্তার পাশের বেশকিছু গাছ উপড়ে পড়ায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ও ফেনী-মাইজদী সড়কে ভোর ৫টা থেকে দুই ঘণ্টা যানবাহন চলাচল বন্ধ ছিল। পরে ট্রাফিক ও হাইওয়ে পুলিশের সহযোগিতায় গাছ কেটে রাস্তা থেকে সরানোর পর যান চলাচল স্বাভাবিক হয়।
ফেনী পুলিশের ট্রাফিক ইন্সপেক্টর সাইদুর রহমান খান বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
এছাড়া জেলার বিভিন্ন স্থানে গাছ পড়ে বিদ্যুৎ লাইন ছিড়ে যাওয়ায় ভোর থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত জেলার অধিকাংশ জায়গায় বিদ্যুৎ ছিল না।
দুপুর ২টায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত ঘূর্ণিঝড়ে হতাহতের কোনো তথ্য জানাতে পারেনি প্রশাসন।