হজ বিশ্ব মুসলিমের মিলন ও সৌহার্দ্যের এক অবিস্মরণীয় উৎসব। মহান আল্লাহর কাছে এ এক গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। তিনি হজকে মানুষের ওপর নিজের অধিকার ও দায়িত্ব বলে উল্লেখ করেছেন।
আমাদের দেশ থেকে প্রতিবছর অজস্র মানুষ কাবার যিয়ারতে হজের উদ্দেশে রওনা হন এবং নির্দিষ্ট দিন শেষে তারা ফিরে আসেন। এ যাওয়া এবং আসা গতানুগতিক হলেও এর মধ্যে কিছু বিষয় রয়ে যাচ্ছে, যা গুরুত্ব ও অনুধাবনের দিক থেকে অসীম এবং অত্যন্ত তাৎপর্যবহুল।
হজ মানেই কি সাদা পোশাকে কাবা তওয়াফ আর মিনা-আরাফাত-মুযদালিফায় করা আমলগুলোর সমষ্টি? মোটেই তা নয়। হজের রয়েছে কিছু দাবি এবং বাস্তব প্রতিফলন, যা ছুটে গেলে কিংবা অপ্রকাশ্য থাকলে তা হজ হিসেবে আল্লাহর খাতায় গণ্য নয়।
সম্মানিত হাজীদের প্রতি বিনীত আরয, এ পুরো হজের সফরে আপনাকে আচার ব্যবহারে দারুণ সতর্ক এবং বিনয়ী হতেই হবে। নানা যন্ত্রণা ও অবহেলা কিংবা বিপর্যয় এলেও সদাহাস্য মুখে তা মেনে নিয়ে উৎসর্গিত হতে হবে পরম দয়াময়ের করুণাতলে।
রাসূল (সা.) তাগিদ দিয়ে বলে গেছেন, যে হজ করলো এবং কোনো রকম অশ্রাব্য আচরণ কিংবা অনাচার থেকে বিরত থাকলো, সে হজ থেকে তার সদ্যপ্রসূত নিষ্পাপ শিশুর মতো হয়ে ফিরে এলো। (বুখারী)
তাই নিছক কিছু আমল কিংবা হুকুম পালনের জন্য নয়, হজ আপনার আত্মিক ও বাহ্যিক সংশোধনের এক মূল্যবান প্রক্রিয়া। তবে এসবের পূর্ণ প্রতিক্রিয়া এবং ফলাফল অনুভবের জন্য আপনারও রয়েছে বেশ কিছু করণীয়।
খুব ভালোভাবে যাচাই বাছাই করে নিন, হজের পবিত্র সফরে রওনা হওয়ার আগে কারো কোনো দেনা আপনার কাঁধে নেই তো? কারো কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া কোনো সম্পত্তি কিংবা অন্যের অগোচরে অর্জিত কোনো বস্তু আপনার আওতায় নেই তো?
কোনো মুসলমান ভাইয়ের সঙ্গে আপনার অযথা মনোমালিন্য কিংবা সামান্য স্বার্থের কারণে অযাচিত দ্বন্দ্ব রয়ে গেলে তা সংশোধন করে নিন।
আল্লাহপাকের ডাকে সাড়া দিতে আপনি রওনা হচ্ছেন, কাজেই আপনার গায়ে যেন কোনো কলঙ্ক লেগে না থাকে, সে ব্যাপারে পূর্ণ সতর্ক ও সচেতন হোন।
লোক দেখানো লৌকিকতা কিংবা হাজী বা আলহাজ ডাক শোনার সামান্যতম বাসনা ও সামাজিক সম্মান ও প্রতিপত্তির সব লোভ ও কামনা মন থেকে ঝেড়ে ফেলুন।
হজের প্রথম শিক্ষা হলো মানুষে মানুষে সাম্য ও ভ্রাতৃত্ববোধ সৃষ্টি এবং সবার সঙ্গে সদাচারণের সুন্দর ব্যবহার প্রশিক্ষণ। ধৈর্য এবং নিয়মশৃঙ্খলার সঙ্গে জীবনযাপন এবং অন্তরে একনিষ্ঠ হয়ে আল্লাহর প্রতি আত্মসমর্পণ হজের অন্যতম প্রশিক্ষণ। হজের সূচনা দিনগুলো থেকে নিজের বাকি জীবন এসব রঙে রঙিন হয়ে থাকার জন্য পূর্ণ মানসিক শপথ ও প্রস্তুতির সাহস সঞ্চয় করুন এখন থেকে।
জীবনে আর কোনোদিন এ পবিত্র নগরী এবং কালো গিলাফাবৃত কাবা আপনার দু’নয়নে দেখা পাবে কিনা, জানা নেই। তাই হজের দিনগুলোতে এদিক ওদিক সময় নষ্ট না করে আল্লাহর ঘরের আশেপাশে থাকুন।
প্রাণভরে জীবনের সব চাওয়া পাওয়া আল্লাহকে খুলে বলুন। পরকালের সব সাফল্য ও পাপের মার্জনা কামনার এমন একান্ত সময় হেলায় যেন নষ্ট না হয়।
এভাবেই জীবন্ত হয়ে উঠবে আপনার হজ। নিছক ইহরাম বেঁধে তাওয়াফ ও গুটিকয়েক আমল শেষে কুরবানীর পশু জবাই করার নাম তো হজ নয়।
নিজের পরিপূর্ণ সংশোধন এবং আত্মার নতুন জাগরণ অর্জিত না হলে সেটি হয়ে যায় মক্কা ভ্রমণ।
হজের সবগুলো আমল সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিন ভালো আলেমের কাছ থেকে। বিভিন্ন স্থানে দোয়া করার ফযিলতসমূহ জেনে সে জায়গাগুলোতে নিজেকে সঁপে দিন পরম করুণাময়ের কাছে।
এভাবে নিজের বাহ্যিক আচার আচরণ এবং আত্মিক বিশ্বাস ও প্রতিফলনে একনিষ্ঠ হয়ে হালালভাবে অর্জিত অর্থে সবার সঙ্গে সদাচারণ করে আল্লাহর ঘরের দিকে আপনার যাত্রার সূচনা করতে পারলে অনুভূত হবে এক ধরণের নতুন স্বাদ ও অনুভব। হজের জন্য পাগলপারা হৃদয়ের তপ্ত তাড়নায় বিলীন হয়ে কতো আশেকীন আল্লাহর ঘরের দিকে ছুটে চলেছেন, আহা! সেসব পূর্বসুরীদের হজের বিবরণ পড়লে চোখের পানি আর হৃদয়ের উত্তাল ঢেউ আটকে রাখা কঠিন হয়ে যায়।
যে পরম মাওলার ডাকে সাড়া দিয়ে তার ঘরের মেহমান হচ্ছেন আপনি, তার বিশেষ রহমত ও ভালোবাসার উপস্থিতি তখন থেকেই আপনার হৃদয়ে সজীব জীবন্ত হয়ে উঠবে। তুচ্ছ মনে হবে সব ভোগবিলাস কিংবা ভ্রমণের যাবতীয় দুঃখ-যন্ত্রণা।
আপনার পবিত্র হজ বরকতময় ও কবুল হোক। (আমিন)