অস্ত্রসহ হলমার্কের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীর মাহমুদ ও জেনারেল ম্যানেজার (জিএম) তুষার আহমেদকে আটক করেছে র্যাব। মিরপুর ১০ থেকে রোববার রাত সোয়া ৯টায় তাদের গ্রেফতার করা হয় বলে জানা গেছে র্যাব সূত্রে।
আটকের পর প্রথম এ তথ্য নিশ্চিত করেন তানভীরের ব্যক্তিগত আইনজীবী ফৌজিয়া ইয়াসমিন মুক্তি।
রাত সাড়ে ৯টায় র্যাবের গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান লে. কর্নেল জিয়াউল আহসান এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধান টিমের সদস্যরাও বাংলানিউজকে আটকের বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
আটক হওয়ার সময় তানভীরের কাছ থেকে একটি পিস্তল ও চার রাউন্ড গুলি উদ্ধার করা হয় বলে জানা গেছে। তবে আটককৃত অস্ত্র বৈধ না অবৈধ সে ব্যাপারে কিছু এখনও নিশ্চিত হওয়া সম্ভব হয়নি।
র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক এম সোহায়েল জানান, তানভীরকে রমনা থানায় হস্তান্তরের প্রক্রিয়া চলছে।
আটক দুইজনকে সোমবার সকালে আদালতে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন করা হবে বলে জানান র্যাব-৪ এর এএসপি তানভীর।
উল্লেখ্য, ঋণ জালিয়াতির অভিযোগে গত বৃহস্পতিবার তানভীরসহ ২৭ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক।
মামলার এজাহারের উল্লেখ রয়েছে, ভূয়া এলসির মাধ্যমে সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা শাখা থেকে ফান্ডেড এক হাজার ৫৬৮ কোটি টাকা আত্মসাত করেছে হলমার্ক গ্রুপ। ব্যাংকটির কর্মকর্তাদের যোগসাজসে বিপুল
পরিমাণ টাকা আত্মসাৎ করে গ্রুপটি।
এক প্রতিক্রিয়ায় দুদক চেয়ারম্যান বলেন, “ব্যাংকি ইতিহাসে সবচেয়ে বড় কেলেঙ্কারি করেছে হলমার্ক গ্রুপ। আসামিদের যখন যেখানে পাওয়া যাবে সেখানেই গ্রেফতার করা হবে।“
তিনি বলেন, “মামলার পর থেকেই দুদক আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সহযোগিতায় গ্রেফতার অভিযান চালাচ্ছে।
“অন্য আসামিদেরও আইনের হাতে সোপর্দ করা হবে বলে“ মন্তব্য করেন তিনি।
হলমার্ক গ্রুপের যারা আসামি
গত বৃহস্পতিবার দুদকের হলমার্ক কেলেঙ্কারির ঘটনায় প্রথম পর্যায়ে যাদের আসামি করা হয়েছে তারা হচ্ছেন- হলমার্ক গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীর মাহমুদ ওরফে তফছীর, তানভীরের স্ত্রী ও গ্রুপের চেয়ারম্যান জেসমিন ইসলাম, তানভীরের ভায়রা ও গ্রুপের জেনারেল ম্যানেজার (কমার্শিয়াল) তুষার আহমেদ, হলমার্ক গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান আনোয়ারা স্পিনিং মিলসের স্বত্ত্বাধিকারী মো: জাহাঙ্গীর আলম, ম্যাক্স স্পিনিং মিলসের স্বত্ত্বাধিকারী মীর জাকারিয়া, সেঞ্চুরি ইন্টারন্যাশনালের স্বত্ত্বাধিকারী মো: জিয়াউর রহমান, এ্যাপারেল এন্টারপ্রাইজের সত্ত্বাধিকারী মো: শহিদুল ইসলাম।
রুপসী বাংলা শাখায় যাদের নামে মামলা
সোনালী ব্যাংক রুপসী বাংলা শাখায় (সাবেক শেরাটন শাখা) মোট পাঁচজনকে আসামি করা হয়েছে। এরা হলেন-রুপসী বাংলা শাখার সাবেক ব্যবস্থাপক ও ডিজিএম (সাময়িক বরখাস্ত) একেএম আজিজুর রহমান, সাবেক এজিএম মো: সাইফুল হাসান (সামায়িক বরখাস্ত), নির্বাহী কর্মকর্তা আবদুল মতিন (সাময়িক বরখাস্ত), অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র অফিসার মো: ওয়াহিদুজ্জামান ও সোনালী ব্যাংক ধানমন্ডি শাখার বর্তমান সিনিয়র নির্বাহী কর্মকর্তা মেহেরুন্নেসা মেরী। এদের মধ্যে মেহেরুন্নেসা মেরী রুপসী বাংলা শাখায় কর্মরত ছিলেন।
প্রধান কার্যালয়ের যারা আসামি
সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক হুমায়ূন কবিরসহ সোনালী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের জিএম অফিস, আইটিএফডি শাখা, অডিট ও ইন্সপেকশন-২, সিএডি, টিএমডি বিভাগে মোট ১৫ কর্মকর্তাকে আসামি করে মামলা দায়ের করা হয়েছে। অন্য আসামিরা হলেন-ডিএমডি মাঈনুল হক(ওএসডি) ও আতিকুর রহমান (ওএসডি)। জিএম আ.ন.ম মাশরুরুল হুদা সিরাজী, ননী গোপাল নাথ (ওএসডি), মীর মহিদুর রহমান (ওএসডি)ও সাবেক জিএম সবিতা সিরাজ। ডিজিএম ভগবতী মজুমদার (সাময়িক বরখাস্ত), শেখ আলতাফ হোসেন (সাময়িক বরখাস্ত), মো: সফিজউদ্দিন আহমেদ (সাময়িক বরখাস্ত) ও কানিজ ফাতেমা চৌধুরী। এজিএম মো: কামরুল হোসেন খান (সাময়িক বরখাস্ত), আশরাফ আলী পাটোয়ারী (সাময়িক বরখাস্ত), মো: আবুল হাসান ও মো: খুরশিদ আলম।
মামলার বাদী যারা
হলমার্ক কেলেঙ্কারির ঘটনায় দুদকের ৬ অনুসন্ধান কর্মকর্তা বাদী হয়ে মামলা দায়ের করেন। মামলার বাদীরা হলেন- দুদকের প্রধান অনুসন্ধান কর্মকর্তা ও জ্যেষ্ঠ উপ-পরিচালক মীর জয়নুল আবেদীন শিবলী, উপ-পরিচালক এস এম এম আখতার হামিদ ভুঞা, সহকারী পরিচালক মো: মশিউর রহমান, নাজমুচ্ছায়াদাত, উপ-সহকারী পরিচালক মো: মজিবুর রহমান, মো: জয়নুল আবদীন। ৬ সদস্যের এ অনুসন্ধান টিম হলমার্ক ও সোনালী ব্যাংক কর্মকর্তাদের নামে মামলা দায়ের করেন।
যে ধারায় মামলা
মামলার এজাহারে উল্লেখ রয়েছে, ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫ এর (২) ধারায় মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ২০১২-এর ৪(২) ধারায় এবং দণ্ডবিধির ৪০৬, ৪০৯,৪২০ এ ১১৯ ধারায় মামলাগুলো দায়ের করা হয়।
অনুসন্ধানকারী দলে পাঁচজন কর্মকর্তা দুটি করে দশটি এবং দুদকের অনুসন্ধান টিমের প্রধানের একটিসহ মোট এগারটি মামলা দায়ের করা হয়। রমনা মডেল থানায় মামলা নং ৮ থেকে ১৮।
আত্মসাতের ঘটনায় হলমার্কের ৭ এবং সোনালী ব্যাংকের ২০ ব্যক্তি জড়িত থাকার কথা উল্লেখ রয়েছে এজাহারে।
দুদকের অনুসন্ধান টিম রাতে জানায়, হলমার্ক কেলেঙ্কারিতে জড়িত দুদকের মামলার প্রায় সব আসামি বর্তমানে পলাতক রয়েছেন। দুদক র্যাবের সহযোগিতায় অভিযান অব্যাহত রেখেছে।
সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা হোটেল (সাবেক শেরাটন) শাখা থেকে হলমার্ক কর্তৃক আত্মসাৎকৃত ২ হাজার ৬৮৬ কোটি ১৪ লাখ টাকার মধ্যে যে পরিমাণ টাকা এরই মধ্যে স্বীকৃত বিলের বিপরীতে পরিশোধ করা হয়েছে (ফান্ডেড), সেই পরিমাণ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ অনুসন্ধানে প্রমাণিত হওয়ায় ২৭ ব্যক্তির নামে মামলা দায়ের করে দুদক।
জানা গেছে, রূপসী বাংলা শাখা থেকে হলমার্ক গ্রুপসহ ৬টি কোম্পানি আত্মসাৎ করেছে মোট ৩ হাজার ৫৪৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে হলমার্ক এককভাবে আত্মসাৎ করেছে ২ হাজার ৬৮৬ কোটি ১৪ লাখ টাকা।
রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের রুপসী বাংলা শাখা থেকে আড়াই হাজার কোটি টাকার আত্মসাতের অভিযোগে গত জুন মাসের ১০ তারিখে অনুসন্ধান শুরু করে দুদকের জ্যেষ্ঠ উপ-পরিচালক মীর জয়নুল আবেদীন শিবলী।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, আড়াই হাজার নয়, ভুয়া ঋণপত্রসহ জালিয়াতির মাধ্যমে হলমার্ক গ্রুপসহ ৫টি কোম্পানি প্রায় ৩ হাজার ৬শ’ কোটি টাকার আত্মসাৎ করেছে। তখন বিষয়টি জানার পর অনুসন্ধান কমিটির পরিধি বৃদ্ধি করার সিদ্ধান্ত নেয় দুদক। জুলাই মাসের ১৫ তারিখে কমিটি পূনর্গঠন করা হয়। কমিটি পূনর্গঠিত হওয়ার পর বাংলাদেশ ব্যাংক ও সোনালী ব্যাংকের তদন্ত প্রতিবেদন সংগ্রহ করে এবং ৭৮ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে অনুসন্ধান দল।
এছাড়া সোনালী ব্যাংক থেকে দুদকের মামলায় আসামি করার জন্য ২২ জনের একটি তালিকাও পাঠানো হয় দুর্নীতি দমন কমিশনে।
অনুসন্ধান কমিটি প্রাপ্ত বক্তব্য এবং সোনালী ব্যাংক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্ত প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্য-উপাত্ত খতিয়ে দেখে এসবের ভিত্তিতে “শুধু হলমার্কের ফান্ডে টাকা নেয়ার অংশটা জালজালিয়াতি“ বলে উল্লেখ করে কমিটি কমিশনে রিপোর্ট জমা দেয়। কমিশন রিপোর্ট পর্যালোচনা করে মঙ্গলবার ১১ মামলার অনুমতি দেয়।