অবশেষে মুখ খুললেন গভর্নর

অবশেষে মুখ খুললেন গভর্নর

অবশেষে মুখ খুললেন কেন্দ্রীয় ব্যাংক গভর্নর ড. আতিউর রহমান। রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি ব্যাংকের তদারকিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ক্ষমতার পার্থক্য নিয়ে তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। একই সঙ্গে ব্যাংকিং খাতের দ্বৈতশাসনের অবসান ঘটাতে ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন ও যুগোপযোগী করারও দাবি তুলে ধরেন তিনি। শনিবার সকালে রাজধানীর ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স মিলনায়তনে আয়োজিত এক সেমিনারে বক্তৃতাকালে একথা বলেন তিনি। এসময় “জনগণের টাকা নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে দেওয়া হবে না“ বলেও হুঁশিয়ার করে দেন কেন্দ্রীয় ব্যাংক গভর্নর।

ঢাকা স্কুল অব ইকোনমিকস এবং তরুণ অর্থনীতিবিদদের সংগঠন বাংলাদেশ ইয়াং ইকোনমিস্টস অ্যাসোসিয়েশন যৌথভাবে ‘আর্থিক খাতে স্থিতিশীলতা: করণীয় ও সম্ভাবনা’ শীর্ষক এই সেমিনারের আয়োজন করে।

এতে সভাপতিত্ব করেন, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের(বিআইডিস) মহাপরিচালক ড. মোস্তফা কামাল মুজেরী।

সেমিনারে মুক্ত আলোচনায় অংশ নেন বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকি কার্যক্রমের আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পরামর্শক গ্যালেন টাস্টিসহ অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা।

হলমার্ক কেলেঙ্কারি দিকে ইঙ্গিত করে গভর্নর বলেন, “কেন্দ্রীয় ব্যাংক চোখ বন্ধ করে থাকতে পারত। কিন্তু তা না করে শক্তিশালী অবস্থান নিয়েছে। তাই কিছু ধুলোবালি উড়ছে। তবে সব শান্ত হয়ে যাবে। জনগণের আমানত রক্ষায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক এতোটুকু পিছপা হবে না। ছাড় দেবে না।”

একই সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সীমাবদ্ধতার প্রতি ইঙ্গিত করে তিনি বলেন,  “রেফারি শক্তিশালী না হলে খেলা জমে না। আশা করি সরকার এ বিষয়ে নজর দেবে। রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি ব্যাংকের তদারকিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ক্ষমতার যে হেরফের ও ভারসাম্যহীনতা রয়েছে তা দূর করার উদ্যোগও সরকার নেবে বলে আশা করি। ব্যাংক কোম্পানি আইনের সংশোধনী আনতে হবে। ব্যাংকিং খাতের দ্বৈতশাসন দূর করা গেলে আর্থিক খাতে শৃংখলা স্থিতিশীল হবে।”

গভর্নর হুঁশিয়ার করে বলেন, “ব্যাংকিং খাতের যারা অপেশাদার পরিচালক ও ব্যাংকার রয়েছেন তাদের বিদায় নিতে হবে। সে সময় এসে গেছে। ক্ষমতা প্রয়োগ শুরু হয়েছে। তাই আমার এতো সমালোচনা। তবে ক্ষমতা ব্যবহারে পিছপা হবো না। অপেক্ষা করুন।”

প্রসঙ্গত, ড. আতিউর রহমান হলমার্ক কেলেঙ্কারির ঘটনার পর সোনালী ব্যাংকের পর্ষদ পুনর্গঠনের প্রস্তাব করে গত ২৭ আগস্ট অর্থমন্ত্রীকে চিঠি দেন। সেখানে তিনি এই ‘বড় জালিয়াতির’ জন্য পর্ষদকেই দায়ী করেন।

চিঠি দেবার পর ২৯ আগস্ট অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত রাজধানীতে আয়োজিত বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের এক অনুষ্ঠানে ব্যাংলাদেশ ব্যাংকের চিঠি দেওয়ার এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। এর এক পর্যায়ে গভর্নরকে ডেকে পাঠান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর থেকে বাইরের অনুষ্ঠানে যাওয়া বন্ধ রাখেন তিনি।

এর আগে সাধারণত সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতে গভর্নর বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যেতেন। ঘটনার পর বাংলাদেশ ব্যাংকের বাইরে শনিবারই প্রথম অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখলেন তিনি।

অনুষ্ঠানে ব্যাংক তদারকি নীতির সীমাবদ্ধতা নিয়ে বিস্তারিত কথা বলেন ড. আতিউর রহমান। তিনি বলেন, “রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর তদারকিতে কিছুটা  ভারসাম্যহীনতা ও পার্থক্য রয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক দুই ধরনের ব্যাংককে একভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। ফলে ব্যাংকিং খাতে দ্বৈতশাসন চলছে। আমি আশা করব সরকার এ ব্যাপারে উদ্যোগ নেবে। ব্যাংক কোম্পানি আইনের সংশ্লিষ্ট ধারাগুলো সংশোধন করে ব্যাংকিং খাতের নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংকের একক কর্তৃত্ব দেবে। আর এটি করা গেলে, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো আইনগতভাবে পুরোপুরি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হবে এবং এতে করে আর্থিক খাতেও স্থিতিশীলতা আসবে।”

তিনি বলেন, “ব্যাংক একটি সামাজিক ব্যবসা। এতে মালিকদের ৮/১০ শতাংশ শেয়ার ছাড়া বাকিটা অর্থ জনগণের আমানত। এ আমানত সুরক্ষা করার দায়িত্ব কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। তাই আইনগত শক্তি থাকতে হবে। রেফারি শক্তিশালী হতে হবে।”

রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো ডিজিটাইজেশনে পিছিয়ে আসে বলে তাদের তদারকি সঠিকভাবে করা যাচ্ছে না বলে মন্তব্য করেন তিনি।

সতর্ক করে দিয়ে তিনি বলেন, “ব্যাংকগুলো দরজা খোলা রাখবে আর চোর এসে চুরি করে নিয়ে গেলে পুলিশের ঘাড়ে দোষ দেবেন তা হবে না। দরজা আপনাকেই বন্ধ করে ঘুমাতে হবে। পেশাদারি আচরণ করতে হবে। তা না হলে এখাত থেকে বিদায় করা হবে। সে সময় এসে গেছে। নিজেদের ঘর সামলান। তা না হলে এখাতে থাকতে দেওয়া হবে না। সিদ্ধান্ত আপনাদের হাতে। তবে জনগণের টাকা নিয়ে কোনো ভাবেই ছিনিমিনি খেলতে দিবো না।”

শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির দিকে ইঙ্গিত করে গভর্নর বলেন, “আমি ফুটবলের রেফারি। ক্রিকেটের জন্য দায় আমাকে দেওয়া ঠিক নয়। এখন মিরপুর স্টেডিয়ামে ক্রিকেটে কী ঘটছে তা আমার দেখার বিষয় নয়। তারপরও উদ্যোগ নিয়েছি। ক্রিকেটের রেফারির সঙ্গে বসেছি। তা না হলে অনেকগুলো ব্যাংক পড়ে যেতো।”

এসময় আইএমএফ’র গ্যালেন টাস্কি বলেন, “আর্থিক খাতে স্থিতিশীলতা ধরে রাখতে নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানের ক্ষমতা থাকতে হবে। সে যাতে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে তার পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি ব্যাংকগুলোর অভ্যন্তরীণ নীরিক্ষা কার্যক্রমকে জোরদার করতে হবে।”

এমকে মুজেরি বলেন, “আর্থিক খাত মানে শুধু ব্যাংক নয়। এর বাইরে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে।”

শুধু আইন করে ক্ষমতা দিলো হবে না। সে ক্ষমতা কতটুকু ব্যবহার করতে পারছে তার নিশ্চয়তা দিতে হবে বলে মত দেন তিনি।

অর্থ বাণিজ্য