প্রতারণা করছে শাহজালাল ইসলামি ব্যাংক

প্রতারণা করছে শাহজালাল ইসলামি ব্যাংক

ইসলামি ব্যাংকিং করার নামে সাধারণ আমানতকারিদের সঙ্গে প্রতারণা চালিয়ে যাচ্ছে বেসরকারি খাতের শাহজালাল ইসলামি ব্যাংক লিমিটেড। সাধারণ মানুষের ইসলামি মূল্যবোধকে ব্যবহার করে আমানত সংগ্রহ করছে ব্যাংকটি। কিন্তু সেই আমানত তারা শরিয়াহ মোতাবেক বিনিয়োগ করে না। অর্থাৎ ইসলামি শরিয়াহ মোতাবেক পরিচালিত হচ্ছে না শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক। বাংলানিউজের দীর্ঘদিনের অনুসন্ধানে ব্যাংকটির গ্রাহক প্রতারণার এমন তথ্য রেবিয়ে এসেছে।

অন্য দিকে, বাংলাদেশে ইসলামি ব্যাংকিং সংক্রান্ত কোনো আইন বা বিধি না থাকায় একে নিয়ন্ত্রণও করতে পারছে না বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে মুনাফা করার দিক থেকে অতি দ্রুত ফুলে ফেঁপে উঠছে ব্যাংকটি। আর অস্বাভাবিক মুনাফা করার কারণে দিন দিন ঝুঁকির দিকে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের বিবেচনায়, ঝুঁকির ঠিক আগের ধাপে রয়েছে শাহজালাল ইসলামি ব্যাংক লিমিটেড।

শুধু তাই নয়, কেন্দ্রীয় ব্যাংকে মুনাফাসংক্রান্ত মিথ্যা তথ্য পাঠায় শাহজালাল ইসলামি ব্যাংক। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা দেওয়া তাদের আর্থিক প্রতিবেদনে অতিরিক্ত মুনাফা দেখিয়ে অনৈতিক এ কাজ করা হয়। পরে বিষয়টি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তে বেরিয়ে আসে। এর শাস্তি হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম) বন্ধও করে দেয়। ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের একজন প্রভাবশালী সদস্য এর মধ্যস্থতা করে এজিএম করার অনুমতি পান।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০০১ সালে কার্যক্রম শুরু করে শাহজালাল ইসলামি ব্যাংক। এ মুহূর্তে এর শাখা রয়েছে ৭৪টি। জানা গেছে, ব্যাংকের উদ্যোক্তারা দেশের মানুষের ইসলামি মূল্যবোধকে কাজে লাগিয়ে ব্যবসা করতে ইসলামি ব্যাংক হিসাবে লাইসেন্স নেয়। মালয়েশিয়াসহ বিশ্বের অনেক দেশে যখন ইসলামি ব্যাংকিং ব্যবস্থা জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকে, ঠিক সেই মুহূর্তে বাংলাদেশে এই সুযোগকে কাজে লাগাতে কয়েকজন উদ্যোক্তা ব্যাংকটি করেন।

তথ্য মতে, ইসলামি ব্যাংক কোনো সুদের বিনিময়ে অর্থ বিনিয়োগ করতে পারে না। ইসলামি ব্যাংকিং ব্যবস্থায় কোনো প্রকল্পে যৌথভাবে বিনিয়োগ করা যায়। ব্যাংকের অংশীদারিত্ব মাধ্যমে বিনিয়োগের মধ্য দিয়ে প্রকল্প লাভজনক হলে লভ্যাংশ পাওয়া যাবে।

কিন্তু অনুসন্ধানে জানা গেছে, শাহজালাল ইসলামি ব্যাংক অনেক ক্ষেত্রেই এভাবে ব্যাংকিং করে না। বিষয়টি নিয়ে তাদের শরিয়াহ বোর্ডে একাধিক বার প্রশ্ন উঠেছে।

শাহজালাল ইসলামি ব্যাংকের শরিয়াহ বোর্ডের একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “প্রকৃত অর্থে, এ ব্যাংকে ইসলামি ব্যবস্থা পরিপালন হচ্ছে না। ইসলামি ব্যাংকিং বিষয়টি অতটা সহজ নয়। তারপরও চলছে। তাছাড়া বাংলাদেশে তো ইসলামি ব্যাংকিং তদারকি বা নিয়ন্ত্রণ করার মতো কোনো আইনও নেই। ফলে সবাই যার যার মতো মুনাফানির্ভর ব্যবসা করে যাচ্ছে। তারা গ্রাহকদের সঙ্গে প্রতারণা করছে।”

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এখনো পর্যন্ত ইসলামি ব্যাংকিং নিয়ন্ত্রণ বা তদারকি করার মতো কোনো নীতিমালা করতে পারেনি কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ফলে যারা ইসলামি বাংকিং করছে অথবা যাদের নির্দিষ্ট কিছু শাখা এভাবে চলছে; তারা আসলে ব্যবসা করতেই এটি পরিচালনা করছে। প্রকৃত ইসলামি শরিয়াহ অনুযায়ী ব্যাংকিং ব্যবস্থা পরিপালন করছে না তারা। আবার বাংলাদেশ ব্যাংকও এদের কিছু অতিরিক্ত সুবিধা দিয়ে থাকে।

বিষয়টি ইসলামি ব্যাংকিং সংক্রান্ত কেন্দ্রীয় শরিয়াহ বোর্ডেও বারবার আলোচনায় আসছে। কিন্তু তা বেশি দূর অগ্রসর হচ্ছে না। কেন্দ্রীয় শরিয়াহ বোর্ডের সভায় শাহজালাল ইসলামি ব্যাংকের অনৈসলামিক ব্যাংকিং করার বিষয়টিও বার বার আসছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, দিন দিন মানুষের মধ্যে ইসলামি ব্যাংকিং সেবা নেওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। আর সেই সুযোগটি কাজে লাগাচ্ছে শাহজালাল ইসলামি ব্যাংক। ইসলামি ব্যাংকিং ব্যবস্থার কথা বলে ধর্মপ্রাণ মানুষের কাছ থেকে আমানত সংগ্রহ করছে তারা। আর বিনিয়োগ করছে সাধারণ বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মতোই। আর আমানতকারিদের কাছ থেকে এভাবে সহজ শর্তে আমানত এনে বিনিয়োগ করে ব্যাংকটি প্রতারণা করে বেশি মুনাফা করছে। এতে প্রতি বছরই প্রবৃদ্ধি করে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি।

অপরদিকে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অতিরিক্ত সুবিধাও তাদের মুনাফা বাড়িয়ে দিচ্ছে।

জানতে চাইলে ব্যাংকের উর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা বলেন, “কিছু কিছু ক্ষেত্রে শরিয়াহভিত্তিক ইসলামি ব্যাংকিং করার বিধানের লংঘন হতে পারে। তাছাড়া দেশে তো কোনো নীতিমালা নেই। তবে বিষয়টি আমাদের নজরে আছে।”

ওই কর্মকর্তা বাংলানিউজের এ প্রতিবেদকের কাছে সংবাদ প্রকাশ না করার অনুরোধ করে বলেন, “আমরা সংশোধনে আসার চেষ্টা করছি।”

তবে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আব্দুর রহমান সরকারের দপ্তরে দুদিন টেলিফোন করেও তাতে পাওয়া যায়নি।

এদিকে, শাহজালাল ইসলামি ব্যাংকের অতিশয় মুনাফা নির্ভরতা কারণে ব্যাংকটি ঝুঁকির দিকে যাচ্ছে বলে মনে করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে এই ব্যাংককে ঝুঁকির ঠিক আগের ধাপে রেখে নজরদারিতে রাখা হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা সার্বক্ষণিক এর তদারকির দায়িত্বে রয়েছেন। তিনি বলেন, শাহজালাল ইসলামি ব্যাংক যে শর্তে আমানত সংগ্রহ করছে সে মোতাবেক বিনিয়োগ করছে না। অতিশয় ঝুঁকি নিয়ে সাধারণ ব্যাংকগুলোর মতো বিনিয়োগ করছে। ফলে আমানতকারীদের আমানত ঝুঁকির মুখে পড়ছে।

অর্থ বাণিজ্য