তারল্য সংকটে ভুগছে রাষ্ট্রীয় মালিকানার সোনালী ব্যাংক। ধারদেনার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে ব্যাংকটি। নতুন করে বড় কোনো আমানতও আসেনি। ফলে গ্রাহকদের প্রতিদিনের চাহিদা মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে ব্যাংকটি। ব্যাংকের গত এক সপ্তাহের দৈনন্দিন আর্থিক লেনদেন পর্যবেক্ষণ করলে এই চিত্র উঠে আসে।
ব্যাংকের লেনদেন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ব্যাংকটিকে প্রতিদিন গড়ে সাড়ে তিন থেকে চার হাজার কোটি টাকা ধার করতে হচ্ছে। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিশেষ রেপো এবং আন্তঃব্যাংক মুদ্রা বাজার থেকে ধার ব্যাপক হারে বাড়াতে হয়েছে। আবার আমানতের নিরাপত্তা হিসেবে যে নগদ অংশ (সিআরআর) কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সংরক্ষণ করতে হয়, তাও রাখতে পারছে না। এ মুহূর্তে ব্যাংকের সিআরআর ঘাটতি প্রতিদিন প্রায় ৮০০ কোটি টাকা। আগে কখনও এই ঘাটতি ছিল না।
হলমার্ক কেলেংকারির ঘটনায় সাধারণ আমানতকারীদের মধ্যে আস্থার চিড় ধরতে শুরু করেছে। রাষ্ট্রীয় মালিকানার না হলে বাংলাদেশ ব্যাংক এতদিন ব্যাংকটিকে দেউলিয়া ঘোষণা করতো। সাধারণ গ্রাহকদের মধ্যে যে আস্থার ঘাটতি হয়েছে তা থেকে সহসা বেরিয়ে আসতে পারবে না ব্যাংকটি।
সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, এভাবে চলতে থাকলে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন এই প্রতিষ্ঠানটি দিনে দিনে আরো রুগ্ন হয়ে পড়বে। ফলে বাংলাদেশ ব্যাংকের হয়ে যে সব দায়িত্ব সোনালী ব্যাংককে পালন করতে হয় তা অসম্ভব হয়ে যাবে। তাই এখনই এব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানান, সোনালী ব্যাংকের প্রতি মানুষের আস্থার চিড় ধরেছে। সুতরাং এখন ভাববার সময় এসেছে, সোনালী ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকের হয়ে এবং সরকারের হয়ে দায়িত্ব পালন করতে সক্ষম কিনা। তাছাড়া মানুষের কাছে এটি গ্রহণযোগ্য হচ্ছে না। বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করে এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
জানা গেছে, সোনালী ব্যাংক হিমশিম খাচ্ছে তারল্য ব্যবস্থাপনা করতে। সংকটের কারণে বাংলাদেশ ব্যাংকে আসতে হচ্ছে প্রতিদিন। সেখান থেকে বিশেষ রেপোর মাধ্যম নগদ সহায়তা দেওয়া হচ্ছে ব্যাংকটিকে বাঁচিয়ে রাখতে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, সোনালী ব্যাংক রেপোর মাধ্যমে গড়ে প্রতিদিন ধার করছে দেড় থেকে দুই হাজার কোটি টাকা। প্রাইমারি ডিলার (পিডি) ব্যাংকগুলোর তারল্য সহায়তা নিয়েছে গড়ে প্রায় হাজার কোটি টাকা করে। আর কলমানি বাজার থেকে ব্যাংকটির এক হাজার থেকে ১২০০ কোটি টাকা নিচ্ছে।
তথ্যমতে, যে সব প্রবাসী বাংলাদেশি এই ব্যাংকের মাধ্যমে রেমিটেন্স দেশে পাঠাতেন তারাও এখন মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। এক হিসেবে দেখা গেছে, গত জুনে এই ব্যাংকের মাধ্যমে মোট রেমিটেন্স আসে প্রায় ৭ শতাংশ। আর সেটি কমে আগস্ট মাসে হয়েছে ৫ শতাংশ।
সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রদীপ কুমার দত্ত ব্যাংকের আর্থিক দূরাবস্থার কথা তুলে ধরে সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেন।
রাষ্ট্রীয়ভাবে যত আমদানি হয়ে থাকে তার ঋণপত্র (এলসি) খুলে থাকে সোনালী ব্যাংক। হলমার্কের দেওয়া ভুয়া এলসি কিনে ২৬টি ব্যাংকের ৫৪টি শাখা এখন বিপদে। ফলে কোনো ব্যাংক নতুন করে আর সোনালী ব্যাংকের এলসির বিল পরিশোধ করতে চাচ্ছে না। এভাবে চলতে থাকলে রাষ্ট্রীয় আমদানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে সংশ্লিষ্টদের ধারণা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি সূত্র জানায়, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রতিদিন সর্বোচ্চ ধার নেওয়ার পরও কলমানি বাজার থেকে ধারাবাহিক ঋণ নেওয়ার কারণ জানতে চেয়ে সম্প্রতি সোনালী ব্যাংকে চিঠি দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। জবাবে ব্যাংকটি বলেছে, দৈনন্দিন লেনদেনের পর নগদ জমা (সিআরআর) সংরক্ষণের মতো অর্থ না থাকায় তাদের কলমানি বাজারে যেতে হচ্ছে।
ব্যাংকের আর্থিক দুরাবস্থার বিষয়ে সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রদীপ কুমার দত্ত ব্যস্ত আছেন জানিয়ে এ ব্যাপারে কথা বলতে চাননি।