মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের প্রথম সাক্ষী বাংলাদেশ ইসলামী ঐক্যজোট একাংশের চেয়ারম্যান মিজবাউর রহমান চৌধুরী বলেছেন, আমার গবেষণার বিষয় হলো মুক্তিযুদ্ধের সময় জামায়াত ও তার সহযোগীদের ভূমিকা নিয়ে। আমার গবেষণার ফলাফল ধারাবাহিকভাবে প্রচারণা শুরু হয়েছে এবং চলছে। এ পর্যন্ত আমার গবেষণার ৫০টির মতো প্রতিবেদন, প্রেসবিজ্ঞপ্তি, প্রেসকনফারেন্স ও প্রবন্ধ ইত্যাদি প্রকাশ পেয়েছে।
মঙ্গলবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে-১ আসামিপক্ষের জেরা চলাকালে প্রশ্নের জবাবে তিনি এসব কথা বলেন।
চেয়ারম্যান নিজামুল হকের নেতৃত্বে দুই সদস্যের ট্রাইব্যুনালে মিজবাউর রহমান চৌধুরীকে চতুর্থ দিনের মতো জেরা করেন নিজামীর আইনজীবী অ্যাডভোকেট মিজানুল ইসলাম। জেরা ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মুলতবি ঘোষণা করেছেন ট্রাইব্যুনাল।
এজন্য সকালে কারাগার থেকে নিজামীকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়।
সাক্ষী জেরায় বলেন, ‘‘আমি আলবদর, রাজাকার ও আলশামস বাহিনী গঠন প্রক্রিয়া নিয়ে পাকিস্তানের কোনো বই আমি পড়িনি। তবে পত্রিকা ও জার্নাল পড়েছি।’’ কি কি পত্রিকা জার্নাল পড়েছেন জানতে চাইলে সাক্ষী বলেন, ‘‘সে সময়ের ডন পত্রিকা ও ইমপেক্ট জার্নাল পড়েছি।’’
‘‘শাহীন ফৌজ নিয়ে কোনো প্রতিবেদন আপনার কাছে আছে কিনা’’ আইনজীবীর এমন প্রশ্নের উত্তরে সাক্ষী বলেন, ‘‘না, কারণ, শাহীন ফৌজ আমার গবেষণার বিষয় ছিল না। আমি ১৯৭১ সালে ও তার আগে ইসলামী ছাত্রসংঘ প্রকাশিত সংবাদ-বুলেটিন গবেষণা কাজে ব্যবহার করেছি।’’
‘‘ইসলামী ছাত্রসংঘের প্রকাশিত সংবাদ বুলেটিনগুলোর দু’একটির নাম বলতে পারবেন?’’- এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘আমি বলতে পারবো না। তবে আব্দুল মালেকের ওপর লেখা একটি স্মরণিকাসহ দু’একটি বুলেটিন আমার সংগ্রহে রয়েছে।’’
পরে অন্য পশ্নে অ্যাডভোকেট মিজানুল ইসলাম সাক্ষীর কাছে জানতে চান যে, ‘‘আপনি মুক্তিযুদ্ধের পরে গবেষণা কাজের জন্য পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চে গিয়েছিলেন?’’ জবাবে মিজবাউর বলেন, ‘‘পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চে যাইনি। তবে রাজনীতিবিদ, লেখক, সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মী ওই সময়ে যারা গণহত্যার বিপক্ষে ছিলেন এবং সেক্টর কমান্ডারদের সঙ্গে দেখা করেছি।’’
‘‘মুক্তিযুদ্ধকালীন মৌলভীবাজার অঞ্চলের সেক্টর কমান্ডার সিআর দত্তের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছি। তবে বীরউত্তম কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে দেখা করিনি।’’
আইনজীবী পরে জানতে চান যে, ‘‘বুদ্ধিজীবী হত্যা সম্পর্কে আপনি কোনো গবেষণা করেছেন কিনা?’’ জবাবে তিনি বলেন, ‘‘না এই মুহূর্তে বুদ্ধিজীবী হত্যা সম্পর্কে আমার কোনো গবেষণা নেই।’’
তিনি বলেন, ‘‘বুদ্ধিজীবী হত্যার বিষয়ে পাকিস্তানি সেনাদের (কণের্ল) দায়ী করে তদন্ত করা হয়েছে কিনা আমার জানা নেই তবে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের তদন্তে জামায়াত ও ছাত্রসংঘকে দায়ী করা হয়েছে বলে আমি গবেষণায় পেয়েছি।’’
পরের প্রশ্নের জবাবে সাক্ষী বলেন, ‘‘দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বুদ্ধিজীবী হত্যার বিষয়ে তদন্ত কমিটি হয়েছিল বলে আওয়ামী লীগ নেতা তোফায়েল আহমেদ এমপির কাছে থেকে শুনেছি।’’
সাক্ষী বলেন, ‘‘আমি তোফায়েল সাহেবের কথার ওপর ভিত্তি করেই বিশ্বাস করেছি। কোনো তথ্য নেওয়ার প্রয়োজন মনে করিনি। ওই সময় বেসরকারি ভাবে গঠিত তদন্ত কমিটিতে কে ছিলেন আমার জানা নেই।’’
অন্য প্রশ্নে আইনজীবী জানতে চান যে, ‘‘মতিউর রহমান নিজামী সাহেব কি আলবদর বাহিনীর প্রধান ছিলেন?’’ জবাবে সাক্ষী বলেন, ‘‘তিনি প্রধান ছিলেন না। তবে তার নির্দেশে আলবদর বাহিনী গঠিত হয়েছিল।’’
জেরা আগামী ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মুলতবি করেছেন ট্রাইব্যুনাল।
এর আগে গত ২৬ আগস্ট মিজবাউর রহমান চৌধুরী ট্রাইব্যুনালে নিজামীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য প্রদান করেন।
উল্লেখ্য, গত ২৮ মে মুক্তিযুদ্ধের সময়কার মানবতাবিরোধী অপরাধের ১৬টি অভিযোগ এনে নিজামীর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের ৩(২)(এ), ৩(২)(সি), ৩(২)(জি), ৩(২)(এইচ), ৪(১), ৪(২) ধারায় অভিযোগ গঠন করা হয়। তার বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের সময় হত্যা, লুট, ধর্ষণ, উস্কানি ও সহায়তা, পরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্র এবং বুদ্ধিজীবী হত্যাসহ মোট ১৬টি ঘটনায় অভিযোগ আনা হয়েছে।
ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগের মামলায় ২০১০ সালের ২৯ জুন মতিউর রহমান নিজামীকে গ্রেফতার করা হয়। পরে একই বছরের ২ আগস্ট তাকে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতার দেখানো হয়।
গত বছরের ১১ ডিসেম্বর মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ ট্রাইব্যুনালে উপস্থাপন করে রাষ্ট্রপক্ষ। এতে তার বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে হত্যা, খুন, ধর্ষণ এবং অগ্নিসংযোগসহ মানবতাবিরোধী বিভিন্ন অপরাধের অভিযোগ আনা হয়।
এ বিষয়ে প্রসিকিউশন ৩৩৬ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করে। আর আনুষঙ্গিক কাগজপত্রসহ প্রায় আড়াই থেকে ৩ হাজার পৃষ্ঠার ডকুমেন্ট তৈরি করা হয়।
গত ৯ জানুয়ারি নিজামীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল। এতে মোট ১৫টি অভিযোগ ছিল। অভিযোগ গঠনকালে বুদ্ধিজীবী হত্যা যোগ হয়েছে।