হলমার্ক কেলেঙ্কারির ঘটনাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে সরকারের দূরত্ব কমছে না। বরং দিন দিন বাড়ছে। তবে ব্যাংকটির সঙ্গে সরকারের দৈনন্দিন কার্যক্রমে কোনো যোগসূত্র না থাকায় তা দৃশ্যমান হচ্ছে না।
সরকার মনে করছে, হলমার্ক ইস্যুকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ ব্যাংকের অবস্থান ও উদ্যোগ সরকারকে বিব্রত করেছে। আর এর সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের শীর্ষস্থানীয় কিছু কর্মকর্তা জড়িত বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ অভিযোগে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন পর্যায়ের কয়েকজন কর্মকর্তাকে সন্দেহের তালিকায় নেওয়া হয়েছে। তাদের ব্যাপারে নিশ্চিত হতে ওইসব কর্মকর্তার ওপর গোয়েন্দা নজরদারি চালাচ্ছে সরকার।
সূত্র বলছে, সার্বিকভাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের কার্যক্রম এবং কর্মকর্তাদের ওপর নজরদারি করতে বিশেষ দুটি গোয়েন্দা সংস্থাকে দায়িত্ব দিয়েছে সরকার। তারা সন্দেহভাজন কর্মকর্তাদের গতিবিধি এবং চলাফেরা নজরদারিতে রেখেছে। গত সপ্তাহের প্রথম থেকেই এই নজরদারি চলছে বলে জানা গেছে।
সরকারের একটি অংশ মনে করছে, সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে হলমার্ক ইস্যুতে অতি উৎসাহী ভূমিকা নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিতের সাম্প্রতিক বক্তব্য থেকে বিষয়টি প্রকাশ্যে চলে আসে।
সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা শাখা থেকে অর্থ জালিয়াতির ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের ভূমিকা প্রসঙ্গে গত ২৮ আগস্ট অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের এক অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের বলেছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের এমন এখতিয়ার নেই। তিনি এই ইস্যুতে বাংলাদেশ ব্যাংকও দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ বলে মন্তব্য করেছেন।
তথ্য মতে, এর আগে ২৬ আগস্ট বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর ড. আতিউর রহমান অর্থমন্ত্রীকে হলমার্ক কেলেঙ্কারির ঘটনার বিস্তারিত তুলে ধরে একটি চিঠি দেন। ব্যাংক কোম্পানি আইনের ৪৬ ধারা মোতাবেক বাংলাদেশ ব্যাংক এই চিঠি দেন অর্থমন্ত্রীকে।
সূত্র জানায়, চিঠিতে সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা শাখার মাধ্যমে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা অর্থ আত্মসাতের পর গভর্নর অর্থমন্ত্রীকে এর বোর্ডের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার যুক্তি দেখিয়ে বোর্ড পুর্নগঠনের সুপারিশ করে। এই প্রেক্ষিতে অর্থমন্ত্রী এমন মন্তব্য করলেন।
এদিকে, রূপসী বাংলা শাখা থেকে জালিয়াতির মাধ্যমে অর্থ তুলে নেওয়া হলমার্ক গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীর মাহমুদের সঙ্গে সরকারের একজন প্রভাবশালী উপদেষ্টা এবং প্রতিমন্ত্রীর ঘনিষ্টতার তথ্য ফাস হয়ে যায়। প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টা দুইবার হলমার্ক গ্রুপ পরিদর্শনে গিয়েছেন এবং তানভীর মাহমুদের গ্রামের বাড়িতেও গিয়েছেন বলে সংবাদ মাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়।
জানা গেছে, দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) সোনালী ব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে ওই উপদেষ্টা জড়িত বলে তথ্য দিয়েছেন। যদিও বিষয়টি সংবাদ মাধ্যমের কাছে অস্বীকার করেছেন ওই উপদেষ্টা। ফলে সরকারকে সমালোচনায় পড়তে হয়।
এদিকে অর্থনীতিবিদ এবং বিশেষজ্ঞদের একটি অংশ বর্তমান সরকারের আমলে পুর্নগঠিত অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের কার্যক্রম এবং ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।
অর্থনীতিবিদ এবং ব্যাংকারদের অনেকেই মনে করছেন, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ থাকার কারণে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে সঠিকভাবে তদারকি করতে পারে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ফলে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে অনিয়ম এবং দুর্নীতি প্রতিনিয়তই বাড়ছে।
জানা গেছে, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন শফিকুর রহমান পাটোয়ারি। তার বিভাগ নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় তিনিও ক্ষুদ্ধ হয়ে ওঠেন।
আরও জানা যায়, যেদিন গভর্নর অর্থমন্ত্রীকে চিঠি দেন, সেদিনই একটি জরুরি বৈঠকে শফিকুর রহমান পাটোয়ারি অর্থমন্ত্রীকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক এটি করতে পারে না। তিনি অর্থমন্ত্রীকে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভূমিকার বিপরীতে নানা তথ্য তুলে ধরেন। আর অর্থমন্ত্রী তার বক্তব্য গ্রহণ করেন। ফলে সরকারের সঙ্গে বিশেষ করে অর্থমন্ত্রী এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের মধ্যে দূরত্ব বাড়তে থাকে।
সূত্র বলছে, সরকারকে একটি মহল বুঝিয়েছে, মহাজোট সরকারকে বেকায়দা ফেলতে এবং বিব্রত করতে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভিতরে কর্মরত একটি অংশ এ কাজ করছে। ফলে প্রধানমন্ত্রী গভর্নরকে ডেকে এর বিস্তারিত জানতে চান।
সূত্র মতে, সরকারের সন্দেহে বাংলাদেশ ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক, নির্বাহী পরিচালক এবং ডেপুটি গভর্নর পর্যায়ের কয়েকজনের নাম রয়েছে। অর্থমন্ত্রীকে তাদের সম্পর্কে বলা হয়েছে। বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে নেয় সরকার। এবং তাদের ওপর নজরদারি রাখতে গোয়েন্দা সংস্থাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংকের শীর্ষ স্থানীয় কর্মকর্তারা অত্যন্ত সর্তকভাবে দায়িত্ব পালন করছেন।
নজরদারিতে থাকা এক কর্মকর্তা বলেন, ‘‘শুনেছি সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে আমার নামে অভিযোগ যাচ্ছে। তবে পেশাদারিত্ব নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি। জানি না কি হবে।’’
এদিকে, হলমার্ক কেলেঙ্কারির ঘটনার পর অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে বাইরে কোনো অনুষ্ঠানে যাচ্ছেন না গভর্নর। সংবাদ মাধ্যমকে এড়াতে এবং নতুন করে যাতে কোনো ঝামেলা তৈরি না হয় তার জন্যই এ কৌশল তিনি নিয়েছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
অন্যদিকে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে সরকারের বিরোধের বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে স্পষ্ট হয়ে গেছে।
এ বিষয়ে অর্থমন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব শফিকুর রহমান পাটোয়ারির সঙ্গে যোগাযোগের জন্য মুঠোফোনে চেষ্টা করেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের দূরত্ব এখন সবার জানা। তবে যেহেতু বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে সরকারর দৈনন্দিন কোনো সম্পর্ক নেই তাই তা ব্যাপক আকার ধারণ করছে না। তবে কর্মকর্তাদের ওপর গোয়েন্দা নজরদারির বিষয়টি জানেন না বলে জানান ওই কর্মকর্তা।