সংসদ বহাল রেখে নির্বাচন হবে না বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তিনি বলেছেন, “সংসদীয় ব্যবস্থায় সরকার প্রধান রাষ্ট্রপতির কাছে নির্বাচনের প্রস্তাব নিয়ে যান। পরে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের নির্দেশ দেন। সংসদ রেখে তো নির্বাচন হবে না।”
বুধবার জাতীয় সংসদের নির্ধারিত প্রশ্নোত্তরে জাতীয় পর্টির মুজিবুল হক চুন্নুর এক সম্পূরক প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেন।
মুজিবুল হক চুন্নু প্রধানমন্ত্রী কাছে জানতে চান, সংসদ রেখে নির্বাচন হবে কি না, নির্বাচন কমিশন (ইসি) শক্তিশালী করা হবে কি না?
জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “সংসদীয় ব্যবস্থায় সরকার প্রধান রাষ্ট্রপতির কাছে নির্বাচনের প্রস্তাব নিয়ে যান। পরে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের নির্দেশ দেন। সংসদ রেখে তো নির্বাচন হবে না। সময় হলে আমি রাষ্ট্রপতির কাছে নির্বাচনের প্রস্তাব নিয়ে যাবো। তিনি নির্দেশ দেবেন মন্ত্রিসভা থাকবে কি না বা ছোট করা হবে কি না। সংসদ ভেঙে দেওয়া হবে কি না সেটাও উনি ঠিক করবেন। আর নির্বাচন অনুষ্ঠান করবেন নির্বাচন কমিশন।”
সংসদ নেতা বলেন, “যারা টক শো করে টেলিভিশন ফাটিয়ে ফেলছেন তাদের বলতে চাই- বাংলাদেশের ইতিহাসে দলীয় সরকারের অধীনে এই প্রথম ছয় হাজারের মতো নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে।”
তিনি বলেন, “হবিগঞ্জে আমাদের দল হেরে গেলেও আমরা ভোটের ফলাফল উল্টে দেইনি। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার। যে জনগণের জন্য লড়াই করেছি, তাদের ভোট চুরি আমাদের নীতিতে নেই।”
“জনগণ চাইলে আছি, না চাইলে নেই” বলেন শেখ হাসিনা।
এর আগে মুহাম্মদ ইমাজ উদ্দিন প্রমাণিকের সম্পূরক প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, “যারা টক শো তে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি করেন তাদের বলতে চাই, কি গ্যারান্টি আছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার এলে নির্বাচন হবে? যারা দাবি করছেন তাদের মনে করিয়ে দিতে চাই, ১/১১’র মতো সরকার এলে সংবিধান কার্যকর থাকবে না। তারাও গণতান্ত্রিক অধিকার হারাবে।”
“ওই সরকার যে দম বন্ধ পরিবেশের সৃষ্টি করেছিলো, সেটা কি ভুলে গেছেন?”প্রশ্ন রাখেন প্রধানমন্ত্রী।
তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা দাবিকারীদের প্রতি শেখ হাসিনা বলেন,“গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কথা বলার স্বাধীনতা রয়েছে। যে কোন মানুষের দাবি করার অধিকার রয়েছে। যারা তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার দাবি করছেন সেটা তাদের নিজস্ব ব্যাপার।”
এর আগে একই সদস্যের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার হারানোর আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, “১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বিএনপি সরকারের ভোটচুরির নির্বাচনে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার নির্বাচন পরিচালনা ও দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার যে দৃষ্টান্ত দেখিয়েছে, সে অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের জনগণের মনে শঙ্কা সৃষ্টি করেছে। আবার যদি এ ব্যবস্থা আসে, আর যদি ক্ষমতা না ছাড়ে তাহলে জনগণ গণতান্ত্রিক অধিকার হারাবে।”
সংসদ নেতা আরো বলেন, “আমাদের জানা মতে, বিশ্বের কোন গণতান্ত্রিক দেশে অনির্বাচিত ব্যক্তিদের দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালু নেই। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে সব সময়ে রাষ্ট্র পরিচালনার বিধান রয়েছে বিধায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালু নেই। সংবিধানের ১১ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রশাসনের সব পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে সরকার পরিচালনায় জনগণের অংশগ্রহণের বিধান নিশ্চিত করতে হবে।”
তিনি বলেন, “১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বিএনপি সরকার একটি বিতর্কিত নির্বাচন করে। যে নির্বাচন সব রাজনৈতিক দল ও দেশের মানুষ বর্জন করেছিলো। সারাদেশে সেনা মোতায়েন করে নির্বাচনের নামে প্রহসন করা হয়। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার বিধান সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হওয়ায় সংবিধান (ত্রয়োদশ সংশোধন) আইন, ১৯৯৬ সুপ্রিম কোর্ট ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলার রায়ে অবৈধ ও অসাংবিধানিক ঘোষিত হয়েছে।”
শেখ হাসিনা বলেন, “জাতীয় সংসদে সর্বদলীয় বিশেষ কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী, গত বছরের ৩০ জুন জাতীয় সংসদে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধান সংশোধন করা হয়েছে বিধায় এ ব্যবস্থা চালু নেই। সংবিধান সংশোধন করে সংসদীয় গণতন্ত্র এবং ১৯৭২ সালের সংবিধান পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। জনগণের ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা হয়েছে পঞ্চদশ সংশোধনীতে।”
সংসদ নেতা এ প্রসঙ্গে আরও বলেন, “তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা চালু থাকা অবস্থায় ১৯৯৬ সালে নির্বাচনের আগে ২০ মে সেনা অভ্যুত্থান হয়েছিলো, যা সফল হয়নি বলে গণতন্ত্র রক্ষা পায়। ২০০১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসার প্রথম দিনই ১৩ জন সচিবকে অন্যায়ভাবে চাকরিচ্যুত করে এবং প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন করে। বিএনপি ও জামায়াতের সন্ত্রাসীরা সারাদেশে হত্যা, খুন ও নির্যাতন চালায়। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকার জনগণের জান-মালের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়।”
তিনি বলেন, “২০০৬ সালে ইয়াজউদ্দীন রাষ্ট্রপতি থাকা অবস্থায়ই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার পদ গ্রহণ করে বিতর্ক সৃষ্টি করেন। এক কোটি ২৩ লাখ ভুয়া ভোটার ভোটারলিস্টে থাকা অবস্থায় নির্বাচনের প্রচেষ্টা নেন। ফলে সরকারের উপদেষ্টারা পদত্যাগ করেন। আবার তিনি নতুন উপদেষ্টা নিয়োগ দেন। কয়েক দফা এ ধরনের ঘটনা ঘটে। এ পরিস্থিতিতে ১/১১’র ঘটনা ঘটে। রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন প্রধান উপদেষ্টার পদ থেকে পদত্যাগ করার পর বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ফখরুদ্দীন আহমেদ প্রধান উপদেষ্টার পদ গ্রহণ করেন। সেনা সমর্থনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়ে তিন মাস অর্থাৎ ৯০ দিনের স্থলে প্রায় দু’বছর ক্ষমতায় থেকে যায়। সব শ্রেণী-পেশার মানুষের উপর নির্যাতন চালাতে থাকে। ছাত্র, শিক্ষক, ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক নেতা-কর্মীসহ সব স্তরের মানুষ গোয়েন্দা সংস্থার হাতে হয়রানির শিকার হয়। দেশব্যাপী যুদ্ধাবস্থা না থাকা সত্ত্বেও দু’বছর ধরে সেনাবাহিনী মোতায়েন থাকে। দল ভাঙ্গা ও নতুন দল গড়ার খেলাও শুরু হয়। এ অবস্থায় জনগণ দেশে ও বিদেশে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। দেশের ভেতর ও আন্তর্জাতিক চাপে ফখরুদ্দীন সরকার নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়।”
শেখ হাসিনা আরো বলেন, “মহাজোট সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর সংসদের উপ-নির্বাচন, সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে সম্পন্ন হয়েছে। জনগণ তাদের পছন্দমত প্রার্থীকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করতে পেরেছে যা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির পরিচায়ক। কাজেই মহাজোট সরকারের অধীনে যে কোন ধরনের সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন পরিচালনা করার মত গণতান্ত্রিক পরিবেশ দেশে ফিরে এসেছে বিধায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার কোন প্রয়োজন নেই।”
সানজিদা খানমের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের প্রত্যক্ষ মদতে প্রকাশ্য দিবালোকে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের জনসভায় উপুর্যপরি গ্রেনেড হামলা করা হয়। আমি কোনভাবে বেঁচে গেলেও আমরা হারিয়েছি আমাদের নেত্রী আইভি রহমানসহ আরো অনেক নেতা-কর্মীকে। শত শত নেতা-কর্মী এখনো শরীরে গ্রেনেডের স্প্লিন্টার নিয়ে যন্ত্রণাকাতর দুর্বিষহ জীবন-যাপন করছে।”
শেখ হাসিনা বলেন, “বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার এ দেশকে একটি অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত করতেই জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদের উত্থান ঘটিয়েছে। দেশটাকে একটি জঙ্গি ও সন্ত্রাসী রাষ্ট্রে পরিণত করার লক্ষ্য নিয়েই এ ধরণের সন্ত্রাসী উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলো।”
তিনি আরও বলেন, “স্বাধীন বাংলাদেশের অস্তিত্বে যারা বিশ্বাস করে না তাদের পক্ষেই এসব জঘন্য কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্ভব। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার স্বাধীন বাংলাদেশের অস্তিত্ব বিলীন করার উদ্দেশ্যেই গ্রেনেড হামলা করেছিলো। তারপর তারা ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট সারাদেশে একযোগে বোমা হামলা করেছিলো।”
তিনি বলেন, “দেশের বিভিন্ন জেলায় গ্রেনেড হামলাসহ যে সব হামলা সংঘটিত হয়েছে সে সব ঘটনায় দায়ের করা মামলার মধ্যে কিছু মামলার বিচার সম্পন্ন হয়েছে। অবশিষ্ট মামলার বিচার কাজ অব্যাহত আছে।”
প্রসঙ্গ পদ্মাসেতু
এম. আবদুল ও স্বতন্ত্র সদস্য ফজলুল আজিমের প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, “ব্যক্তিস্বার্থে কিছু স্বার্থন্বেষী মানুষ জনগণের ক্ষতি করেছে। আমরা উদ্যোগ নিয়েছি। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের বার্ষিক বরাদ্দ এবং রিজার্ভ আছে, তাছাড়া প্রবাসীদের কাছ থেকে সাড়া পাচ্ছি।”
তিনি বলেন, “পদ্মাসেতুর জন্য সারচার্জ বসানোর কোনো প্রয়োজন হবে না।”