ত্রয়োদশ সংশোধনীর রায়ে স্বাক্ষর ৭ বিচারপতির ৪ জনের মত, তত্ত্বাবধায়ক অবৈধ

ত্রয়োদশ সংশোধনীর রায়ে স্বাক্ষর ৭ বিচারপতির ৪ জনের মত, তত্ত্বাবধায়ক অবৈধ

রায় ঘোষণার দীর্ঘ ১৬ মাস পর সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী (তত্ত্বাবধায়ক সরকার) বাতিল করে দেওয়া সুপ্রিম কোর্টের রায় প্রকাশিত হয়েছে।

রোববার রাতে সাত বিচারপতির স্বাক্ষরের পর বিষয়টি সাংবাদিকদের জানিয়েছেন রায় ঘোষণাকারী সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক।

বিচারপতি খায়রুল হক সাংবাদিকদের জানান, রায় দানকারী সাত বিচারপতিই রায়ে সই করেছেন। এদের মধ্যে চার জন তত্ত্বাবধায়ক প্রথার বিপক্ষে, ২ জন পক্ষে এবং ১ জন বিষয়টি সংসদের ওপর ছেড়ে দেওয়ার জন্য মত দিয়েছেন।

গত  বছর ১০ মে এ রায় প্রদানকারী ৭ বিচারপতি রোববার দুপুরে বৈঠক করে রায়ে স্বাক্ষর করার সিদ্ধান্ত নেন। পরে রাতে তারা সবাই রায়ে সই করেন। এরপর রায়টি সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়।

সুপ্রিম কোর্ট সূত্রে জানা গেছে, মোট ৭৪৭ পৃষ্ঠা রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের পক্ষে বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন প্রধান বিচারপতি মোজাম্মেল হোসেনসহ তিন বিচারপতি। বাকি দু’জন হলেন- বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা (এস কে সিনহা) ও সৈয়দ মাহমুদ হোসেন। এর মধ্যে বিচারপতি এস কে সিনহাও আলাদাভাবে অভিমত লিখেছেন। তিনিও তার অভিমতে, দুই মেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বহাল রাখার পক্ষে মত দিয়েছেন। তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার থেকে বিচারপতিদের বাদ দেয়ার পক্ষেও মত দিয়েছেন তিনি।

তবে বিচারপতি আবদুল ওয়াহহাব মিঞা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে মত দেন। তার সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা।

অপর বিচারপতি ইমান আলী বিষয়টি সংসদের ওপর ছেড়ে দেন।

তবে সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের লেখা এ রায়ে একাদশ এবং দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে পারে বলে বলা হয়েছে। এক্ষেত্রে নতুনভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের ভার সংসদের ওপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে।

রায়ে বলা হয়েছে, ‘সংবিধান (ত্রয়োদশ সংশোধন) আইন, ১৯৯৬, অসাংবিধানিক ও অবৈধ হইলেও জাতীয় সংসদ ইহার বিবেচনা এবং  সিদ্ধান্ত অনুসারে উপরে বর্ণিত  নির্দেশাবলী সাপেক্ষে দশম ও একাদশ সাধারণ নির্বাচনকালীন সময়ে প্রয়োজনমত নূতনভাবে ও আঙ্গিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের ব্যবস্থা গ্রহণ করিতে পারিবে।’

এতে আরও বলা হয়েছে, ‘সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবার ক্ষেত্রে, জাতীয় সংসদের বিবেচনা  (Discretion) অনুসারে, যুক্তিসঙ্গত কাল (reasonable period) পূর্বে, সংসদ ভাঙ্গিয়া দেওয়া বাঞ্ছনীয় হইবে, তবে, নির্বাচন পরবর্তী নূতন মন্ত্রিসভা কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত পূর্ববর্তী মন্ত্রিসভা সংক্ষিপ্ত আকার গ্রহণ করতঃ উক্ত সময়ের জন্য রাষ্ট্রের স্বাভাবিক ও সাধারণ কার্যক্রম পরিচালনা করিবেন।’

রায়ে বিগত দ্বিতীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ৯০ দিনের পরবর্তী শাসনকে অসাংবিধানিক বলা হলেও তা মার্জনা করা হয়েছে।

বিচারপতি খায়রুল হকের প্রতিক্রিয়া:
সংবিধানের ১৩তম সংশোধনী বতিল করে দেওয়া চূড়ান্ত রায় অনেক সুন্দর হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক। রায়ে কি আছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “সুপ্রিমকোর্টের ঐতিহ্য হচ্ছে রায়ের পর এ নিয়ে কোনো কথা না বলা। ওয়েবসাইটে সব দেয়া আছে। আপনারা সেখানে দেখে নেবেন।”

তিনি বলেন, “আপিল বিভাগের সাত বিচারপতির মধ্যে তিনজন আমার সাথে একমত (এগ্রি) হয়েছেন। বাকি তিনজনের দুইজন ভিন্নমত পোষণ করেছেন। আরেক বিচারপতি ব্যাপারটি নিষ্পত্তি করে (ডিসপোসড অফ) করে দিয়ে সংসদের হাতে ছেড়ে দিয়েছেন।”

খায়রুল হক বলেন, “যারা ভিন্নমত পোষণ করেছেন, তারা আলাদা রায় লিখেছেন। আর যারা আমার সাথে ‘এগ্রি’ করেছেন তারা না লিখে আমাকে কন্ট্রিবিউট করছেন।”

পূর্ণাঙ্গ রায় লিখতে ১৬ মাস লাগলো কেন এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “রায় লিখতে দীর্ঘ সময় লাগেনি। এ রায়ের আগে আমার হাতে আরও অনেকগুলো রায় ছিল। ওই রায়গুলো লেখার পর গতবছরের অক্টোবরে আমি এ রায়টি লেখা শুরু করি। আর গত মার্চে রায় লেখা শেষ হয়। এরপর নানা পরিবর্তন পরিমার্জন করতে গিয়ে কিছু সময় লেগেছে।”

অ্যাটর্নি জেনারেলের প্রতিক্রিয়া:
অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেন, “এ রায়ে ১৩তম সংশোধনীকে অসাংবিধানিক, অবৈধ ও অকার্যকর ঘোষণা করা হয়েছে। রায়ে ১৩তম সংশোধনীকে বাতিল বলে ঘোষণা করা হয়েছে।”

রায়ে তত্ত্বাবধায়কের ব্যাপারে কি  আছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “চূড়ান্ত রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থ্যা নিয়ে কোনো নির্দেশনা নেই।”

ইতিহাসে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা:
সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালু হয়। এ ব্যবস্থা ১৯৯৬ সালের ২৮ মার্চ প্রেসিডেন্টের সম্মতি পায়। এর আগে ষষ্ঠ সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা গৃহীত হয়। এরপর সপ্তম, অষ্টম ও নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন এ ব্যবস্থার অধীনে হয়েছে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে অগণতান্ত্রিক ও সংবিধানবহির্ভূত আখ্যা দিয়ে অ্যাডভোকেট এম. সলিমউল্যাহ, রুহুল কুদ্দুস ও মো. আবদুল মান্নান খান হাইকোর্টে একটি রিট করেন। হাইকোর্টে তিন বিচারপতির বৃহত্তর বেঞ্চে রিটের শুনানি হয়। ২০০৪ সালের ৪ আগস্ট হাইকোর্টের ওই বেঞ্চ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বৈধ বলে রায় দেয়।

হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়, ত্রয়োদশ সংশোধনী সংবিধানসম্মত ও বৈধ। এ সংশোধনী সংবিধানের কোন মৌলিক কাঠামোকে ক্ষতিগ্রস্ত করেনি।

পরে রিট আবেদনকারীরা এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে যান। আপিল বিভাগ এ মামলায় এমিকাস কিউরি (আদালতকে সহায়তাকারী) হিসেবে দেশের বিশিষ্ট আট জন সংবিধান বিশেষজ্ঞের বক্তব্য শোনেন। তাদের কাছে আদালতের প্রশ্ন ছিলো, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর সঙ্গে সাংঘর্ষিক এবং বিচার বিভাগ পৃথককরণের পরিপন্থি কিনা? আট এমিকাস কিউরির মধ্যে সাতজনই বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিদ্যমান তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা রাখার পক্ষে আদালতে মত দেন।

২০১১ সালের ১০ মে এ রায় দেওয়ার সময় এবিএম খায়রুল হক প্রধান বিচারপতি ছিলেন।

ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলার সংক্ষিপ্ত রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করেছিল আপিল বিভাগ। তবে দেশের সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করে আরো দুই দফা (টার্ম) এ ব্যবস্থা বহাল রাখার কথা বলা হয়। এরপর পূর্ণাঙ্গ রায় আসার আগেই এ রায় বাস্তবায়ন হয়ে যায়। একই বছরের ৩০ জুন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে পঞ্চদশ সংশোধনী পাস হয় সংসদে। রায়ের কপি প্রকাশের আগেই রায় বাস্তবায়ন নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় ওঠে।

ওই রায়ে বলা হয়, সংখ্যাগরিষ্ঠের মতের ভিত্তিতে আপিল মঞ্জুর করা হলো। সংবিধান (ত্রয়োদশ সংশোধনী) আইন, ১৯৯৬ (আইন-১: ১৯৯৬) এখন থেকে বাতিল ও সংবিধান পরিপন্থী ঘোষণা করা হলো। দশম ও একাদশ সংসদ নির্বাচন উল্লিখিত সংশোধনীর অধীনে হতে পারে। কারণ আইনের বহু পুরোনো নীতির কোনো কিছু বেআইনি হলে প্রয়োজনের তাগিদে তা আইনসম্মত, রাষ্ট্র ও জনগণের নিরাপত্তা হচ্ছে সর্বোচ্চ আইন। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে সাবেক প্রধান বিচারপতি ও আপিল বিভাগের বিচারপতিদের নিয়োগের বিধান বাতিলে প্রয়োজনীয় আইন সংশোধনের ক্ষেত্রে সংসদের স্বাধীনতা রয়েছে।

রায়ে আরো বলা হয়, বিদায়ী প্রধান বিচারপতি এবং আপিল বিভাগের বিচারপতিদের বাদ রেখে সংসদ এ সরকার পদ্ধতি সংস্কার করতে পারে।

বাংলাদেশ