বিএনপি-জামায়াতপন্থি ওএসডিরা সংগঠিত হচ্ছেন

বিএনপি-জামায়াতপন্থি ওএসডিরা সংগঠিত হচ্ছেন

আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের শেষ সময় প্রশাসনের বিএনপি ও জামায়াতপন্থি কর্মকর্তাদের একটি বড় অংশ ভেতরে ভেতরে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক তৎপরতায় সক্রিয় হচ্ছেন। আর বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার একজন উপদেষ্টার নেতৃত্বে এদের সংগঠিত করছেন আরও কয়েকজন উপদেষ্টা, কতিপয় সাবেক আমলা ও বিএনপিপন্থি কিছু লোক।

প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা হয়েও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা (ওএসডি) সক্রিয়ভাবে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছেন। অনেকে না বুঝে কেবল ওএসডি থাকার ক্ষোভেই জড়াচ্ছেন সরকারবিরোধী কর্মকাণ্ডে।

সরকারের শুরুর সময় যাদের ওএসডি করা হয়েছে তাদের অনেকেও বর্তমানে সরকারবিরোধিতায় সরাসরি জড়িত বলে জানা গেছে।

এ বিষয়ে সরকারের নতুন মন্ত্রী (দফতর বণ্টন হয়নি) মহিউদ্দিন খান আলমগীর বাংলানিউজকে বলেন, “এটা করা উচিত নয়, প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা হিসেবে নিরপেক্ষভাবে অর্পিত দায়িত্ব পালন করবেন তারা। গোষ্ঠীগত স্বার্থে এ কাজ করলে তা হবে গর্হিত কাজ। প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তাদের এমন কাজ জনগণও মেনে নেবে না।”

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সংবিধান বিশেষজ্ঞ আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক বাংলানিউজকে বলেন, “সরকারি কর্মকর্তা হয়ে এমন কাজ করলে, তা আচরণবিধি লংঘন। সরকারের কাছে যদি তথ্য থাকে চাকুরিবিধি পরিপন্থী কাজ করেছেন, তাহলে ১৯৮৫ সালের শৃঙ্থলাবিধি অনুযায়ী শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে পারে। অথবা ১৯৭৪ সালের অবসর আইন অনুযায়ী চাকরি ২৫ বছর হয়ে গেলে তাদের অবসরে পাঠাতে পারে। তবে কোন অভিযুক্ত ব্যক্তির ব্যপারে পদক্ষেপ নেওয়ার মত দক্ষতা ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা সরকারের আছে বলে মনে হয়না।”

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মন্ত্রিপরিষদ সবিচ মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞা বাংলানিউজকে বলেন, “ওএসডি কর্মকর্তারা চাকরিরত। তারা রাজনৈতিক কোনো কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে পারেন না। এটা সরকারি আচরণবিধির পরিপন্থী। সুনির্দিষ্টভাবে অভিযোগ প্রমাণ হলে নিয়োগকারী মন্ত্রণালয় বা নিয়ন্ত্রণকারী মন্ত্রণালয় সরকারি বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে।”

প্রসঙ্গত, ২০০৯ সালের ৯ নভেম্বর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের গ্রন্থাগার কাম সভাকক্ষে ২০ জন ওএসডি উপসচিব সরকারবিরোধী কর্মকাণ্ডে অংশ নেন। সূত্র মতে, এদের মধ্যে যে ৯ জন প্রত্যক্ষভাবে ওই সময় সক্রিয় ছিলেন, তারাই বিএনপি-জামায়াতের পক্ষে ভেতরে ভেতরে আবারও রাজনৈতিক তৎপরতা চালাচ্ছেন।

আর বিএনপির একজন প্রভাশালী উপদেষ্টা নেতৃত্ব দিয়ে এদের সংগঠিত করছেন। ওই উপদেষ্টার সঙ্গে আছেন প্রশাসনের সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আব্দুল হালিম, স্বরাষ্ট্র সচিব এসএম জহুরুল ইসলাম, সাবেক সচিব ফজলুর রহমান এবং বিএনপির সাবেক উপদেষ্টা এনাম আহমেদসহ আরো কিছু বিএনপি-জামায়াতপন্থি লোকজন। তবে উল্লেখিত ব্যক্তিরা এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

এ প্রসঙ্গে সাবেক জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব আব্দুল হালিম বাংলানিউজের কাছে অভিযোগ অস্বীকার করে জানান, তিনি সরকারবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত নন। তিনি বলেন, “রিটায়ার্ড সিভিল অফিসার্স ফাউন্ডেশন নামের সংগঠনটি কল্যাণমূলক, অরাজনৈতিক।”

‘সংগঠনের ব্যানারে করা বৈঠকে সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের সমালোচনা করা হয়েছিলো রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে’— এ প্রসঙ্গে প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “আলোচনা করলে সমালোচনা হবেই। তা হয়েছিলো সমাজের কল্যাণে, নিরপেক্ষভাবে।” সংগঠনটিকে গবেষণামূলক সংগঠন দাবি করে তিনি আরও জানান, বর্তমানে সরকারবিরোধী কোনো কর্মকাণ্ডে তিনি জড়িত নন। তাছাড়া ওএসডি কর্মকর্তাদের তিনি সংগঠিত করছেন না।

এ বিষয়ে সাবেক সচিব ফজলুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বাংলানিউজকে বলেন, “আমি এর সঙ্গে জড়িত নই।” রিটায়ার্ড সিভিল অফিসার্স ফাউন্ডেশনের সঙ্গেও তার সংশ্লিষ্টতা নেই বলে দাবি করেন তিনি। তাছাড়া বর্তমানে ওএসডি কর্মকর্তাদের সংগঠিত করার সঙ্গে তার সংশ্লিষ্টতা নেই।”

বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টামণ্ডলীর সাবেক সদস্য ও প্রাইভেটাইজেশন কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান এনাম আহমেদ চৌধুরী বলেন, “আমি এ বিষয়ে কিছু জানি না। আমি কোনোকিছুর সঙ্গে নেই।” তিনি আর কোনো কথা বলেননি।

তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব তারেক রহমানকে নিয়ে কবিতা লেখা কর্মকর্তা রফিকুল আই মোহাম্মদ ও জামায়াতপন্থি ওএসডি যুগ্ম সচিব শাহ আলম বকশি জড়িত রয়েছেন সরকারবিরোধী রাজনৈতিক এ তৎপরতায়।

এছাড়া সরকারবিরোধী কর্মকাণ্ড সক্রিয় করতে সাবেক আমলাদের সঙ্গে অনেকেই ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখছেন। অনেকে প্রকাশ্যে সক্রিয় না থাকলেও ভেতরে ভেতরে যোগাযোগ রাখছেন সব সময়। সূত্রমতে, বিভিন্ন আড়াল আবডালে শিখণ্ডিতে সরকারের মেয়দাকাল ঘনিয়ে আসার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বিরোধী এই পক্ষটি ক্রমশঃ জোরদার হয়ে উঠছে।

২০০৯ সালে যে ২০ জন কর্মকর্তা সরকারবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন, তাদের মধ্যে নেয়ামত উল্লাহ ভূঁইয়া, খালিদ মাহমুদ, ইব্রাহিম খলিল, জামাল এ নাসের চৌধুরী, জাফর সিদ্দিক, ওয়াসিম জব্বার, মুজিবর রহমান আল মামুন, মিজানুর রহমান ও আব্দুর রউফ অন্যতম ছিলেন।

সচিবালয় সূত্র মতে, ওএসডি এই কর্মকর্তারা বর্তমানে আবারও সক্রিয় হচ্ছেন সরকারবিরোধী রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে। সচিবালয়ের অনেক কর্মকর্তা মনে করছেন, ওএসডি থাকার কারণে ক্ষুদ্ধ হয়েই সরকারের শেষ সময়ে অনেকেই এদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রয়েছেন।

এদিকে প্রশাসনের কিছু সাবেক কর্মকর্তা সরকারবিরোধী কর্মকাণ্ডে প্রত্যক্ষভাবে না জড়ালেও পরোক্ষভাবে সংগঠিত রয়েছেন বলে মনে করছেন ওয়াকিবহাল মহল। অনেকে মনে করছেন, সরকারের শেষ সময়ে সংগঠিত কর্মকর্তাদের পাশে দাঁড়াতে পারেন বিএনপি-জামায়াতপন্থি আরো অনেকে।

নির্ভরযোগ্য সূত্রের দাবি, উত্তরা ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত ওএসডি যুগ্ম সচিব আব্দুল বারি, চারদলীয় জোট আমলে বগুড়ার জেলা প্রশাসক সফিজ উদ্দিন আহমেদ, বিএনপি নেতা নিতাই চন্দ্রের ভাই রবীন্দ্রনাথ চৌধুরী, চারদলীয় জোট আমলের মীর নাসির হোসেনের পিএস ও কিশোরগঞ্জের সাবেক জেলা প্রশাসক ওএসডি যুগ্ম সচিব সিএম ইউসুফ হোসেন, চারদলীয় জোট সরকার আমলের মন্ত্রী মির্জা আব্বাসের পিএস ড. মোহাম্মদ আলী আকবরসহ অনেকের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে চলমান সরকারবিরোধী রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে। তবে তারা সক্রিয়ভাবে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে এ মুহূর্তে জড়াবেন কিনা তা এখনই স্পষ্ট নয়। তবে সাবেক আমলা ও জুনিয়র ওএসডি কর্মকর্তাদের সঙ্গে তারা যোগাযোগ রাখছেন।

সম্প্রতি সরকারবিরোধী রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সংগঠিত করা এবং যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাতে ত‍ৎপরতা চালাচ্ছেন বলে সাবেক আমলাদের বিরুদ্ধে কিছুদিন আগে অভিযোগ ওঠে। অভিযোগ মতে, বিএনপিপন্থি ৪২ জন সাবেক আমলা গত ১৪ জুলাই নয়াপল্টনের একটি হোটেলে বৈঠক করেন। ‘রিটায়ার্ড সিভিল অফিসার্স ফাউন্ডেশন’ নামের একটি সংগঠনের ব্যানারে বৈঠকটি করা হয়। প্রশাসনকে চাপের মুখে রাখতে এই সংগঠনটি তাদের তৎপরতা চালায়। বৈঠকের পর ১৯ জুলাই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ৩১ জন সাবেক শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তার সচিবালয়ে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। তবে ওই ৪২ জনের মধ্যে বাকিদের সংশ্লিষ্টতা প্রমাণের অভাবে সচিবালয়ে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা থেকে বাদ পড়েন তারা।

বিএনপির এক সাবেক উপদেষ্টাসহ বিএনপি-জামায়াতপন্থি লোকজন ও সাবেক বিএনপিপন্থি আমলারা ‘রিটায়ার্ড সিভিল অফিসার্স ফাউন্ডেশন’ সংগঠনটির আড়াল নিয়ে সরকারবিরোধী কার্যক্রমে সরাসরি প্রক্রিয়া চালাতে ব্যর্থ হলেও বাস্তবতা হচ্ছে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক তৎপরতা বন্ধ হয়নি।

অভিজ্ঞ মহল মনে করছেন, ১৯৯৬ সালের ‘জনতার মঞ্চ’র মতো ‘রিটায়ার্ড সিভিল অফিসার্স ফাউন্ডেশন’ নামের সংগঠনটিকে কার্যকর করার জোর চেষ্টা চালানো হচ্ছে।

এমনকি জনতার মঞ্চের মতো বিকল্প পথে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে ওএসডি কর্মকর্তাদের সরাসরি সম্পৃক্ত করার চেষ্টা আগামীতে জোরদার হবে বলেও তারা মত প্রকাশ করেন।

বাংলাদেশ