সাবেক রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) ওমর ফারুক তালুকদার ও পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের বরখাস্ত হওয়া মহাব্যবস্থাপক (জিএম) ইউসুফ আলী মৃধা আত্মগোপনে রয়েছেন। দুদকের মামলায় গ্রেফতার এড়াতেই তারা জনসমক্ষে আসছেন না বলে জানিয়েছেন তাদের ঘনিষ্ঠরা।
অবৈধভাবে জ্ঞাত-আয়-বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের প্রমাণ পাওয়ায় গত ১৪ আগস্ট ফারুক ও মৃধার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে দুনীতি দমন কমিশন (দুদক)।
এদিকে, দুদকের অনুসন্ধানে পূর্বাঞ্চল রেলে নিয়োগের ক্ষেত্রে জালিয়াতির প্রমাণ পাওয়ায় জিএম মৃধার বিরুদ্ধে আরেকটি মামলা করার অনুমোদন দিয়েছে কমিশন। ফলে দুদকের দুই মামলার আসামি হচ্ছেন নিয়োগ কেলেঙ্কারির হোতা ইউসুফ আলী মৃধা।
দুদক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান বলেন, “কমিটির অনুসন্ধানে পূর্ব রেলে দুর্নীতির প্রাথমিক তথ্য উপাত্ত পাওয়া গেছে। অনুসন্ধান প্রতিবেদনও কমিশনে জমা হয়েছে।”
যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে বা হবে তাদের বিরুদ্ধে দুদক কার্যকর ব্যবস্থা নেবে বলে গোলাম রহমান জানান।
দুদক জানায়, ঘুষ-বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত থাকায় শিগগিরই মৃধাসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে চট্টগ্রামে মামলা করবে দুদক। ফারুক ও মৃধাকে যে কোনো সময় গ্রেফতার করা হতে পারে।
গত মাসের শেষ সপ্তাহে রেলভবনের এক তলায় লিফটের সামনে সর্বশেষ মৃধাকে দেখা গেছে।
এদিকে মন্ত্রী সুরঞ্জিতের সাবেক এপিএস ফারুকের মুঠোফোনে কল করে তার দু`টি নাম্বার বন্ধ পাওয়া যায়।
ফারুকের মোহাম্মদপুরের বাসা পিসি কালচার হাউজিংয়ে খোঁজ নিয়েও তার সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। মোহাম্মদপুরের তার প্রতিবেশীরা জানান, গত কয়েকদিন ধরে ফারুককে দেখা যাচ্ছে না।
রেলভবনে কর্মরত তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মরত কয়েকজন কর্মচারী জানান, রেলভবনে প্রায়ই দেখা যায় ইউসুফ আলী মৃধাকে।
রেল মন্ত্রণালয়ের কতিপয় কর্মকর্তা ও ক্ষমতাসীন দলের রেলওয়ে শ্রমিক লীগের নেতার খোঁজ খবর রয়েছে বলেও জানা গেছে।
দুদক ছাড়াও মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ পূর্ব রেলে নিয়োগ বাণিজ্যের বিষয়ে তদন্ত করে। দু’টি তদন্ত কমিটির মধ্যে একটিতে প্রধান ছিলেন রেলের যুগ্ম মহা-পরিচালক (যান্ত্রিক) মোহাম্মদ শামসুজ্জামান এবং অপরটিতে ছিলেন সম্প্রতি অবসরে যাওয়া সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) মো. শাহজাহান। শামসুজ্জামানের নেতৃত্বে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে রেলের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে ১৮ ক্যাটাগরিতে রেলের জনবল নিয়োগে অনিয়ম পান। ১৮ ক্যাটাগরির মধ্যে ৯টিতেই জনবল নিয়োগের ক্ষেত্রে পূর্বাঞ্চল রেলের তৎকালীন জিএম ইউসুফ আলী মৃধাকে প্রধান অভিযুক্ত করা হয়। তাছাড়া ইউসুফ আলী মৃধা আরও ৭টি ক্যাটাগরিতে অনিয়ম দুর্নীতি করেছেন বলেও প্রতিবেদনে বলা হয়।
অপর দিকে পূর্বাঞ্চল রেলের জ্যেষ্ঠ কল্যাণ কর্মকর্তা গোলাম কিবরিয়াকে ১৪টি ক্যাটাগরিতে প্রধানত দায়ী করা হয়। অতিরিক্ত সিএমই হাফিজুর রহমান চৌধুরীকে ৯টি ক্যাটাগরিতে অনিয়ম দুর্নীতির করেছেন বলে প্রতিবেদনে দায়ী করা হয়। অপর অভিযুক্তরা সিসিআরএনবি আমিনুর রশিদ, এসপিও শামসুজ্জামান, ডিইএন-১ আরমান হোসেন, জেপিও-৩ মাহফুজুর রহমান, এসিও-১ আবু সাঈদ আহমেদ, জেপিও-২ শফিকুর রহমান, ডিইএন-৩ আবিদুর রহমান ও জেডব্লিউও এম আবদুল্লাহ। রেলের তদন্ত প্রতিবেদনে যাদের দোষী হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়েছে প্রত্যেকেই বিভিন্ন মহলে তদবির করেছন বলে জানা গেছে।
এদিকে, রেলের কর্মকর্তা, কর্মচারী, চট্টগ্রামের একাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকসহ মোট ৪৫ জন ব্যক্তিকে দুদকের জিজ্ঞাসাবাদ শেষে চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে প্রতিবেদন জমা দেয় অনুসন্ধান কর্মকর্তারা।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ২০১০ সালে পূর্ব রেলে নিয়োগ-প্রক্রিয়া শুরু হয়ে এ বছরের এপ্রিল পর্যন্ত চলে। ২৪টি শ্রেণিতে এক হাজার ১৭৭ পদের বিপরীতে এ পর্যন্ত এক হাজার ১১৭ জন নিয়োগ পেয়েছেন। এসব নিয়োগে রেলওয়ের কর্মচারীদের জন্য সংরক্ষিত পদ, মুক্তিযোদ্ধা বা তাদের সন্তানদের জন্য পদসহ মহিলা/অনগ্রসর জেলা/আনসার-ভিডিপি/উপজাতি/এতিম/প্রতিবন্ধীসহ বিভিন্ন ধরনের কোটার ক্ষেত্রে কোনো নিয়মনীতি মানা হয়নি। দুর্নীতির মাধ্যমে শুধু ঘুষের পরিমাণের ওপর নির্ভর করে বিভিন্ন পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
দুদকের উপপরিচালক মো. আবু সাঈদের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি দল পূর্ব রেলে নিয়োগ বাণিজ্যের বিষয়ে অনুসন্ধান করে।
দুদকের এ প্রতিবেদনে মৃধা ছাড়াও যাদের বিরুদ্ধে মামলা হবে, তারা হলেন নিয়োগ কমিটির আহ্বায়ক ও পূর্ব রেলওয়ের অতিরিক্ত যান্ত্রিক প্রকৌশলী হাফিজুর রহমান এবং সদস্যসচিব ও জ্যেষ্ঠ ওয়েলফেয়ার কর্মকর্তা গোলাম কিবরিয়া। পূর্বাঞ্চলের ২৫ কর্মকর্তাসহ ৫০ জনকে আসামি করা হতে পারে বলে জানা গেছে।
চলতি বছরের ৯ এপ্রিল রাতে রাজধানীর পিলখানায় বিজিবির সদর দপ্তরে মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের ব্যক্তিগত সহকারী ওমর ফারুক তালুকদারের গাড়িতে ৭০ লাখ টাকা পাওয়া যায়। ওই গাড়িতে ফারুক ও মৃধার সঙ্গে রেল পুলিশের কমান্ড্যান্ট এনামুল হকও ছিলেন। এ সময় বিজিবির সদর দফতরে গাড়িটি আটক করা হলে পরদিন ঘটনা জানাজানি হয়ে যায়। গাড়িতে থাকা টাকা পূর্বাঞ্চলের নিয়োগ-বাণিজ্যের বলে অভিযোগ ওঠে। দেশজুড়ে এ ঘটনায় হইচই পড়ে যায়। রেলমন্ত্রীর পদ ছাড়তে হয় সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে। এ ঘটনায় অনুসন্ধান করে দুদক। জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদের অভিযোগে ফারুক মৃধার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে।