স্বতন্ত্র প্রার্থীদের এক ভাগ ভোটারের সম্মতি নেওয়ার বিধান থাকছে না

স্বতন্ত্র প্রার্থীদের এক ভাগ ভোটারের সম্মতি নেওয়ার বিধান থাকছে না

জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের এক ভাগ ভোটারের সম্মতি স্বাক্ষর নেওয়ার বিধান বাতিল করে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)।

আনুষ্ঠানিকভাবে ২৯ আগস্ট থেকে এ কাজ শুরু হয়েছে। এ নিয়ে প্রায় প্রতিদিনই বৈঠক করছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ ৫ কমিশনার।

বৈঠকে আরপিওর বিভিন্ন বিধি নিয়ে আলোচনা করে তা সংশোধন এবং পরিবর্তন, পরিবর্ধনের বিভিন্ন দিক নিয়ে কথা বলেছেন তারা।

এরই অংশ হিসেবে আগের আরপিও তৈরিতে যেসব ইসি কর্মকর্তা জড়িত ছিলেন তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছে ইসি।

রোববার বেলা আড়াইটায় ইসি সম্মেলন কক্ষে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিব উদ্দীন আহমদ, নির্বাচন কমিশনার আবু হাফিজ, মোহাম্মদ মোবারক, ব্রি. জে. (অব.) জাবেদ আলি ও মো. শাহ নেওয়াজ, ইসি সচিব ড. মোহাম্মদ সাদিকসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এতে অংশ নেন।

গত ২৯ আগস্ট থেকে এ বিষয়ে নিয়মিত ইসি বৈঠক অনুষ্ঠিত হচ্ছে।

বৈঠকের আগে এক নির্বাচন কমিশনার বাংলানিউজকে বলেন, “এবারের সংশোধনে আরপিও থেকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের এক ভাগ ভোটারের সম্মতি স্বাক্ষর নেওয়ার যে বিধান রয়েছে, তা বিলুপ্তি করতে যাচ্ছে বর্তমান কমিশন।”

তিনি বলেন, “বর্তমান ইসি মনে করে, ভোটের আগে এক ভাগ ভোটারের সম্মতি স্বাক্ষর গ্রহণ প্রার্থী ও ভোটারের গোপনীয়তা নষ্ট করে। তাই আগে যেমন একজন প্রার্থী একজন প্রস্তাবক ও একজন সমর্থক থাকলে নির্বাচনে অংশ নিতে পারতেন, সে অবস্থাকেই পুনর্বহাল করবে ইসি।”

আগের কমিশন স্বতন্ত্র প্রার্থীদের নির্বাচনে অনুৎসাহিত করার লক্ষ্যে এ বিধি পাল্টিয়ে এক ভাগ ভোটারের স্বাক্ষর সংগ্রহের বিধি আরোপ করে।

এর আগে নির্বাচন কমিশনার শাহনেওয়াজ বলেন, “আমরা প্রথমে আরপিও (১০৭২, সংশোধিত ২০০৮) পড়ে দেখছি। এছাড়া আগের কমিশনের করে যাওয়া আরপিও সংশোধনের খসড়াও আমলে নেওয়া হচ্ছে।”

তিনি বলেন, “আমরা আগে নিজেরা পাঁচজন বিদ্যমান আরপিও পড়ে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করব এবং প্রয়োজনে সংশোধনের উদ্যোগ নেবো।”

নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ের আইন কর্মকর্তা হেলাল উদ্দীন এ বিষয়ে বলেন, “আগে এ কমিশন আরপিও নিজেরা পড়ে দেখছেন। পরে তারা এর প্রয়োজনীয় সংশোধনীর ব্যাপারে আমাদের বললে আমরা প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করব।”

২০১১ সালে অনুষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে চলা ইসির সংলাপে ইসি সচিব ড. মোহাম্মদ সাদিক দলগুলোকে লেখা চিঠিতে আরপিও সংশোধনের প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করেন এভাবে, “সংশোধিত গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২ এর ভিত্তিতে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন (২০০৮) অনুষ্ঠানকালে কিছু কিছু ধারা প্রয়োগের ক্ষেত্রে জটিলতা/সমস্যা দেখা দেয়। আগামী নির্বাচনের পূর্বে এই সমস্ত ধারায় সামঞ্জস্য বা প্রয়োগের লক্ষ্যে সহজ করা প্রয়োজন।”

আরপিও সংশোধনের ক্ষেত্রে আগের কমিশন পরামর্শক নিয়োগের মাধ্যমে একটি খসড়া তৈরি করে বলে কমিশন সূত্র জানায়। তবে সংশ্লিষ্টরা এ খসড়া গ্রহণ না করায় হুদা কমিশন ইসির নিজস্ব কর্মকর্তাদের মাধ্যমে আর একটি খসড়া প্রস্তাবনা তৈরি করে। পরে আইন মন্ত্রণালয় বর্তমান কমিশনের কাছে তা মতামত নেওয়ার জন্য ফেরত পাঠায়।

আরপিও সংশোধনের লক্ষ্যে বিগত নির্বাচন কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবগুলো হলো: (১) কোনো আদালত ও ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক পলাতক ঘোষিত এবং মনোনয়নপত্র বা হলফনামায় সজ্ঞানে মিথ্যা তথ্য প্রদান বা তথ্য গোপনকারীদের সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের অযোগ্য ঘোষণা; (২) বিদ্যমান পদ্ধতির পাশাপাশি (সম্ভব হলে) ইভিএম পদ্ধতির ব্যবহার; (৩) নির্বাচনী ব্যয়সীমা ১৫ লাখের পরিবর্তে ২৫ লাখ টাকা বৃদ্ধি; (৪) হলফনামায় মিথ্যা তথ্য প্রদানের দায়ে নির্বাচন-পরবর্তীকালে সংসদ সদস্যপদ বাতিল; (৫) নির্বাচনকালে সরকারের মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে পূর্বালোচনা ব্যতীত নির্বাচনসংক্রান্ত কোনো সিদ্ধান্ত না নেওয়ার বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি ইত্যাদি।

নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে করা সুপারিশগুলো হলো: (১) ‘না-ভোটের’ পুনঃপ্রবর্তন; (২) সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন রাজনৈতিক দলের তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের দ্বারা নির্ধারণ বা অন্তত তাদের তৈরি প্যানেলের ভিত্তিতে চূড়ান্তকরণের বাধ্যবাধকতার পুনঃপ্রবর্তন; (৩) নির্বাচন কমিশন কর্তৃক প্রার্থীদের হলফনামায় প্রদত্ত তথ্য এবং নির্বাচনী ব্যয়ের হিসাব যাচাই-বাছাই করার বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি; (৪) রাজনৈতিক দল প্রদত্ত নির্বাচনী ব্যয়ের হিসাব কমিশন কর্তৃক যাচাই-বাছাইপূর্বক মিথ্যা তথ্য প্রদানকারী দলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ; (৫) নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে সংসদ নির্বাচনে সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারীদের হলফনামাসহ একটি আবেদন দাখিল ও কমিশন কর্তৃক প্রকাশ; (৬) মনোনয়নপত্র অনলাইনে দাখিল; (৭) বিরুদ্ধ হলফনামা দাখিল; (৮) সংরক্ষিত মহিলা আসনের ক্ষেত্রে মনোনয়নপত্রের সঙ্গে হলফনামা ও আয়কর বিবরণী দাখিল; (৯) সকল স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনকে প্রদান; (১০) দলের প্রাথমিক সদস্যদের নাম ওয়েবসাইটে প্রকাশ ও নিয়মিত আপডেট করার বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি; (১১) নির্বাচন কমিশনের আর্থিক স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ ইত্যাদি সম্পর্কিত বিধান সংশ্লিষ্ট আইনে অন্তর্ভুক্তিকরণ। এ ছাড়া সদাচরণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলের সংস্কার, নির্বাচনে টাকার খেলা বন্ধ এবং রাজনীতিতে ব্যবসায়ীদের অনুপ্রবেশ রোধের লক্ষ্যেও আইনের সংস্কার আবশ্যক।

সংস্কার ধারণাগুলো একত্রিত এবং চূড়ান্ত করে এগুলো নিয়ে রাজনৈতিক দল, গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সংলাপে বসা নির্বাচন কমিশনের জন্য অদূর ভবিষ্যতে একটি বড় চ্যালেঞ্জ।

তবে তত্ত্বাবধায়ক বা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারব্যবস্থা নিয়ে একটি রাজনৈতিক সমঝোতা না হলে বিরোধী দল কমিশনের আহ্বানে সাড়া দেবে বলে মনে হয় না। তাই কমিশন আমাদের বিরাজমান অসহযোগিতা ও কলহপ্রবণ রাজনীতির কাছে অনেকটা জিম্মি হয়ে পড়েছে।

নির্বাচন কমিশনের সামনে আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জের উৎস হলো নির্বাচনী আইন মানার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলের বিরাজমান অনীহা। যেমন, নিবন্ধিত দলের অঙ্গ/সহযোগী সংগঠন এবং বিদেশি শাখা থাকা আইনের লঙ্ঘন। রাজনৈতিক দলের, বিশেষত ক্ষমতাসীনদের অঙ্গ/সহযোগী সংগঠনের তাণ্ডবে আমাদের শিক্ষাঙ্গনে আজ চরম অরাজকতা বিরাজ করলেও এবং প্রধান দুটি দলের বৈদেশিক শাখার বিশৃঙ্খল আচরণের কারণে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি চরমভাবে ক্ষুন্ন হলেও, দলগুলো আইনের বিধান উপেক্ষা করেই চলছে। তাই সফল হতে হলে কমিশনকে কঠোর এবং দলগুলোকে আইন মানতে বাধ্য করতে হবে।

বাংলাদেশ