‘আমিই সবচেয়ে ঘৃণিত ব্যক্তি’ সংসদে ক্ষমা চাইলেন অর্থমন্ত্রী

‘আমিই সবচেয়ে ঘৃণিত ব্যক্তি’ সংসদে ক্ষমা চাইলেন অর্থমন্ত্রী

সংসদ সদস্যদের তোপের মুখে পড়ে হলমার্ক কেলেঙ্কারির টাকার অঙ্কটা তেমন বড় কোনো অঙ্কই না বলে বেফাঁস মন্তব্য করার দুদিন পর সংসদে ক্ষমা চাইলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত। তিনি এ বিষয়ে বলেন, “আমার মনে হয় এ মুহূর্তে দেশে সবচেয়ে ঘৃণিত ব্যক্তি আমি । আমি এজন্য কারুর বিরুদ্ধে অভিযোগ করবো না।”

এ নিয়ে তোফায়েল আহমেদসহ সংসদ সদস্যদের তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে অবশেষে বৃহস্পতিবার  নিজের করা মন্তব্যের জন্য ক্ষমা চাইলেন অর্থমন্ত্রী। এ সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে উপস্থিত ছিলেন। সভাপতির আসনে ছিলেন ডেপুটি স্পিকার শওকত আলী।

অর্থমন্ত্রী বলেন, “চার হাজার কোটি টাকা কোনো বড় অংক নয়, আমার এমন কথায় ভুল বোঝাবুঝি তৈরি হয়েছে। অনেকে বলছেন, এই কথায় দুর্নীতি উৎসাহিত হচ্ছে। আপনারা আমাকে ক্ষমা করবেন।“

এর আগে নূর আফরোজ আলী উত্থাপিত সিদ্ধান্ত প্রস্তাবের জবাবে অর্থমন্ত্রী হলমার্ক কেলেঙ্কারি নিয়ে কথা বলেন। অর্থমন্ত্রী হলমার্ক কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িতদের ‘উত্তম শাস্তি’ দেওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেন। একই সঙ্গে তিনি সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ শুধু মাত্র ৬৫ কোটি টাকা ঋণ ছাড়া এ বিষয়ে কিছু জানে না বলায় ব্যাংকটির উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের দায়ী করেন।

তার এ বক্তব্যের পর আওয়ামী লীগের সিনিয়র সদস্য আব্দুল জলিল, তোফায়েল আহমেদ, আব্দুল মতিন খসরু, জাতীয় পার্টির মুজিবুল হক চুন্নু, ওয়ার্কার্স পার্টির রাশেদ খান মেনন অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যের তীব্র সমালোচনা করেন।

হলমার্ক কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িতদের এখন পর্যন্ত কেন শাস্তি দেওয়া হলো না তার জন্য অর্থমন্ত্রীকে প্রশ্নবিদ্ধ করেন তারা। একই সঙ্গে এ বিষয়ে অর্থমন্ত্রীর তরফ থেকে আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দেবারও দাবি ওঠে সংসদে। সোনালী ব্যাংকের চেয়ারম্যানের মেয়াদ বাড়ানোরও সমালোচনা করেন সাংসদরা। বর্তমান পরিচালনা পর্ষদ বহাল রাখলে তার দায়িত্ব সরকারের ওপর বর্তাবে বলেও মন্তব্য করেন তারা। সংসদ সদস্যরা এ ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্তসহ পরিচালনা পর্ষদকে বরখাস্ত করার দাবিও জানান।

সরকারের কোনা অংশ এ কেলেঙ্কারিতে জড়িত কিনা সেটাও খতিয়ে দেখার জন্য বলা হয়।

তাদের সমালোচনার জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, “জড়িতদের গ্রেফতার করার চিন্তা-ভাবনা রয়েছে। একটু অপেক্ষা করুন, তদন্ত শেষ হলেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

তিনি বলেন, “আমি এ কেলেঙ্কারির মূল উদঘাটনের চেষ্টা করে যাচ্ছি।”

পরিচালনা পর্ষদের বিষয়ে তিনি বলেন, “ব্যাংকের এমডি সম্পর্কে আমি কিছুই জানতাম না। পত্রিকা পড়ে জেনেছি। আমার পক্ষে জানা সম্ভবও নয়। আলাদিনের চেরাগ থাকলে জানা সম্ভব হতো।”

তিনি বলেন, “তদন্ত চলছে। মন্ত্রণালয়ের কেউ জড়িত থাকলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

অর্থমন্ত্রী বক্তব্যের আগে পয়েন্ট অব অর্ডারে আব্দুল জলিল বলেন, “পর্ষদ এই ঋণ সম্পর্কে জানে না। আমি একটা ব্যাকেংর সঙ্গে জড়িত। কোনো ঋণ পর্ষদের অনুমোদন ছাড়া হয় না। পর্ষদের সম্মতি ছাড়া এত টাকা ঋণ কিভাবে অনুমোদন হলো?

তিনি বলেন, “চার হাজার কোটি টাকা অর্থমন্ত্রীর কাছে কিছু না। কত টাকা হলে কিছু হবে, জানতে চাই। দুই হাজার কোটি টাকা পাওয়া যাবে, সেটা কবে? বাকি দুই হাজার কোটি টাকার কি হবে?

এর পর সাবেক আইনমন্ত্রী আব্দুল মতিন খসরু বলেন, “সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা শাখায় গত পাঁচ বছর বদলি হয় না। নিয়ম হলো তিন বছর পর পর বদলি। দুই বছর অডিট হয়নি। নিয়ম ছিলো প্রতিবছর অডিট করা। সোনলি ব্যাংক কমার্শিয়াল ব্যাংক না, এটা রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ব্যাংক। এখানে আমরা আমানত রাখি।”

তিনি হতাশা প্রকাশ করে বলেন, “এখন পর্যন্ত কাউকে গ্রেফতার করা হলো না। তাদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হোক। এত টাকা কোথায় গেল জাতি জানতে চায়।”

পরে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা মণ্ডলীর সদস্য তোফায়েল আহমেদ বলেন, “জনগণের মতামতের মূল্য দিতে হবে। অর্থমন্ত্রী স্বীকার করেছেন এটি একটি জালিয়াতি। আমরা নির্বাচনী এলাকায় যাই। জনগণ প্রশ্ন করে। একটি বিশৃঙ্খলাকে কেন্দ্র করে যেভাবে লেখালেখি হচ্ছে তার নিরসন হওয়া উচিত। এই দায়ী কেলেঙ্কারির দায় পরিচালনা পর্ষদ এড়াতে পারে না।”

সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে (এমডি) কেন অপসারণ করার হয়নি তা জানতে চান তিনি।

জাতীয় পার্টির মুজিবুল হক চুন্নু এ কেলেঙ্কারির সঙ্গে কারা জড়িত তা খুঁজে বের করার দাবি জানান। একই সঙ্গে তিনি বিষয়টি নিয়ে নিরপেক্ষ তদন্ত দাবি করেন।

পরে রাশেদ খান মেনন বলেন, “বিষয়টি আরো স্পষ্ট করা উচিত। কিছু টাকার হিসাব পর্ষদ জানতো। বাকী টাকার খবর কে জানতো। হলমার্কের এমডির ব্যবসার ইতিহাস আমাদের জানা প্রয়োজন। মুদি দোকান থেকে এই প্রতিষ্ঠানটির উৎপত্তি হয়েছে। আজ এই প্রতিষ্ঠানটি বিশাল সম্পত্তির মালিক। সরকারের কেউ এই কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত আছে কিনা তা খুঁজে বের করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া উচিত।”

মহাজোট সংসদ সদস্যদের সমালোচনার পর অর্থমন্ত্রী বলেন, “পর্ষদ ভাঙার ক্ষমতা আমার নেই। যে তদন্ত চলছে তা সুষ্ঠুভাবে অগ্রসরের জনব্য পর্ষদ বহাল রাখা প্রয়োজন। তিনজন সদস্য নিয়ে পর্ষদ পুনর্গঠন করেছি। ৯ তারিখ পর্র্ষদ চলে যাবে।”

তিনি বলেন, “আমাদের ব্যবস্থাপনা অবশ্যই দুর্বল ছিলো। আমাকে অনেকে বিদেশ থেকে টেলিফোন করে। তারা বলছে, আমাদের ব্যাংকিং সেক্টর ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। আমি তাদেরকে বলেছি, আমাদের ব্যাংকিং খাত ধ্বংস হয়নি। অর্থনীতির স্বাস্থ্য ভালো।”

এর আগে নূর আফরোজ আলীর সিদ্ধান্ত প্রস্তাবের জবাব দিতে গিয়ে মুহিত বলেন, “এ ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে যথেষ্ট তথ্য-প্রমাণ বের করার চেষ্টা করা হচ্ছে। ব্যাংকের কর্মকর্তাদের যোগসাজশে অনেক টাকা পাচার হয়েছে। এটা নিয়ে সোনালী ব্যাংক অভ্যন্তরীণ তদন্ত করে। সেখানে অনেক কিছুই ছিলো না। একই সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংক একটি তদন্ত করে। যেসব দুষ্টু লোক জড়িত তাদের শাস্তি দেওয়ার সুপারিশ করে।”

তিনি বলেন, “পরিচালনা পর্ষদ শুধু মাত্র ৬৫ কোটি টাকার ঋণের বিষয়ে জানতো।”

বাংলাদেশ