তারেক-মিশুক স্মরণে চট্টগ্রামে বহুমাত্রিক শিল্পকর্ম প্রদর্শনী

তারেক-মিশুক স্মরণে চট্টগ্রামে বহুমাত্রিক শিল্পকর্ম প্রদর্শনী

বিশাল ক্যানভাসজুড়ে দীর্ঘ পথে হেঁটে গেছেন কেউ। স্পষ্ট ছাপ রয়ে গেছে। পথের সন্ধানে নেমে ভুল পথে পা বাড়িয়েছেন কেউ, হয়ে গেছেন আকাশের তারা, পথহারা। সাদা কাপড়ে লেগে আছে ছোপ ছোপ লাল রক্ত, কেউ হয়েছেন ‘কাগজের ফুল’! সদ্য ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনায় কাতরাচ্ছেন কালো চাদরে ঢাকা পথচারী। কেউ বা আবার মৃত্যুভয় ঝেড়ে ফেলে পরিচর্যা করছেন সেই পথের।

নানা বয়সী দর্শক অবাক বিস্ময়ে দেখছিলেন একেকটি শিল্পকর্ম। কেউ হয়ে পড়ছিলেন স্মৃতিকাতর। তরুণ-তরুণীদের মধ্যে কারও কারও চোখ ছলছল করছিল। ছোট্ট শিশুরা বারবার শিহরিত হয়েছিল দুর্ঘটনার বীভৎস বাস্তবতা আর আর্ত চিৎকারে।

প্রবাসী কবি আলম খোরশেদ অনেকক্ষণ ধরে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিলেন শিল্পকর্মগুলো। প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে বলেন, আমার মনে হয়েছে এখানে দুটি আলাদা বিষয় রয়েছে। প্রথমত শিল্পীরা সম্মিলিতভাবে শ্রদ্ধা নিবেদন করলেন তারেক ও মিশুকের প্রতি। আমি বলব তারা বড় দায়িত্ব পালন করেছে। দ্বিতীয়ত শিল্পীরাই পথের সন্ধান করেছে, খানিকটা সম্ভাবনার স্ফূরণ পাওয়া গেছে। এটাও একটি বড় কাজ।

খ্যাতিমান চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদ ও সাংবাদিক-সিনেমাটোগ্রাফার মিশুক মুনীর স্মরণে পথের খোঁজে পথে নেমেছেন চট্টগ্রামের নবীন-প্রবীণ শিল্পীরা। স্থাপনা, ভাস্কর্য, পেইন্টিং, পারফরমিং ও ভিডিও আর্টের মতো বহুমাত্রিক শিল্পকর্ম প্রদর্শনীতে উপজীব্য বিষয় হিসেবে প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে ‘পথ’।

শুক্রবার বিকেল ৫টা থেকে এমএম আলী সড়কের জেলা শিল্পকলা একাডেমী গ্যালারিতে শুরু হয়েছে ‘পথ’ শীর্ষক বিশেষায়িত প্রদর্শনী। শিল্পকর্মবিষয়ক সংগঠন ইয়াপ্রি’র আয়োজিত ৩ দিনের এ প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছে ৩৮ শিল্পীর শিল্পকর্ম।

গ্যালারির নিচতলায় তারেক মাসুদের তোলা অব্যবহৃত দৃশ্য (স্টক শর্ট) কোলাজ করে নতুন মাধ্যমে দর্শকদের সামনে তুলে ধরেছেন চিত্রসমালোচক ও শিল্পী ঢালী আল মামুন।

এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরের মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনাকে স্মরণ করে চারকলার শিক্ষার্থীদের এ আয়োজন। আমি তারেক মাসুদের তোলা কিছু অব্যবহৃত দুর্লভ শর্ট কোলাজ করে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।

প্রদর্শনী প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সাম্প্রতিক বিশ্বে নতুন যে শিল্পকলার অনুশীলন হচ্ছে তা-ই সম্মিলিতভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছে শিক্ষার্থীরা।

দোতলায় উঠতেই দেখা মেলে টায়ারের ভেতর দিয়ে শৈল্পিক কায়দায় ছড়িয়ে দেওয়া সাদা জমিনের কাপড়ে রক্তলাল ছোপ দিয়ে তৈরি রিপন সাহার শিল্পকর্ম ‘কাগজের ফুল’। কাজল দেবনাথের সিলভার রঙের স্থাপত্য শিল্পকর্ম ‘যান্ত্রিক অযান্ত্রিক’। বেশ কিছু মস্তিষ্ক-রোবটের মুখ ও মুখোশ ব্যবহার করে বেশ জটিল পরিস্থিতি তুলে ধরেছেন শিল্পী।

প্রিয়জনের স্মৃতি জাগানিয়া চশমা, ফটোগ্রাফ, চুড়ি, øো’র কৌটা এসবের মুনশিয়ানা ব্যবহারে পথের সন্ধান করেছেন শিল্পী মঞ্জুরুল আলম।

দর্শকের চোখ আটকে যেতে দেখা গেছে আলপ্তগীন তুষারের ‘বানানা সিরিজ’, কিংশুক দাশ চৌধুরীর ‘রেড হিট’, রোকসানা বাহার রাতুর ‘মৃত্যুরথ’, ফরহাদ উদ্দীন মাসুমের ‘বহমানতার পথ’, আবিদুজ্জামানের ‘শিরোনামহীন ৬’, সঞ্জয় চক্রবর্তীর ‘একটি পথের আত্মজীবনী’, ফারাহ নাজ মুনের ‘এক্সপ্রেস অর হোয়াট’ এসব ছবিতে।

উদ্বোধনী কেমন সাড়া পেয়েছেন জানতে চাইলে প্রদর্শনীর অন্যতম উদ্যোক্তা পলাশ ভট্টাচার্য বলেন, ছুটির দিন হওয়ায় প্রথম দিনই প্রচুর দর্শক সমাগম হয়েছে। তা ছাড়া এ প্রদর্শনী দুই কীর্তিমানের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের পাশাপাশি নবীন-প্রবীণ শিল্পীদের মধ্যে যোগসুত্র স্থাপন করেছে। পাশাপাশি তারেক মাসুদের কয়েকজন বন্ধু সহকর্মী এসেছিলেন, যা আমাদের ভীষণ অনুপ্রাণিত করেছে।

২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রতিদিন বিকেল ৪টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত ‘পথ’ শীর্ষক এ প্রদর্শনী সবার জন্য উন্মুক্ত থাকবে বলে জানান তিনি।

প্রদর্শনীতে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছে ‘ইস্পাহানি’ ও ‘রুপালি ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড’।

উল্লেখ্য, ২০১১ সালের ১৩ আগস্ট চলচ্চিত্রের লোকেশন দেখে ফেরার পথে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় স্বপ্নচারী মানুষ তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীর মারা যান। প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা নিবেদনের উদ্দেশ্যে চট্টগ্রামের নবীন-প্রবীণ শিল্পীরা সম্মিলিতভাবে এ প্রদর্শনীতে অংশ নেন।

বিনোদন