সারাবিশ্বে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনকে (ন্যাম) অধিকতর শক্তিশালী, কার্যকর ও ঐক্যবদ্ধ করার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বৃহস্পতিবার তেহরানে ওআইসি সম্মেলন কেন্দ্রে ১৬তম ন্যাম সম্মেলনের মূল অধিবেশনে বক্তৃতাকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ আহ্বান জানান।
তিনি বলেন, “ন্যামের প্রতিষ্ঠাতারা পারস্পরিক শ্রদ্ধা, সর্বোচ্চ সমতা, ন্যায়বিচার ও আইনের শাসনভিত্তিক বিশ্ব ব্যবস্থা গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেছিলেন। এ লক্ষ্য অর্জনে আমাদের নেতৃবৃন্দকে ন্যামের সামগ্রিক অঙ্গীকারের মূলনীতি বাস্তবায়নে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে।”
তিনি বলেন, “জাতিসংঘের বিভিন্ন পর্যায়ে নিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক ও সুষম সিদ্ধান্ত নিশ্চিত করার জন্য ন্যাম নেতৃবৃন্দকে পরিবর্তিত বিশ্ব সংস্থা এবং অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে একযোগে কাজ করতে হবে।”
প্রধানমন্ত্রী বলেন, “অবিচার বৈশ্বিক সংঘাতের মূল কারণ, বিধায় ন্যামকে সর্বক্ষেত্রে এবং এর সদস্য রাষ্ট্রে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ওপর জোর দিতে হবে। কেবল ন্যায়বিচারই শান্তি ও উন্নয়ন নিশ্চিত করতে পারে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও জনগণের ক্ষমতায়নের মাধ্যমেই তা অর্জন করা যেতে পারে।”
শেখ হাসিনা বলেন, “ষাটের দশকে ন্যামের কর্মকাণ্ড ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান এবং উপনিবেশভূক্ত দেশগুলোর স্বাধীনতার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। অপরদিকে আজ গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার, স্বাধীনতা, মানবাধিকার ও জলবায়ু বিপর্যয়ের ওপর জোর দেয়া হচ্ছে। এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পরিবর্তিত জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে ন্যামকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে।”
প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আল কুদস আল শরিফকে রাজধানী করে একটি সার্বভৌম ও স্থিতিশীল ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় ন্যামের দাবির প্রতি বাংলাদেশের দৃঢ় সমর্থন রয়েছে।”
তিনি ন্যামের প্রতি অভিন্ন ও পৃথক দায়দায়িত্বের নীতির ভিত্তিতে গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণ হ্রাস, জলবায়ু পরিবর্তন প্রশমন ও অভিযোজন এবং সবুজ প্রযুক্তি হস্তান্তরে জলবায়ু তহবিল গঠনের জন্য একটি বৈশ্বিক চুক্তির লক্ষে একযোগে কাজ করার আহ্বান জানান।
শেখ হাসিনা বলেন, “জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও বাংলাদেশ খাদ্যে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করলেও অন্যত্র খরা, খাদ্য ঘাটতি ও খাদ্য মূল্য বৃদ্ধির খবর খুবই উদ্বেগজনক।”
উন্নয়নের জন্য অভিবাসনকে এ শতাব্দীর অন্যতম বৃহৎ আন্তঃরাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বর্ণনা করে তিনি বলেন, “ন্যামভুক্ত দেশগুলো বিশ্বের সংখ্যাগরিষ্ঠ অভিবাসী শ্রমিক যোগান দিয়ে থাকে। এদের পাঠানো রেমিট্যান্স দারিদ্র্য বিমোচনে অবদান রাখছে।”
প্রধানমন্ত্রী ন্যামকে গ্যাট-এর ‘মুড সিক্স’ বাস্তবায়নে সোচ্চার এবং বিশেষ করে নারী ও নিরাপদ অভিবাসন ও নিরাপত্তা বিধানের উদ্যোগ গ্রহণের ওপর জোর দেন।
শেখ হাসিনা জানান, তার সরকার দারিদ্র্য, ক্ষুধা, বৈষম্য ও বঞ্চনার অবসান, টেকসই প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত এবং মানবসম্পদ উন্নয়ন ও সন্ত্রাস নির্মূলের মাধ্যমে বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও বিচার ব্যবস্থা শক্তিশালী করতে নিরলসভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
বৈশ্বিক লক্ষ্য অর্জন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “বাংলাদেশ জাতিসংঘের বিগত সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ‘জনগণের ক্ষমতায়ন ও উন্নয়ন’ মডেল উপস্থাপন করেছে, যা বিশ্ব সংস্থার নতুন ভিশনের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হতে পারে।”
প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমি বিশ্বাস করি এই মডেল দেশে দেশে এবং বিশ্বব্যাপী ন্যায়বিচার, সাম্য ও গণতন্ত্র জোরদারে সহায়তার মাধ্যমে উন্নয়ন, অগ্রগতি, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও স্থায়ী শান্তি প্রক্রিয়া এগিয়ে নেবে।”
বাংলাদেশের সন্ত্রাসবাদ বরদাশত না করার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করে তিনি বলেন, “সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ন্যামের অবস্থানকে আমরা সমর্থন করি এবং এ সমস্যার মূলোৎপাটনে সব ধরনের সহযোগিতা প্রদানে অঙ্গীকারাবদ্ধ।”
এ প্রসঙ্গে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের নির্মম হত্যাকাণ্ড ও ২০০৪ সালে তার প্রাণহানির অপচেষ্টার উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, “সন্ত্রাসবাদের মতো অপরাধমূলক কাজে রাষ্ট্রীয় শক্তির মদদ বন্ধ করতে হবে।”
তিনি টেকসই সমৃদ্ধি অর্জনে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক ও যোগাযোগ প্রতিষ্ঠায় তার সরকারের প্রচেষ্টার উল্লেখ করে বলেন, “যোগাযোগের মাধ্যমে বৃহত্তর বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা গড়ে উঠলে সকলেই লাভবান হবে এবং বিভিন্ন দেশ সমৃদ্ধ ও স্থিতিশীল অঞ্চল হিসেবে প্রতিষ্ঠার পথে এগিয়ে যাবে।”
ন্যায় এবং গণতান্ত্রিক ও আর্থ-সামাজিক অধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ফিলিস্তিন এবং অন্যান্য অনুরূপ গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা সমাধানের আহবান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “ইসরাইল ফিলিস্তিন জনগণের ওপর জুলুম, অবিচার, হত্যা, নির্যাতন ও অমানবিক আচরণের মতো বর্বরতা চালিয়ে যাচ্ছে।”
চলতি মাসে রামাল্লায় ফিলিস্তিন সংক্রান্ত ৫ সদস্যের ন্যাম কমিটির মন্ত্রী পর্যায়ের নির্ধারিত বৈঠক অনুষ্ঠানে বাধা দেয়ার জন্য ইসরাইলের নিন্দা জানিয়ে তিনি বলেন, “এ ধরণের পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লংঘন।”
শেখ হাসিনা জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের ১৬তম শীর্ষ সম্মেলনের মাধ্যমে সংস্থার সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণের জন্য ইরানের প্রেসিডেন্টে মাহমুদ আহমদিনেজাদকে আন্তরিক অভিন্দন জানান। তিনি জোটের বিদায়ী চেয়ারপার্সনকেও ধন্যবাবাদ জানান।