সুপ্রিম কোর্টের একজন বিচারপতি সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন এবং এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে প্রধান বিচারপতির প্রতি আহবান জানিয়ে দেওয়া স্পিকারের রুলিংকে অকার্যকর ও আইনগত ভিত্তিহীন বলে দেওয়া হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করবে সরকার।
সংসদের নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, আসন্ন অধিবেশনের প্রথম দিনেই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করার কথা অনেকে সংসদ সদস্যই স্পিকারকে জানিয়েছেন। তাদের কারো কাছে বিষয়টি নিয়ে স্পিকার কোনো মন্তব্য করেননি। তবে আসন্ন অধিবেশনে সংসদ সদস্যদের ওপর বিষয়টি তিনি ছেড়ে দিতে পারেন।
এ রায়ের বিরুদ্ধে লিভ টু আপিল করার বিষয়টি পৃথকভাবে নিশ্চিত করেছেন আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ ও ভারপ্রাপ্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এম কে রহমান।
আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বৃহস্পতিবার বিকেলে সংসদ ভবনে স্পিকারের সঙ্গে বৈঠক শেষে বাংলানিউজকে জানান, ‘‘সরকার এ বিষয়ে আপিলের চিন্তা-ভাবনা করছে।’’
অন্যদিকে ভারপ্রাপ্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এম কে রহমান বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় জানান, এ ব্যাপারে তিনি আইনমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছেন।
বৃহস্পতিবার আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ ও এম কে রহমান প্রায় দুই ঘণ্টা স্পিকারের সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন। এ সময় দফতরবিহীন মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তও উপস্থিত ছিলেন। তবে এ বৈঠকের বিষয়ে কেউই কিছু জানাতে রাজি হননি।
স্পিকার কার্যালয়ের নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, ওই বৈঠকে আইনমন্ত্রী আপিল করার বিষয়ে সরকারের সিদ্ধান্তের বিষয়টি স্পিকারকে জানান। বৈঠকে স্পিকার বলেছেন, ‘‘এটি সরকারের সিদ্ধান্ত। এখানে আমার কিছু বলার নেই।’’
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে তিনটি পথ
এদিকে দফতরবিহীন মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত জানিয়েছেন, স্পিকারের রুলিং ও আদালতের রায় নিয়ে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তাতে তিনটি পথ খোলা রয়েছে। এগুলো হলো- সরকার এবিষয়ে আপিল করতে পারে, রায় রিভিউ করার জন্য আবেদন করা অথবা স্পিকার বিষয়টি সংসদের ওপর ছেড়ে দিতে পারেন।
তবে স্পিকারের সঙ্গে বৈঠকের বিষয়ে তিনি কিছু বলতে রাজি হননি।
সুরঞ্জিত বলেন, “স্পিকার হাউজে (সংসদ) এসে বলতে পারেন, তিনি যে রুলিং দিয়েছেন, তাতে কোনো কাজ হয়নি। এখন হাউজই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারে।”
আদালতের রায়কে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত আখ্যায়িত করে তিনি আরো বলেন, “বিচার বিভাগ স্বাধীন হতে পারে কিন্তু সার্বভৌম নয়। আর সংসদ সার্বভৌম, তার মানে জনগণ সার্বভৌম। জনগণের সার্বভৌমত্ব নিয়ে কেউ খেলা করলে জনপ্রতিনিধিরা তা ছেড়ে দেবেন না। সংসদের সার্বভৌমত্ব কারো ছেড়ে দেওয়া যাবে না।”
সংবিধানের ৭৮ অনুচ্ছেদের উল্লেখ করে এ সংবিধান বিশেষজ্ঞ আরো বলেন, “সংসদকে দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে। আদালত সংবিধানের ওই অনুচ্ছেদ নিয়ে কিছু করতে পারে না। এটা সংবিধানের একটা স্তম্ভ।
হাইকোর্টের রায়ে যা ছিলো
স্পিকারের রুলিংয়ের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে দায়ের করা রিট আবেদনের নিষ্পত্তি করে ২৪ জুলাই রায় দেন বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি এবিএম আলতাফ হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ। সোমবার হাইকোর্ট পূর্ণাঙ্গ অভিমত ও নির্দেশনাসহ রায় প্রকাশ করেন।
এম কে রহমান বলেন, ‘‘কোনো রুল বা কারো বক্তব্য না শুনেই হাইকোর্ট যে অবজারভেশন দিয়েছেন, তা সঠিক হয়নি। এ আদেশে অনেক অসঙ্গতি রয়েছে।’’
সোমবার হাইকোর্টের দেওয়া রায়ে সংবিধানের বিধান, সংসদের কার্যপ্রণালী বিধি, বিরোধীয় ঘটনা, স্পিকারের রুলিং ও উচ্চ আদালতের আইনের ব্যাখ্যার আলোকে আদালত অভিমতে বলেছেন, ‘‘স্পিকারের তর্কিত অভিমত যে, ‘একজন বিচারক সংবিধানের ৭৮ (১) অনুচ্ছেদ লঙ্ঘন করেছেন এবং এ বিষয়ে কি ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে মাননীয় প্রধান বিচারপতি ভেবে ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন’- এর কোনো আইনগত কোনো ভিত্তি নেই এবং আইনের দৃষ্টিতে অস্তিত্বহীন। স্পিকারের ওই অভিমতের কোনো আইনগত কার্যকারিতা নেই।’’
আদালত বলেছেন, ‘‘স্পিকারের অভিমত যে, ‘একই সঙ্গে বলবো, আদালতের এ ধরনের আচরণের কি করণীয় থাকতে পারে মাননীয় প্রধান বিচারপতি সে বিষয়টি ভেবে যে ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন—।’ এটি সংবিধানের ৯৬(৫) অনুচ্ছেদের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। স্পিকারের রুলিং সংবিধান ও সংসদের কার্যপ্রণালী বিধির সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ।’’
হাইকোর্ট রায়ে বলেন, ‘‘রাষ্ট্রের কোনো অঙ্গ যাতে সংবিধানে দেওয়া তার ক্ষমতার সীমা লঙ্ঘন না করে তা দেখার দায়িত্ব সুপ্রিম কোর্টের ওপর ন্যস্ত রয়েছে। বিশেষ অধিকারের সীমা সংবিধানের ৭৮ অনুচ্ছেদের ব্যাখ্যার ওপর নির্ভর করে। এই ব্যাখ্যার ক্ষমতা একমাত্র সুপ্রিম কোর্টের এখতিয়ারাধীন। সংসদ তার এই বিশেষ অধিকার নির্ণয়ের ক্ষেত্রে চূড়ান্ত বিচারক হিসাবে নিজেকে দাবি করতে পারে না।’’
আদালত বলেছেন, ‘‘সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদ জনগণকে সার্বভৌম ক্ষমতা দিয়েছে। জনগণ সংবিধানের মাধ্যমে রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গের ক্ষমতার সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছে। সংবিধানের সীমার মধ্যে থেকে সংসদকে আইন প্রণয়নের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।’’
সংবিধানের ৭৮ (১) অনুচ্ছেদের ব্যাখ্যা দিয়ে আদালত অভিমতে বলেছেন, ‘‘মাননীয় বিচারপতি সংসদের কার্যধারা চ্যালেঞ্জ করে সংবিধানের ৭৮ (১) অনুচ্ছেদ ভঙ্গ করেছেন, এটি বলা যায় কি? সংবিধানের কার্যধারা চ্যালেঞ্জ করে কোনো মামলা দায়ের করা হলে সেক্ষেত্রে সেই মামলাটি সংবিধানের ৭৮(১) অনুচ্ছেদে বাধা।’’
আদালত বলেছেন, ‘‘মাননীয় স্পিকারের রুলিংয়ে এমন কিছু দেখা যায় না যে, মাননীয় বিচারক সংসদের কোনো কার্যধারা চ্যালেঞ্জ করে তার আদালতে বা কোনো আদালতে কোনো প্রশ্ন তুলেছেন। এমনকি সংসদের কার্যধারা চ্যালেঞ্জ করে কোনো মামলা দায়ের বা বিচারাধীন থাকার বিষয়টিও স্পিকার তার রুলিংয়ে বলেননি। সুতরাং সংবিধানের ৭৮(১) অনুচ্ছেদের কোনো লঙ্ঘন হয়নি।’’
আদালত রায়ে আরও বলেন, ‘‘সড়ক ভবনের মামলায় সংসদের কার্যধারা চ্যালেঞ্জ করা হয়নি।’’
আদালত সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ পর্যালোচনা করে অভিমতে আরও বলেছেন, ‘‘সংবিধানের ৯৬ (৫) অনুচ্ছেদ রাষ্ট্রপতিকে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে বা অন্য কোনো সূত্র থেকে এই তথ্য পেয়ে যে একজন বিচারক শারীরিক বা মানসিক অসামর্থের কারণে তার পদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে অযোগ্য হয়ে পড়তে পারেন বা গুরুতর অসদাচারণের জন্য দোষী হতে পারেন সেক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি কাউন্সিলকে বিষয়টি সম্পর্কে তদন্ত করতে এবং এর তদন্ত ফল জানানোর জন্য নির্দেশ দিতে পারেন। কাউন্সিল যদি তদন্তে এই অভিমত ব্যক্ত করেন যে, ওই বিচারক দায়িত্ব পালনে অযোগ্য হয়েছেন বা গুরুতর অসদাচরণের জন্য দোষী হয়েছেন, তাহলে রাষ্ট্রপতি ওই বিচারককে তার পদ থেকে অপসারণ করবেন।’’
সংসদের কার্যপ্রণালী বিধি পর্যালোচনা করে আদালত রায়ের অভিমতে বলেন, ‘‘সুপ্রিম কোর্টের ও অন্যান্য বিচারকরা সংসদের সমালোচনা থেকে মুক্ত। বিচারকদের বিষয়ে সংসদের অপ্রত্যাশিত বিষয়ে আলোচনা করা যাবে না। বিচারিক দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে একজন বিচারকের আচরণ সংসদের বিবেচনাধীন বিষয় হতে পারে না। সংবিধান ও কার্যপ্রণীলী বিধির বিধান অবজ্ঞা করে এ ধরনের আলোচনা বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে ক্ষুন্ন করতে পারে।’’
আদালত বলেছেন, ‘‘আমাদের আইন প্রণেতাদের নিঃসন্দেহে আইন প্রণয়নের ক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু এই ক্ষমতা সংবিধান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এবং এই ক্ষমতা সংবিধানে দেওয়া এখতিয়ারের মাধ্যমে প্রয়োগ করা যেতে পারে। সংবিধানের শ্রেষ্ঠত্ব একটি স্বাধীন বিচার বিভাগ দ্বারা সুরক্ষিত। ক্ষমতার স্বাতন্ত্রীকরণ বিষয়ে ব্যাখ্যাকারীও বিচার বিভাগ।’’
আদালত বলেছেন, ‘‘বিশেষ অধিকার ও দায়মুক্তির উদ্দেশ্য হচ্ছে, আইন প্রণেতাদের স্বাধীনতা। সংসদীয় গণতন্ত্রের কার্যকরিতার জন্যও এই স্বাধীনতা প্রয়োজন।’’
হাইকোর্ট রায়ে আরও বলেন, ‘‘রাষ্ট্রের সকল অঙ্গ তাদের কর্তৃত্ব, এখতিয়ার ও ক্ষমতা সংবিধান থেকে প্রাপ্ত। সাংবিধানিক বিষয়ে রাষ্ট্রের বিচার অঙ্গ চূড়ান্ত বিচারক এবং এ বিষয়ে এর কর্তৃত্ব ও এখতিয়ার সংবিধানের মূল স্তম্ভের একটি গুরুত্বপূর্ণ ও অবিচ্ছেদ্য অংশ। সংবিধান পরিবর্তন করা যায়, কিন্তু অমান্য করা যায় না।’’
সংবিধানের পঞ্চম ও ষষ্ঠ ভাগের উল্লেখ করে আদালত বলেছেন, ‘‘আইনসভা ও বিচার বিভাগ এই দুটি অঙ্গ সংবিধানের সৃষ্টি।’’
আদালত রায়ে বলেছেন, ‘‘আইনসভা ও বিচার বিভাগ এই দু’টি অঙ্গসহ নির্বাহী বিভাগ বিদ্বেষপ্রসূত হয়ে নয়, সমঝোতার ভিত্তিতে কাজ করা উচিত। এতে করে দেশের গণতান্ত্রিক পদ্ধতির উন্নয়ন, বিকাশ ও স্থিতিশীল হবে।’
আদালত রায়ে বলেন, ‘‘আমরা ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি গ্রহণ করেছি। আইন প্রণয়নের ক্ষমতা জাতীয় সংসদের, নির্বাহী ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রী ও তার মন্ত্রিসভার এবং বিচারিক ক্ষমতা আদালতের। তিনটি অঙ্গের প্রতিটিকে অন্য অঙ্গের বিধানের প্রতি লক্ষ্য রেখে স্বতন্ত্রভাবে কাজ করতে হবে। স্বাভাবিক কার্যপরিচালনার স্বার্থে একটি অঙ্গকে অপর অঙ্গ থেকে প্রধান্য দেওয়া যেতে পারে না। সংবিধান হচ্ছে এই তিনটি অঙ্গের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। প্রতিটি অঙ্গ তার কাজের ক্ষেত্রে নিজস্ব জায়গায় স্বাধীন। যদি কোনো অঙ্গ তার ক্ষমতার সীমা অতিক্রম করে তাহলে সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদ তার বিচারিক বিবেচনার ক্ষমতা আদালতের ওপর ন্যস্ত করেছে। আইন প্রণেতাদের বিচারিক ক্ষমতা গ্রহণ অসাংবিধানিক।’’
সংবিধানের ৯৪(৪) অনুচ্ছেদ উল্লেখ করে আদালত বলেন, ‘‘সংবিধানের বিধানের আলোকে প্রধান ও বিচারকরা বিচারিক ক্ষেত্রে স্বাধীন।’’
সংসদের ক্ষমতা, এখতিয়ার ও বিশেষ অধিকার বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার ক্ষমতা সুপ্রিম কোর্টের রয়েছে কিনা এ বিষয়ে ভারতের উচ্চ আদালতের রাজা রামপাল বনাম স্পিকার, লোকসভা মামলার রায়ের উদ্ধৃতি দিয়ে হাইকোর্ট তার অভিমতে বলেছেন, ‘‘যে কার্যধারা চরম বেআইনি ও অসাংবিধানিক তা বিচারিক নিরীক্ষার বাইরে নয়। সিদ্ধান্ত, আদেশ, অভিমত, উপসংহার সীমিত ক্ষেত্রে বিচারিক বিবেচনার আওতাধীন। সুপ্রিম কোর্ট তার দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে অযৌক্তিক কার্য বাতিল করতে দ্বিধাবোধ করবে না।’’
ওই মামলায় রায়ের বরাত দিয়ে আদালত আরও বলেন, ‘‘রাষ্ট্রের অন্য অঙ্গের মতো সংসদও সংবিধানের বিধানের অধীন এবং এর বিধানের আলোকে দায়িত্ব পালন করবে। সাংবিধানিক সীমাবদ্ধতার বিপরীত কোনো কাজ বা কার্যক্রম বাতিল হবে। কিন্তু সংসদের কার্যপ্রণালী বিষয়ে বিচারিক বিবেচনা সীমিত।’’
আদালত লর্ড ডেনিংয়ের ‘হোয়াট নেক্সট ইন দি ল’ গ্রন্থের উদ্ধৃতি দিয়ে রায়ের অভিমতে বলেছেন, ‘‘ক্ষমতা, অধিকার ও দায়মুক্তির ক্ষেত্রে সংসদ যা করেছে এবং করতে পারে তার প্রতি আমাদের সম্মান প্রদর্শন করতে হবে। কিন্তু আমাদেরকে আইনের কাঠামোতে বেঁধে দিতে হবে যে, এই ক্ষমতার যেন অপব্যবহার ও অপপ্রয়োগ না হয়।’’
সংসদের রেওয়াজ ও পদ্ধতি বিষয়ে পুরোধা কাউলের ‘প্রাকটিস এন্ড প্রসিডিউর অব পার্লামেন্ট’ গ্রন্থের উদ্ধৃতি দিয়ে হাইকোর্ট অভিমতে বলেছেন, ‘‘দেশ ও এর জনগণের শাসনের ক্ষেত্রে সকল বিষয়ে আলোচনা ও বক্তব্য রাখার চূড়ান্ত অধিকার আইন প্রণেতা ও সংসদ সদস্যদের রয়েছে। সংসদের বাক স্বাধীনতা সংসদীয় গণতন্ত্রের একটি অপরিহার্য্য বিষয়।’’
আদালত বলেছেন, ‘‘কিন্তু এই স্বাধীনতার ওপর স্বআরোপিত কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এর মধ্যে একটি সীমাবদ্ধতা হচ্ছে, সংসদের ফ্লোরে বিচারাধীন কোনো বিষয়ে আলোচনা পরিহার করা উচিত। যাতে করে বিচারের বাইরের কোনো বিষয়ে আদালতের কার্যধারা প্রভাবিত না হয়। এটি একটি সুপ্রতিষ্ঠিত নীতি যে, বিচারাধীন বিষয় সব সময় আলোচনার বাইরে।’’
ভারতের উচ্চ আদালতের বচ্চন সিং বনাম ইউনিয়ন অব ইন্ডিয়া মামলায় বিচারপতি ভগবতীর রায়ের বরাত দিয়ে আদালত বলেছেন, ‘‘একটি গণতান্ত্রিক সংসদ আইন প্রণয়ন করতে পারে, কিন্তু এর ক্ষমতা সীমাহীন হবে না। নির্বাহী ও আইনসভার সীমাহীন ক্ষমতা থেকে জনগণকে রক্ষা করতে একটি স্বাধীন বিচার বিভাগ থাকা উচিত।’’
আইনজ্ঞ আলেকজান্ডার হেমিলন্টনের উদ্ধৃতি দিয়ে আদালত রায়ে বলেছেন, ‘‘বিচার করার ক্ষমতা যদি আইনসভা ও নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা না হয়, তাহলে কোনো স্বাধীনতা থাকবে না।’’
বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বিষয়ে হযরত ওমরের (রা.) কার্যকলাপের উদাহরণ টেনে হাইকোর্ট বলেন, ‘‘হযরত ওমর কার্যত প্রশাসন থেকে বিচার বিভাগ পৃথক করেছিলেন। তিনি আবু দারদাকে (রা.) মদিনা, আবু মুসা আল আশারী (রা.) কুফা এবং সুরাইয়াকে (রা.) বসরার বিচারক নিয়োগ করে পবিত্র কোরআন ও সুন্নাহর আলোকে সকলকে আইনের চোখে সমান বিবেচনা করে স্বাধীনভাবে বিচার করার জন্য ফরমান জারি করেছিলেন।’’
আদালত রায়ে বলেন, ‘‘রিট আবেদনটি দায়ের করার উদ্দেশ্য হচ্ছে, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সমুন্নত রাখা।’’
হাইকোর্ট পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের ফারুক আহমেদ লেঘারী বনাম ফেডারেশন অব পাকিস্তান মামলার বরাত দিয়ে বলেন, ‘‘সংবিধান একটি জীবিত বৃক্ষের মতো, দেশ ও জনগণের উন্নয়নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সময়ের বিবর্তনে এটি বেড়ে ওঠে ও ফুলে ফলে ভরে ওঠে।’’
আইনবিদ টমাস হাক্সলের উদ্ধৃতি দিয়ে আদালত অভিমতে বলেন, ‘‘আইন-আদালতের দায়িত্ব হলো কি সঠিক তা খুঁজে বের করে নিদ্বিধায় তা বলা।’
চার্লস ডিকেন্সের উদ্ধৃতি দিয়ে আদালত বলেন, ‘‘আদালতের দায়িত্ব হলো, আইন কি তা বলা, কি হওয়া উচিত তা নয়।’’
মাসদার হোসেন মামলায় সুপ্রিম কোর্টের রায়ের বরাত দিয়ে আদালত বলেন, ‘‘সংবিধানের ৯৪ (৪) ও ১১৬ (ক) অনুচ্ছেদ বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে মূল স্তম্ভ হিসাবে ঘোষণা করেছে এবং একে ধংস করা যায় না।’’
আদালত বলেন, ‘সংবিধানের ৯৪ (৪) অনুচ্ছেদ এবং কার্যপ্রণালী বিধি সংসদ সদস্যদের বাক স্বাধীনতার ওপর সীমা আরোপ করেছে। আমাদের দেশে আইন প্রণেতারা সংবিধান ও সাংবিধানিক আদালতের দ্বারা বাধ্য এবং সাংবিধানিক আদালত সংসদের প্রণীত আইনকে অসাংবিধানিক হলে অবৈধ ঘোষণা করতে পারেন।’’
যেভাবে এ পরিস্থিতি
২৯ মে জাতীয় সংসদ অধিবেশনে সড়ক ভবন সরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে বক্তব্য দেন সংসদ সদস্যরা। এ নিয়ে ৫ জুন সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী কিছু মন্তব্য করেন। একই দিন সংসদে কয়েকজন সদস্য এর তীব্র প্রতিবাদ করেন এবং সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করে ওই বিচারপতিকে অপসারণের দাবি জানান। এর ১৩ দিনের মাথায় ১৮ জুন স্পিকার অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদ সংসদে একটি রুলিং দেন।
রুলিংয়ে স্পিকার বলেন, ‘‘আদালতের এ ধরনের আচরণে কি করণীয় থাকতে পারে মাননীয় প্রধান বিচারপতি সে বিষয়টি ভেবে যে ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন তাতে আমাদের সমর্থন থাকবে। এর ফলে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করা হয়তো সম্ভব হবে।’’
ওই রুলিংকে চ্যালেঞ্জ করেই আইনজীবী একেএম শফিউদ্দিন ১৮ জুলাই রিট আবেদনটি দায়ের করেন।
গত ১৮ জুলাই এ রিট আবেদনের ওপর বিচারপতি নাঈমা হায়দার ও বিচারপতি মুহাম্মদ খুরশিদ আলম সরকারের বেঞ্চ শুনানি গ্রহণে বিব্রতবোধ করেন। এর পাঁচদিন পর ২৩ জুলাই সকালে আবার এ রিট আবেদনটি বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি এবিএম আলতাফ হোসেনের বেঞ্চে উপস্থাপন করা হয়। এরপর ২৩ জুলাই বিকালে ও ২৪ জুলাই মঙ্গলবার সকালে রিটের শুনানি অনুষ্ঠিত হয়।
আদালতে রিট আবেদনকারীপক্ষে শুনানি করেন ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ ও আখতার ইমাম। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বিশ্বজিত রায়।