হলমার্কের ঋণ জালিয়াতির ঘটনায় দুদকের অনুসন্ধানে সরকারের প্রভাবশালী একাধিক ব্যক্তির নাম উঠে এসেছে। এরমধ্যে সরকারের এক উপদেষ্টা হলমার্ক কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন(দুদক)। হলমার্ক ও সোনালী ব্যাংকের সন্দেহভাজন অভিযুক্তদের জিজ্ঞাসাবাদ শেষে সরকারের এক উপদেষ্টা ও একজন প্রতিমন্ত্রীও দুদকের মুখোমুখি হতে পারেন।
তবে এ জন্য দুদক সরকারের সর্বোচ্চ মহলের সঙ্গে কথা বলে `গ্রিন সিগনাল` পেলেই তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে বলে সূত্র জানায়।
রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক থেকে দুর্নীতির মাধ্যমে ৩ হাজার ৬০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনায় দুদকের অনুসন্ধাম টিম চলতি মাসে সোনালী ব্যাংকের ১৭জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। এসব জিজ্ঞাসাবাদে ব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তা নিজেদের `নির্দোষ` দাবি করে দুদককে জানিয়েছেন, সরকারের একজন উপদেষ্টা পুরো বিষয়ে হলমার্কের পক্ষে ব্যাংকের ওপর প্রভাব বিস্তার করেছেন।
সোনালী ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা দুদককে জিজ্ঞাসাবাদ চলাকালীন সময়ে সরাসরি নাম উল্লেখ করে জানিয়েছেন, সরকারের স্বাস্থ্য উপদেষ্টা মোদাচ্ছের আলীকে সোনালী ব্যাংকের রুপসী বাংলা শাখায় বেশ কয়েকবার দেখেছেন। এসময় দুদকের অনুসন্ধান টিম সোনালী ব্যাংকের ওই কর্মকর্তার কাছে জানতে চান কবে থেকে স্বাস্থ্য উপদেষ্টাকে ওই শাখায় যাতায়াত করতে দেখা গেছে?
ওই কর্মকর্তা দুদককে জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন, ২০০৯ সাল থেকে উপদেষ্টাকে ওই শাখায় যাতায়াত করতে দেখা গেছে। সোনালী ব্যাংকের ওই কর্মকর্তা দুদককে বলেন-“রুপসী বাংলা শাখায় সরকারের স্বাস্থ্য উপদেষ্টার এক আত্মীয় আছে এ খবর সোনালী ব্যাংকের রুপসী বাংলা শাখার প্রায় সকলেই জানে।“
দুদকের অনুসন্ধান টিম তখন তার কাছে রুপসী বাংলা শাখায় মোদাচ্ছের আলীর আত্মীয়ের নাম জানতে চায়। সোনালী ব্যাংকের সে কর্মকর্তা তখন জানায়, তার নাম মেহেরুন নেসা মেরী। তিনি আছেন সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার হিসেবে।
হলমার্ককে ঋণ দিতে একজন উপদেষ্টা ছাড়া একজন প্রতিমন্ত্রীও সোনালী ব্যাংকে মৌখিক সুপারিশ করেছেন এমন অভিযোগ রয়েছে।
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে দুদক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান বলেন, “বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধান চলছে। কিছু বলতে চাই না। কারো নামও নয়। এখন কিছু বলা ঠিকও হবে না।“
নাম প্রকাশ করলে তদন্তে বিঘ্ন ঘটতে পারে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “সময় হলে সব জানবে দেশবাসী। কে জড়িত আর কে জড়িত নয় তা দুদকের অনুসন্ধান প্রতিবেদনে বেরিয়ে আসবে।“
অপরাধী যত বড় হোক অভিযোগ প্রমাণিত হলে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না বলে দুদক চেয়ারম্যান জানান।
এদিকে দুদকের একজন ঊর্ধতন কর্মকর্তা বাংলানিউজকে উপদেষ্টার নাম না উচ্চারণ করে বলেন, “একজন উপদেষ্টার বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছে। তবে তিনি হলমার্ককে ঋণ দিতে লিখিতভাবে ব্যাংককে সুপারিশ করেছেন এমন ডকুমেন্ট দুদক এখনও (বুধবার পর্যন্ত) সংগ্রহ করতে পারেনি।“
একজন মন্ত্রীও সোনালী ব্যাংকের শীর্ষ কর্তাদের ফোনে হলমার্ককে ঋণ দিতে অনুরোধ করেছেন এমন অভিযোগ দুদকে এসেছে বলে তিনি জানান। এসব অভিযোগ দুদক খতিয়ে দেখবে বলে জানান তিনি।
দুদক জানায়, সরকারের যেসব প্রভাবশালী ব্যক্তিদের নাম দুদকে এসেছে তাদের শিগগিরই জিজ্ঞাসাবাদ করবে না দুদক। সোনালী ব্যাংক ও হলমার্ক গ্রুপের শীর্ষ কর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদ শেষে সরকারের প্রভাবশালীদের মুখোমুখি হতে চায় দুদক। দুদক জানায়,তদন্তে যাদের নাম আসবে পর্যায়ক্রমে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
দুদক জানায়, সোনালী ব্যাংকের এমডি হুমায়ুন কবির, ডিএমডি মাইনুল হক ও এডিএমডি মোঃ সাইফুল হাসানসহ শীর্ষ কর্মকর্তাদের কয়েকজনকে আগামী সপ্তাহে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। এরইমধ্যে দুদকের তদন্ত টিম ব্যাংকটির সাবেক এমডিকে নোটিশ না করে সরাসরি তার সঙ্গে কথা বলেছে বলে জানা গেছে। তাকে টেলিফোনে দুদকে হাজির হতে বলা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক অভিযোগ করেছে, সোনালী ব্যাংকের শেরাটন শাখা, বর্তমান রূপসী বাংলা হোটেল থেকে ২০১০-১২ অর্থবছরে মোট তিন হাজার ৬০০ কোটি টাকা জালিয়াতির মাধ্যমে আত্মসাত করা হয়েছে। এর মধ্যে হলমার্ক গ্রুপ একাই আত্মসাত করে ২ হাজার ৬৮৬ কোটি ১৪ লাখ টাকা। এছাড়া এই ব্যাংকের গুলশান ও আগারগাঁও শাখা থেকেও ১৪০ কোটি টাকা করে ঋণ দেওয়া হয়েছে, যা তাদের ঋণসীমার অনেক বেশি। ঋণ কেলেঙ্কারি অন্যতম প্রধান হোতা হলমার্ক গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তানভীর মাহমুদ ও একই গ্রুপের চেয়ারম্যান তানভীরের স্ত্রী জেসমিন ইসলামকে ২ সেপ্টেম্বর জিজ্ঞাসাবাদ করবে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
দুদকের জ্যেষ্ঠ উপ-পরিচালক মীর জয়নুল আবেদিন শিবলির নেতৃত্বে গঠিত ৬ সদস্যের উচ্চপর্যায়ের তদন্ত টিম এরই মধ্যে সোনালী ব্যাংক রূপসী বাংলা হোটেল শাখার ম্যানেজার আজিজুর রহমানসহ ১৭ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। তাদের কাছ থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্যও বেরিয়ে এসেছে।
অর্থমন্ত্রীর কাছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চিঠিতে বলা হয়, সোনালী ব্যাংকের সংঘটিত অনিয়মগুলোর প্রকৃতি অত্যন্ত গুরুতর। ব্যাংকের পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনার অনেক স্তর থাকা সত্ত্বেও বিষয়টি কারও নজরে আসেনি, তা কোনক্রমেই বিশ্বাসযোগ্য নয়। এটা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান যে সংশ্লিষ্ট উর্ধতন কর্তৃপক্ষের যোগসাজশে বা সম্মতিতে জালিয়াতির মাধ্যমে এই বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাত করা হয়েছে। আর এ ঘটনায় সমগ্র ব্যাংক খাতের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলেছে।
দুদকের অনুসন্ধান টিম মনে করছে, যে অভিনব কৌশলে হলমার্ক ব্যাংক থেকে অর্থ লোপট করে নেয় তা ব্যাংকিং ইতিহাসে একটি নজিরবিহীন ঘটনা। সরকারের প্রভাবশালী মহলের চাপ ছাড়া দুর্নীতির মাধ্যমে এ পরিমাণ ঋণ পাওয়া সম্ভব নয় বলে জানায় দুদক।