খরায় বিশ্বের তিনটি বড় উৎপাদনকারী দেশে গমের ফলন কমে যাওয়ায় সম্ভাব্য খাদ্য সঙ্কটের বিষয়টি মাথায় রেখে চাল রপ্তানির সিদ্ধান্ত থেকে আপাতত সরে এসেছে সরকার।
খাদ্যমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক রোববার জানান, আগামী নভেম্বরের আগে ধান বা চাল রপ্তানি করা হবে না। নভেম্বরে কৃষকের ঘরে আমন মৌসুমের ধান ওঠার পর এ ব্যাপারে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
এছাড়া বিশ্বে খাদ্য উৎপাদনকারী অন্য দেশগুলোর খাদ্য পরিস্থিতিও পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। জরুরি প্রয়োজনে ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড ও ভারত থেকে চাল ও গম আমদানি করে দেশের খাদ্য মজুদ বাড়ানোর পরিকল্পনাও করছে সরকার।
বিশ্বে গম উৎপাদনকারী গুরুত্বপূর্ণ তিন দেশ যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও ইউক্রেনে প্রচণ্ড খরার কারণে এবার উৎপাদন কমে গেছে। আর এ কারণে চলতি বছর বিশ্বব্যাপী খাদ্যসঙ্কটের আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাদেশের খাদ্য পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে মন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক বলেন, “আমাদের দেশে খাদ্যের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে। বাংলাদেশ প্রধান খাবার ভাত। গমের উৎপাদন কমলেও চাল বা ধানের উৎপাদন তেমন কমেনি। থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামের মতো চাল উৎপাদনকারী দেশগুলো এখনো ধানে উদ্বৃত্ত। তারা চাল বিক্রি করতেও চাইছে।”
তবে দেশে পর্যাপ্ত মজুদ থাকায় এই মুহূর্তে সরকার চাল কিনছে না বলে জানান মন্ত্রী।
“জরুরি প্রয়োজন হলে আমরা দ্রুত এসব দেশ থেকে চাল কিনতে পারব। এছাড়া দীর্ঘদিন পর এবার ভারত গম রপ্তানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সেখানে গমের উৎপাদনও বেশি হয়েছে। ফলে বাংলাদেশে খাদ্যমন্দার কোনো আশঙ্কা দেখছি না।”
অবশ্য এবার বর্ষা মৌসুমে দেশের উত্তরাঞ্চলে পর্যাপ্ত বৃষ্টি না হওয়ায় ধানের উৎপাদন কিছুটা ব্যাহত হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন খাদ্যমন্ত্রী।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে গত বোরো মৌসুমে পর্যাপ্ত ধান উৎপাদন হয়েছে। দেশের চাহিদা মিটিয়ে উদ্বৃত্ত চাল রপ্তানির কথা ভাবা হচ্ছিল। কিন্তু অনেক দেশে খরায় উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার সরকার এখনই চাল রপ্তানি করবে না।
সরকারি হিসাব অনুযায়ী, গত বছর দেশে প্রায় সাড়ে তিন কোটি মেট্রিক টন ধান ও গম উৎপাদন হয়েছে। এর মধ্যে তিন কোটি ৪৪ লাখ টন ধান এবং ১০ লাখ টন গম।
এ সময় দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা ছিল প্রায় দুই কোটি ৮৬ লাখ টন। এই হিসাবে উদ্বৃত্ত খাদ্যশস্যের পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে প্রায় ৬০ লাখ টন।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দেশের খাদ্য গুদামগুলোতে বর্তমানে ১৪ লাখ ৩৫ হাজার মেট্রিক টন খাদ্যশস্য মজুদ রয়েছে। এর মধ্যে ১১ লাখ ২৩ হাজার মেট্রিক টন চাল এবং তিন লাখ ১২ হাজার মেট্রিক টন গম। এছাড়া বন্দরে চার হাজার মেট্রিক টন চাল এবং ১২ হাজার মেট্রিক টন গম খালাসের অপেক্ষায় রয়েছে।
গত বছর এই সময়ে সরকারি খাদ্য গুদামগুলোতে মজুদ ছিল ১৩ লাখ ২১ হাজার ৫২০ মেট্রিক টন খাদ্যশস্য। এর মধ্যে চাল ছিল ১০ লাখ ৪৪ হাজার ৯০০ টন; গম ছিল দুই লাখ ৭৬ হাজার ৬৪০ টন।
গত ১ জুলাই থেকে ২২ অগাস্ট পর্যন্ত দুই লাখ ৬৪ হাজার মেট্রিক টন খাদ্যশস্য আমদানি করা হয়েছে। এর মধ্যে সরকারি খাতে এক লাখ ৪০ হাজার মেট্রিক টন এবং বেসরকারি খাতে এক লাখ ২৪ হাজার মেট্রিক টন খাদ্যশস্য এসেছে।
বোরো মওসুমে সরকার ১০ লাখ মেট্রিক টন চাল কেনার ঘোষণা দিলেও এ পর্যন্ত কিনতে পেরেছে ছয় লাখ ৬১ হাজার ৭২০ মেট্রিক টন। গুদামে জায়গা না থাকায় গত মে মাসে শুরু হওয়া এ কার্যক্রমের লক্ষমাত্রা পূরণ হচ্ছে না। ফলে চালকল মালিকদের গুদামে চাল রাখা হচ্ছে বলে আব্দুর রাজ্জাক জানান।
কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর ৫৬ লাখ ৩০ হাজার হেক্টর জমিতে এক কোটি ২৮ লাখ ৩৬ হাজার টন আমন চাষের লক্ষমাত্রা নেওয়া হয়েছে।
গত বছর তিন মৌসুমেই ধানের উৎপাদন ভালো ছিল। এতে দেখা যায় তিনটি মৌসুমে মোট ধান উৎপাদন হয়েছে তিন কোটি ৪৪ লাখ ১৩ হাজার ৩৬৪ টন। এর মধ্যে আমন উৎপাদন হয় এক কোটি ৩৪ লাখ ৬৩ হাজার ৩৬৪ টন। এছাড়া ২৩ লাখ ৩৩ হাজার টন আউশ এবং এক কোটি ৮৬ লাখ ১৭ হাজার টন বোরো উৎপাদন হয়।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, দেশে বছরে গমের চাহিদা ৩০ থেকে ৩৫ লাখ টন। এ বছর দেশে উৎপাদন হয়েছে ১০ লাখ টন গম। সরকারি গুদামে মজুদ রয়েছে তিন লাখ ১৭ হাজার টন গম।
এ বছর সরকারের আরো ১০ লাখ টন গম আমদানির কথা রয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজে রয়েছে ১৩ হাজার টন গম। চাহিদার বাকি ১৫ লাখ টন গম বেসরকারিভাবে আমদানি হবে।