আগামী ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যাকাণ্ডের ৩৭ বছর পূর্ণ হতে যাচ্ছে। বর্বরোচিত এ হত্যাকাণ্ডের মামলায় সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের আদেশে পাঁচ আসামির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হলেও আরো ছয়জন এখনও দেশের বাইরে পলাতক রয়েছেন।
ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত ১২ খুনির মধ্যে বাকি ১ জন বিদেশে পলাতক অবস্থায় মারা গেছেন।
এ প্রসঙ্গে আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদের সঙ্গে কথা হয়েছে। রোববার সঙ্গে সাক্ষাতকারে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘‘বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের মধ্যে জীবিত নূর চৌধুরী কানাডায় থাকার জন্য আইনি লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। সে কারণে তাকে দেশে ফিরিয়ে এনে দ্রুত রায় কার্যকর করা যাচ্ছে না।’’
সচিবালয়ে আইনমন্ত্রী তার নিজ কার্যালয়ে বলেন, ‘‘তবে নূর চৌধুরীসহ জীবিত ছয় খুনিকেই এ সরকারের মেয়াদেই দেশে ফিরিয়ে এনে রায় কার্যকর করা হবে।’’
বঙ্গবন্ধুর খুনি নূর চৌধুরীকে দেশে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে আইনমন্ত্রী বলেন, “কানাডা সরকার তাকে ওই দেশে রাখতে চায় না। তার পাসপোর্ট জব্দ করেছে। প্রতিনিয়ত তাকে থানায় হাজিরা দিতে হচ্ছে। কিন্তু তিনি ক্যানাডা সরকারের সঙ্গে দেন-দরবার করছেন। তিনি বলছেন আমাকে যে দেশে পাঠানো হচ্ছে, সে দেশে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর রয়েছে।”
ক্যানাডায় ফাঁসি নেই উল্লেখ করে বলেন, ‘‘সেই সুযোগই নিচ্ছেন নূর চৌধুরী। তবে আমাদের সরকার কানাডিয়ান একটি ল’ ফার্মকে নিয়োগ দিয়েছে।’’
তাকে দেশে ফিরিয়ে আনতে কতো সময় লাগতে পারে এ প্রসঙ্গে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘‘নূর চৌধুরী কানাডা সরকারের সঙ্গে দেন-দরবার করছেন। সরকার একটি মামলা রিজেক্ট করলে সে আবার রিট করছে। এভাবে একটির পর একটি মামলা করে সময়ক্ষেপণ করছেন নূর চৌধুরী।”
বঙ্গবন্ধুর আরেক খুনি রাশেদ চৌধুরী জীবিত অবস্থায় আমেরিকা অবস্থান করছেন। তাকে দেশে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে সরকারের পদক্ষেপ জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী বলেন, “রাশেদ চৌধুরীকে দেশে ফিরিয়ে আনতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ওই দেশে আইনজীবী নিয়োগ করেছে। তাকে ফিরিয়ে আনার জন্য সরকার আন্তরিকভাবে চেষ্টা করছে।’’
বঙ্গবন্ধুর জীবিত ছয় খুনির অবস্থান ও দেশে ফিরিয়ে আনা সম্পর্কে আইনমন্ত্রী আরো বলেন, “সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের সর্বশেষ রায়ে ১২ জনের বিরুদ্ধে ফাঁসির আদেশ দেন। এর মধ্যে একজন মারা গেছেন। দেশে কারাগারে থাকা পাঁচজনের বিরুদ্ধে রায় কার্যকর হয়েছে। জীবিত ছয়জনের দু’জনের অবস্থান নিশ্চিত করা গেছে। নূর চৌধুরী কানাডায় ও রাশেদ চৌধুরী আমেরিকায় রয়েছেন।”
মন্ত্রী বলেন, ‘‘অপর চারজনের মধ্যে দু’জন ইন্ডিয়ায়, একজন পাকিস্তানে এবং একজন আফ্রিকার উগান্ডাসহ এলাকার কোনো দেশে রয়েছে। তবে বয়সের কারণে এবং তারা গোপনীয়তা রক্ষার কারণে তাকে হয়তো খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তবে সরকার আন্তরিকভাবে চেষ্টা চালাচ্ছে।”
সরকার দূতাবাস ও ইন্টারপোলের মাধ্যমে খুনিদের খুঁজে বের করে দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে বলেও জানান আইনমন্ত্রী।
সরকার পরিবর্তন হলে অন্য কোনো সরকার কি পদক্ষেপ নেবে এ প্রসঙ্গে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘‘৭৫ পরবর্তী সরকার খুনিদের পুনর্বাসন করেছে। তাদের চাকরি দিয়েছে।”
তবে জীবিত ছয় খুনীকে এ সরকারের মেয়াদেই দেশে ফিরিয়ে এনে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায় কার্যকর করা হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। ইতিহাসের বর্বরতম এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনার প্রায় ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে বিচার শুরু করে। আর ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি সুপ্রিম কোর্টের রায়ের মাধ্যমে বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়।
২০০১ এ সরকার পরিবর্তন এবং বিএনপি-জামায়াত চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায় কার্যকর করা ঝুলে যায়। উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের বিব্রতবোধ করাসহ বিভিন্ন কারণে আপিলের শুনানি স্থগিত থাকায় রায় কার্যকর হয়নি।
নানা টানাপড়েন ও প্রতিকূলতার কারণে ১৯৯৬ সালে মামলা দায়ের করার পর এর বিচারকাজ শেষ করে রায় কার্যকর করতে সময় লাগে ১৩ বছর।
২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ২০০৯ সালের মধ্যে আসামিদের লিভ টু আপিলের শুনানি এবং সকল আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে।
সর্বশেষ ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে চার বিচারপতির বিশেষ বেঞ্চ রায় পুর্নবিবেচনার শুনানি গ্রহণ শেষে আদেশ দিলে সব আবেদন খারিজ করা হয়। এ আদেশের মধ্য দিয়ে চূড়ান্ত হয় ১২ জনের ফাঁসির আদেশ।
পরে ২৯ জানুয়ারি গভীর রাতে বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনি বজলুল হুদা, মহিউদ্দিন আহমেদ (আর্টিলারি), সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান এবং একেএম মহিউদ্দিন (ল্যান্সার) ফাঁসি দিয়ে রায় কার্যকর করা হয়। অপরদিকে আজিজ পাশা জিম্বাবুয়েতে ২০০২ সালে মারা যান।
উল্লেখ্য, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ছয় খুনি লে. কর্নেল (বরখাস্ত) আবদুর রশিদ, মেজর (বরখাস্ত) শরিফুল হক ডালিম, মেজর (অব:) বি নূর চৌধুরী, রিসালদার মোসলেহ উদ্দিন, লে. কর্নেল (অব) রাশেদ চৌধুরী ও ক্যাপ্টেন (অব) আবদুল মাজেদ বিদেশে পলাতক রয়েছেন।