অবৈধ ভিওআইপি (ভয়েস ওভার ইন্টারনেট প্রটোকল) ব্যবসা নিয়ন্ত্রণকারী রাঘববোয়ালেরা ধরাছোঁয়ার বাইরে। দেশ-বিদেশে অবস্থানকারী এসব রাঘববোয়ালেরা খোদ রাষ্ট্রীয় টেলিযোগাযোগ প্রতিষ্ঠান বিটিসিএল ও সরকারি মোবাইল ফোন অপারেটর কোম্পানি টেলিটক ব্যবহার করে বছরের পর বছর অবৈধ এ ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। লুটে নিচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকা। সরকারও হারাচ্ছে মোটা অঙ্কের রাজস্ব। সরকারি বিভিন্ন সংস্থা ভিওআইপি বন্ধে বাস্তবমুখী পদক্ষেপ কেউ নিচ্ছে না।
আর টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসির ভূমিকাও রহস্যজনক। অবৈধ এ ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে তাদের যেনো দায়িত্বশীল কোনো ভূমিকা নেই।
এ ছাড়া ভিওআইপির লাইসেন্স দেওয়া হবে বলে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও সরকার তিন বছরেও তা বাস্তবায়ন করেনি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় প্রভাবশালীদের সুবিধা দিতেই বৈধ ভিওআইপি লাইসেন্স দেওয়া হচ্ছে না। এতে করে এখন রমরমা অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসা। আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেড়েছে অবৈধ ভিওআইপি কলের সংখ্যা।
সূত্র জানায়, আগে শুধু রাজধানী ঢাকাতে হলেও এখন চট্টগ্রাম, সিলেট, বগুড়া, রংপুর, খুলনাসহ বিভিন্ন জেলায় এ ব্যবসা হচ্ছে। একটি শক্তিশালী আন্তর্জাতিক টেলি সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত হয়ে প্রভাবশালীরা ব্যবসা পরিচালনা করছেন। দেশীয় সিন্ডিকেট বিটিসিএলের আন্তর্জাতিক কলের হিসাব মুছে দিচ্ছে। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় একটি চক্র যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, স্পেন, সিঙ্গাপুর, জাপান, ব্যাংকক, এশিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন সদস্যের সঙ্গে ব্যবসা চলাচ্ছেন। র্যাবের অভিযানে মাঝেমধ্যে কর্মচারীরা ধরা পড়লেও প্রভাবশালীরা রয়ে যান ধরাছোঁয়ার বাইরে।
সূত্র বলছে, ছয় মাস ধরে বিটিসিএলের একটিসহ চারটি ইন্টারন্যাশনাল গেটওয়ে (আইজিডব্লিউ) কোম্পানির মাধ্যমে বিদেশে কল যাওয়া ব্যাপকভাবে কমে গেছে। প্রতিদিন বৈধ পথে আসা কমপক্ষে এক কোটি মিনিট বৈদেশিক টেলিফোন কলের কোনো হদিস নেই। বিটিআরসির হিসাবে যেখানে প্রতিদিন গড়ে সাড়ে চার কোটি মিনিট বৈদেশিক কল হওয়ার কথা, সেখানে আসছে মাত্র সাড়ে তিন কোটি মিনিট। অবৈধ ভিওআইপির কারণে সরকার প্রতিদিন কমপক্ষে ৩০ কোটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে।
বিটিআরসি সূত্রগুলো জানায়, বর্তমানে অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসার সিংহভাগই করছে টেলিটক। আর এটির পৃষ্ঠপোষকতা করছে প্রতিষ্ঠানটির সর্বোচ্চ মহল।
সূত্র মতে, অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসা প্রমাণিত হওয়ায় পাঁচটি বেসরকারি ল্যান্ডফোন কোম্পানি বন্ধ করে দেয় সরকার। বিটিআরসি, পুলিশ ও র্যাব অবৈধ ভিওআইপি রোধে ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় অভিযান পরিচালনা করছে। কিন্তু কোনোভাবেই বন্ধ করা যাচ্ছে না এ ব্যবসা। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন টেলিটক নিজেই এ ব্যবসায় জড়িত বলে জানা গেছে। এতে করে বছরে সরকারের ক্ষতি হচ্ছে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসেই অবৈধ ভিওআইপি কল গত বছরের তুলনায় বেড়েছে প্রায় ৫০ শতাংশ।
বিটিআরসিতে স্থাপিত বেলজিয়ামের এমইইউসিসিআই সলিউশনের সিম ডিটেকশন মেশিনে (সংযোগ শনাক্তকরণ যন্ত্র) এ তথ্য পাওয়া গেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মহাজোট সরকারের শুরু থেকে ভিওআইপির লাইসেন্স দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। অথচ ওই বছরেই দিনপ্রতি প্রায় আড়াই কোটি মিনিট বিদেশি কলের কোনো হিসাব পাওয়া যায়নি। ওই আড়াই কোটি মিনিট বিদেশি কল হয়েছে অবৈধ পথে। ২০১০ ও ২০১১ সালেও ছিল একই পরিস্থিতি। তবে দুই বছরে অবৈধ ভিওআইপির ক্ষেত্রে এগিয়ে ছিল সরকারি দুই টেলিযোগাযোগ প্রতিষ্ঠান বিটিসিএল ও টেলিটক।
সূত্র জানায়, অবৈধ ভিওআইপি কমাতে বেশকিছু সুপারিশসংবলিত একটি তদন্ত প্রতিবেদন ফেব্রুয়ারিতে টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের কাছে জমা দেওয়া হয়। সুপারিশে পরিস্থিতি উন্নয়নে মূলত রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ল্যান্ডফোন ও আইজিডব্লিউসহ বিভিন্ন গেটওয়ে অপারেটর বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন্স কোম্পানি লিমিটেড বা বিটিসিএলের কাজে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার পরামর্শ দেওয়া হয়।
এ ছাড়া ভিওআইপির চোরাকারবারিদের শনাক্ত এবং আন্তর্জাতিক কলের পরিমাণ কমে যাওয়ার কারণ নির্ণয়ে কমিটির ব্যর্থতার জন্য ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় এবং বিটিসিএলের অসহযোগিতাকেই দায়ী করা হয়। অবৈধ ভিওআইপি নিয়ন্ত্রণে ত্রিপক্ষীয় টাস্কফোর্স গঠনের সুপারিশ করা হয়। এ ছাড়া বিটিসিএলে কল ডিটেইল রেকর্ডস (সিডিআর) মুছে ফেলার প্রমাণ মিলেছে উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, এ প্রতিষ্ঠানসহ সব অপারেটরের ওপর নিয়ন্ত্রক সংস্থার নজরদারি আরও না বাড়ালে বৈদেশিক টেলিফোন কল থেকে সরকার এখনো যে কয়েক হাজার কোটি টাকা আয় করে তার পুরোটাই লোপাট হয়ে যাবে।
সূত্র জানায়, আন্তর্জাতিক কল আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে বিটিসিএলের দুটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা হচ্ছে মহাখালী/কড়াইলস্থ আইটিএক্স-৫ ও ৭ এবং মগবাজারের আইটিএক্স-৩ ও ৬। এর মধ্যে মহাখালী/কড়াইলস্থ আইটিএক্স দুটি ভিওআইপির অবৈধ কারবারিদের `মূল স্থাপনা` হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। এ স্থাপনা মূলত পরিচালিত হচ্ছে একটি বিশেষ চক্রের মাধ্যমে।
বিটিসিএল ও দেশের টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের এ স্থাপনায় কোনো কর্তৃত্ব কাজ করছে না। এখানে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রকৌশলীদের একটি চক্র আন্তর্জাতিক এক্সচেঞ্জের কল রেকর্ড ইচ্ছামতো মুছে দিচ্ছে বা কল বাইপাস করছে। কলের প্রকৃত হিসাব বিটিসিএলের পাওয়ার কথা, তা পাচ্ছে না। প্রতিদিন কল ভলিউম প্রতিবেদন পাওয়ার কথা থাকলেও `মূল স্থাপনা` থেকে তা পাওয়া যাচ্ছে না। মাঝেমধ্যে পাওয়া যাচ্ছে গোঁজামিল প্রতিবেদন। অজুহাত দেখানো হচ্ছে যান্ত্রিক ও কারিগরি ত্রুটির।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সূত্র জানায়, তিন স্তরের অবকাঠামো তৈরি করেও অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসা বন্ধ করা সম্ভব নয়। এরই মধ্যে দেশে ৯টি গেটওয়ে প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। এরপর সরকার আরও ৭০-৮০টি গেটওয়ে লাইসেন্স ইস্যু করে এ অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসা বাড়ানোর সুযোগ করে দিয়েছে। ভিওআইপি এতে আরও বাড়বে।