‘একটি মহল বিশ্বব্যাংককে প্ররোচিত করে’

‘একটি মহল বিশ্বব্যাংককে প্ররোচিত করে’

একটি মহল দুর্নীতির অভিযোগ তুলতে ই-মেইলে বিশ্বব্যাংককে প্ররোচিত করেছে। পদ্মাসেতু বিষয়ে বিশ্বব্যাংক সাবেক যোগাযোগমন্ত্রীসহ বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুললেও সুনির্দিষ্ট দুর্নীতির প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারেনি। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) জিজ্ঞাসাবাদে একথা বলেছেন সেতু বিভাগের সাবেক সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া।

দুদকের তদন্ত কর্মকর্তারা মনে করছেন, মোশাররফ হোসেনকে জিজ্ঞাসাবাদে তদন্তে অনেক অগ্রগতি হয়েছে।

পদ্মাসেতু নির্মাণে পরামর্শক নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগে সাবেক সচিব ও  প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বিইজেডএ) বর্তমান নির্বাহী চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়াকে বুধবার সোয়া দুই ঘন্টা জিজ্ঞাসাবাদ করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

সকাল ১০টা ৪৫ মিনিটে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সেগুনবাগিচাস্থ প্রধান কার্যালয়ে হাজির হন তিনি। ১১টায় দুদক ভবনের নিচতলায় জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হয়ে চলে সোয়া ১টা পর্যন্ত। দুদকের উপ-পরিচালক মীর জয়নুল আবেদীন শিবলি ও মির্জা জাহিদুল আলম তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন।

একটি মহলের ই-মেইল প্ররোচনা
সূত্র জানায়, জিজ্ঞাসাবাদে মোশাররফ নিজেকে সম্পূর্ণ নির্দোষ দাবি করেন। তিনি তদন্ত কর্মকর্তাদের বলেন, ‘‘মূল সেতুর ব্যয় ধরা হয়েছিল ১০০০ মিলিয়ন ডলার, নদী শাসন প্যাকেজের সম্ভাব্য ব্যয় ৮৫০ মিলিয়ন ডলার এবং সুপারভিশন কনসালট্যান্সি ব্যয় ধরা হয়েছিল মাত্র ৫০ মিলিয়ন ডলার। অবশেষে প্যাকেজের কাজ পাওয়ার জন্যই প্রতিযোগিতা বেশি লক্ষ্য করা গেছে।

তিনি বলেন, ‘‘শুরুতেই একটি কোম্পানিকে ‘ফেবার’ করার চেষ্টা আঁচ করতে পেরে মূল্যায়ন কমিটি ভেঙ্গে দিয়ে নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের ব্যক্তিদের নিয়ে পরবর্তী কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটির মূল্যায়ন চলাকালে একটি মহল ই-মেইলের মাধ্যম বিশ্বব্যাংকের ইন্টিগ্রিটি ডিপার্টমেন্টের সঙ্গে যোগাযোগ করতে থাকে। ইন্টিগ্রিটি বিভাগের কর্মকর্তাদের দেওয়া ই-মেইলের কপি প্রকল্প-সংশ্লিষ্ট জাপানি একজন কর্মকর্তার কাছেও পাঠানো হয়। শুরু থেকে না হলেও কয়েক মাস পর থেকে ওই ই-মেইলের কপি বিশ্বব্যাংকের মাধ্যমে আমার ই-মেইলে ফরওয়ার্ড করা হয়।’’

ই-মেইল কপিতে দেখা গেছে, ২টি প্রতিষ্ঠান (এসএনসি লাভালিন ও এইচপিআর) কারিগরি মূল্যায়নে বেশি নম্বর পেতে পারে বলে বলে ওই মহলটি আশঙ্কা করে। ওই মহলটি এ প্রতিষ্ঠান ২টির বিরুদ্ধে বিষোদগার করতে থাকে। কোনো কোনো মেইলে তারা পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হালক্রোরও দোষ-ক্রটি তুলে ধরে। মূল্যায়ন কমিটির বিভিন্ন সদস্য, মন্ত্রী, সচিব এমনকি বিশ্বব্যাংকের মনোনীত পরামর্শক ও টাস্ক টিম লিডারকে জড়িয়ে বানোয়াট তথ্য প্রদান করে। ইন্টিগ্রিটির কয়েকজন কর্মকর্তাও ই-মেইল আদান-প্রদানে ও তথ্য সংগ্রহে বেশ আগ্রহী হয়ে ওঠেন।’’

দুর্নীতির প্রমাণ দিতে পারেনি বিশ্বব্যাংক
জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে তদন্ত কর্মকর্তা সাবেক সচিব মোশাররফকে প্রশ্ন করেন-‘‘আপনিতো বিশ্বব্যাংকে গিয়েছেন…’’

তদন্ত কর্মকর্তার এ প্রশ্ন শেষ না হতেই মোশাররফ বলেন, ‘‘২০১১ সালে আমি পদ্মাসেতুর গুরত্বপূর্ণ কাজে বিশ্বব্যাংকে গিয়েছি। প্রথমবার, সম্ভবত ২০১১ সালের এপ্রিল মাসে, টাস্ক টিম লিডারকে জানাই যে, ইন্টিগ্রিটির জুনিয়র কর্মকর্তারা যেভাবে ই-মেইলের মাধ্যমে একটি ভুল বিষয়ের ওপর যোগাযোগ করেছেন, তা নিরসনের জন্য আমি তাদের সঙ্গে কথা বলতে চাই। টাস্ক টিম লিডার ইন্টিগ্রিটিক জানালে তারা বলেন যে, এ পর্যায়ে তারা কোনো কথা বলবেন না।’’

‘‘দ্বিতীয়বার, সম্ভবত, গত বছরের জুন-জুলাইয়ের ভ্রমণে অর্থনৈতিক বিষয়ক উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান নেতৃত্ব দেন (অর্থনৈতিক উপদেষ্টা পদ্মাসেতু প্রকল্পের ইন্টিগ্রিটি অ্যাডভাইজার। এ সফরে তিনি ইন্টিগ্রিটি ভাইস প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠক করেন। কিন্তু কথিত অভিযোগের বিষয়ে কোনো আলোচনা হয়নি।’’

মোশাররফ বলেন, ‘‘বিশ্বব্যাংকের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক ভাইস প্রেসিডেন্ট মিজ ইসাবেল গুরিয়ারার সঙ্গে আমাদের সাক্ষাতের সময় আমি এ বিষয়টি পুনরায় উত্থাপন করি।’’

তিনি জানান, ‘‘ইন্টিগ্রিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট সরাসরি প্রসিডেন্টের কাছে রিপোর্ট করেন। যে পদ্ধতিতে তারা কোনো বিষয়ের তদন্ত করে, তাতে আমাদের কোনো কিছু বলার সুযোগ নেই। তবে তাদের তদন্ত চলাকালে পদ্মাসেতুর কাজ থেমে থাকবে না। কাজ এবং তদন্ত-এ দুটি ইস্যু সম্পূর্ণ পৃথক।’’

‘‘শুধু ওয়াশিংটনে নয়, আমি ঢাকাস্থ কান্ট্রি ডিরেক্টরকেও বিষয়টি অবহিত করি। পরে খবর পেলাম ইন্টিগ্রিটির কর্মকর্তারা ঢাকায় এসে অভিযোগকারীদের সঙ্গে দেখা করেছেন। বিশ্বব্যাংকের কর্মকর্তাদের আমি বললাম, ইন্টিগ্রিটি যদি তদন্ত করে, তবে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ ও মূল্যায়ন কমিটির সকলের মতামত নিতে হবে। তারা জানালেন, ‘ইন্টিগ্রিট বিভাগের কাজের ব্যাপার আমাদের কিছু বলার নেই।’ গত বছরের জুলাই-আগস্ট মাসের দিকে  আমাকে জানানো হলো, বিশ্বব্যাংক ইন্টিগ্রিটি সুপারভিশন কনসালট্যান্সি ছাড়াও মূল সেতুর টেন্ডারের অনিয়মে মন্ত্রীর (সৈয়দ আবুল হোসেন) সংশ্লিষ্টতার বিষয়েও তদন্ত করছে। এক পর্যায়ে কান্ট্রি ডিরেক্টর আমাকে বলেন, ‘‘মন্ত্রিসভায় রদবদল করে তাকে অন্য মন্ত্রণালয়ে দায়িত্ব দিলেও হবে।’’

সাবেক সচিব মোশাররফ জিজ্ঞাসাবাদে দুদকের তদন্ত কর্মকর্তাদের আরো জানিয়েছেন, ‘‘গত বছর বিশ্বব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট ও ইন্টিগ্রিটির একজন পরিচালকসহ বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধি দল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করে দুর্নীতির অভিযোগ তোলেন। প্রধানমন্ত্রী বিশ্বব্যাংককে দুর্নীতি উপস্থাপন (প্রমাণ) করতে বলেন।’’

সাবেক সচিব মোশাররফ দুদকের জিজ্ঞাসাবাদে আরও বলেন, ‘‘বিশ্বব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে বলেন যে, জাতিসংঘের সাধারণ সভায় প্রধানমন্ত্রী নিউইয়র্ক গেলে সেখানে প্রমাণ উপস্থাপন করা হবে। প্রধানমন্ত্রী নিউইয়র্কে গেলেও পদ্মাসেতু বিষয়ে বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারেনি।’’

সাবেক সচিব জিজ্ঞাসাবাদে দুদককে জানান, বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত একই সময়ে ওয়াশিংটনে গেলে তার কাছে একটি চিঠি দেওয়া হয়।

মোশাররফ দুদককে বলেন, ‘‘ওই চিঠিতে সাবেক যোগাযোগমন্ত্রীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়েছে, এটা সত্য। তবে মন্ত্রীর বিরুদ্ধে অভিযোগের সুনির্দিষ্ট প্রমাণ দিতে পারেনি বিশ্বব্যাংক।’’

এসএনসি’র কর্মকর্তার অপকৌশল
রমেশ সাহা সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদে দুদকের তদন্ত কর্মকর্তাদের সাবেক সচিব আরও বলেন, ‘‘রমেশ সাহা নামক এসএনসি’র কর্মকর্তা তাদের প্রস্তাবের সঙ্গে প্রথম থেকে যুক্ত ছিলেন না। এর আগে তিনি বাংলাদেশের ২/১টি প্রকল্পে এসএনসি’র হয়ে কাজ করেছেন। তার ‘আউটপুট’ ও আচরণ সুবিধার নয় বলেই তাকে বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষ গ্রহণ করতে চায় না। সেজন্যই ওই কোম্পানি প্রথমে তাকে এ প্রকল্পের প্রস্তাব প্রণয়ন ও দাখিলের সঙ্গে যুক্ত করেনি বলে প্রতীয়মান হয়।’’

মোশাররফ আরো বলেন, ‘‘বাংলাদেশে এসএনসি’র প্রতিনিধি ইসমাইলের সঙ্গেও রমেশের সম্পর্ক ভালো ছিলো না। কারিগরি মূল্যায়নে এসএনসি প্রথম হতে না পারায় রমেশ কৌশলে এর ব্যর্থতার দায় চাপিয়ে ইসমাইলকে কারিগরি মূল্যায়ন প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়ার পরপরই চাকরি থেকে সরিয়ে দেন এবং তার পরিবর্তে নিজে বাংলাদেশে এসএনসি’র প্রতিনিধি হিসেবে আবির্ভূত হন। ওই দায়িত্ব পাওয়ার পর তিনি তার উর্দ্ধতন কর্মকর্তা কেভিন ওয়ালেসের সঙ্গে বাংলাদেশে আসেন।’’

‘‘রমেশের আচরণ এবং কাজের সুনাম না থাকায় এসএনসি-লাভালিন কাজ পেলে তার নিয়োগ গ্রহণযোগ্য হবে না বলে কেভিন ওয়ালেসকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ওয়ালেসও এতে সম্মত হন। এসএনসি লাভালিনের অনুরুপভাবে হালক্রু (Halcrow) এর সিইও বাংলাদেশে এসে আমার সঙ্গে দেখা করলে তাকেও জানানো হয় যে, কাজ পেলে এ প্রকল্পে যোগ্য লোকবল নিয়োজিত করতে হবে।’’

দুদকের তদন্ত কর্মকর্তাদের মোশাররফ বলেন, সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে অভিযোগকারীদের [email protected] মেইল আইডিতে এসব ই-মেইলের অনুসন্ধানপূর্বক অভিযোগকারীদের সঠিক পরিচয় উদঘাটন করা আবশ্যক।

সাবেক এ সচিব মনে করেন, এ মেইলে অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া যেতে পারে।

 

বাংলাদেশ