ঈদের আর দিন পনেরো বাকি থাকলেও এখনো খুব একটা জমে ওঠেনি রাজধানীর মিরপুরের বেনারসি পল্লীর দোকানগুলো। অগত্যা কূ আর করা! মনে আশার আলো জাগিয়ে রেখেই ক্রেতার আশায় অলস সময় পার করছেন দোকানিরা। তাদের এবারের ঈদ পসরায় অবশ্য ভারতীয় শাড়ির আধিক্য আগের যে কোন সময়ের তুলনায় বেশিই চোখে পড়লো যেন।
দোকানিদের সঙ্গে কথা বলা জানা গেলো, এবারের ঈদের বেনারসি পল্লীর দোকানগুলোর প্রায় অর্ধেকই চলে চলে গেছে ভারতীয় শাড়ি। শাড়ি তৈরির দেশি উপকরণস্বল্পতা, অবকাঠামো, ডিজাইনার ও কারিগর সংকটসহ নানা সমস্যায় ঐতিহ্যের দেশি বেনারসি শিল্প মার খাওয়ায় ভারতীয় শাড়ি বাজার দখলে নিচ্ছে বলে জানালেন তারা।
ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেলো- সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ক্রেতাদের রুচিবোধেরও অনেক পরিবর্তন এসেছে। কয়েক বছর আগে জর্জেট জাতীয় শাড়ির খুব চাহিদা থাকলেও এখন বিভিন্ন প্রকারের বেনারসি কাতান, জামদানি শাড়ির কদর বেড়েছে।
তাদের দেওয়া তথ্যমতে, বেনারসি পল্লীতে ২৫-৩০ প্রকারের বিভিন্ন নাম ও ডিজাইনের শাড়ি রয়েছে। এবারের ঈদে দেশি শাড়ির মধ্যে বেনারসি কাতান, বুটি কাতান, হাড্ডি কাতান, পিওর কাতান, সুতি ও বিভিন্ন প্রকারের জামদানি, দুপিয়ান সিল্ক, সানন্দা, গাদোয়ান, মাসলাইস কটন, জুটনেট, সুপারনেট, পুদনমা বা পাড় ছাড়া কাতান, অপেরা কাতান, টিস্যু কাতান, মিরপুর জামদানি, কোটাসিল্ক, কাঞ্জিবলন ইত্যাদির চাহিদা বেশি।
ভারতীয় শাড়ির মধ্যে নেট শাড়ি, গুপি, কোকিলা দির কাতান, রেম্বো, কলাবেরি ইত্যাদির কদর বেশি। বেনারসি পল্লী হলেও এখানে থ্রিপিস, প্রিন্টের শাড়ি, টাঙ্গাইলের শাড়ি, লেহেঙ্গা, সিল্ক আর সুতি শাড়িও পাওয়া যাচ্ছে।
দেশি শাড়ি সর্বনিন্ম ৫শ’ টাকা থেকে ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত দামের রয়েছে। ভারতীয় শাড়ি সর্বনিন্ম ৩ হাজার টাকা থেকে ২৫-৩০ হাজার টাকার মধ্যে পাওয়া যাবে।
দোকানিরা জানান, দেশে এখনও মানসম্পন্ন ও যুগোপযোগী ডিজাইনার তৈরি না হওয়ায় কারিগরেরা ভারতীয় শাড়ির নতুন ডিজাইন দেখে দেখে শিখে নিচ্ছে। কারচুপির ক্ষেত্রেও ভারতীয় শাড়ি দেখে অনুকরণ করা হচ্ছে।
তারা জানান, ক্রেতাদের চাহিদা কমে যাওয়ায় এখন ১৫শ’ থেকে ১৫-২০ হাজার টাকা দামের মধ্যে যেসব শাড়ি রয়েছে তা তৈরি করছি আমরা। এর চেয়ে বেশি দামের হলে শুধু অর্ডার পেলেই তৈরি করে দেওয়া হয়। লাখ টাকা দামের শাড়িও এখানে তৈরি হয় বলে জানালেন দোকানিরা।
আলিফ বেনারসি দোকানের স্বত্বাধিকারী জাহিদ ইমাম বিরাম আক্ষেপ করে বলেন, “অন্য বছরগুলোতে ঈদ মৌসুমে ক্রেতাদের প্রচুর ভিড় থাকতো। আমরা খাওয়ার সময় পেতাম না। আর এখন সারা দিনে ৪/৫টি কাপড় বিক্রি করছি।”
তবে এ সপ্তাহ থেকে ক্রেতা সমাগম বাড়তে পারে বলে ধারণা করছেন দোকানিরা।
মিরপুর ১০ নম্বরের বেনারসি পল্লী দোকান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও দিয়া শাড়ির দোকানের স্বত্বাবধিকারী আবুল কাশেম বলেন, “দেশ স্বাধীন হবার পর থেকে এ বেনারসি পল্লী সম্প্রসারিত হতে থাকলেও আশির দশক থেকে এটি ব্যাপকতা লাভ করে ও আজকের পর্যায়ে এসে পৌছে। আগে এখানে কারখানা ছিল বেশি, দোকান ছিল কম। এখন দোকান বেড়েছে, কিন্তু কমেছে কারখানার সংখ্যা।”
তিনি বলেন, “বর্তমানে মিরপুর দশ, এগারো ও বার মিলিয়ে মাত্র ২ হাজারের মতো কারখানা রয়েছে, আগে ছিলো ১০ হাজারের মতো। মিরপুর দশে বর্তমানে ১২০টি দোকান রয়েছে। মিরপুর এগারো ও বারো মিলে পঞ্চাশের বেশি হবে না দোকানের সংখ্যা। সময়ের সঙ্গে বেড়েছে কারখানার ভাড়া। জায়গার সংকট দিন দিন বাড়ছে। প্রকৃত তাঁতীদের জমি না দিলে, তাদের পুনর্বাসন না করা হলে ঐতিহ্যবাহী দেশি এই শিল্প আগামীতে টিকতে পারবে না। ক্রেতাদের সঙ্গে মিথ্যা বলা হলেও এটা সত্য। আমরা কখনও ভারতীয় শাড়িকে দেশি, আবার দেশিকে ভারতীয় বলে চালিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছি।”
দিনাজপুরের বাসিন্দা নাসিম মিয়া (৪৫) দশ বছর বয়স থেকে তাঁত বোনার কাজ করছেন মিরপুর বেনারসি পল্লীতে। অনেক স্বপ্ন নিয়ে এ পেশায় এলেও জীবনের বেশির ভাগ সময় পার করে দিয়েও ফল হয়নি কিছুই। প্রতি বছরই ঈদের আগে সাংবাদিকরা আসেন তাদের কথা জানতে। কিন্তু তাদের কোন লাভ হয় না। বরং প্রতি বছরই মজুরি কমে।
ক্ষোভের সঙ্গে নাসিম বলেন, “সকাল ৯টায় কাজ আরম্ভ কইরা অনেক দিন রাত ১২টা পর্যন্ত কাজ করি। শুক্রবার ছুটি থাকলেও প্রোডাকশনে কাম করলে এই দিনও কাম করি। এক শাড়ি বানাইতে কম কইরা অইলেও ৬/৭ দিন লাগে। এক মাসে ৪টির বেশি শাড়ি বানাইতে পারি না।”
তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বর্তমানে এসব কারখানার অধিকাংশ সুতা চীন থেকে আসে। বিদেশ থেকে এনে সেটাকে ফিনিশিং দিতে হয়। দেশের ডিজাইন চলে না বলে বেশির ভাগ ডিজাইন ভারতের। প্রথমে শাড়ির ব্লাউজ বোনা হয়, তারপর বোনা হয় আঁচল ও বডি। মজুরি মান ও শাড়ি ভেদে একেক রকম হয়। সাধারণত একজন কারিগরকে ৫শ’ টাকা থেকে ১২/১৪শ‘ টাকা পর্যন্ত মজুরি দেওয়া হয় একটি শাড়ির জন্য।
মিরপুর দশের বেনারসি পল্লী দোকান মালিক সমিতির সভাপতি ও তাওসিফ বেনারসি ফ্যাশনের স্বত্বাধিকারী মো. কলিমউদ্দিন দেশি বেনারসি শিল্পের বর্তমান রুগ্নদশার জন্য সরকারের কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণে ব্যর্থতাকে দায়ী করেন।
তিনি বলেন, “বেনারসি শাড়ি তৈরির জন্য রঙ, সুতা, জরিসহ সব উপকরণই এখন বিদেশ থেকে আনতে হচ্ছে। দেশে রঙ ও জরি উৎপাদন, সিল্ক সুতার জন্য রেশম পোকা প্রতিপালনসহ দেশি উপকরণ প্রাপ্তির কোন উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে না। তাঁতবোর্ড এ শিল্পের উন্নয়নের জন্য একটি টুইস্টিং মিল করে দিয়েছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলো- দলীয় যে ব্যক্তিকে ওই মিল দেওয়া হয়েছিল, তিনি ওই মিল খেয়ে ফেলেছেন, যা এই শিল্পের কোন কাজেই লাগেনি।”
তিনি অভিযোগ করেন, “সরকার তাঁতমেলা করে এসব শিল্পের উন্নয়নের জন্য। কিন্তু মেলার স্টল বরাদ্দের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ভাড়া ছাড়াও ঘুষ দিতে হয়। দলীয় লোকেরা মেলা থেকে সুবিধা নেয়।
উল্লেখ্য, ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান বিভক্ত হওয়ার পর ভারতের বেনারস থেকে সাড়ে ৩শ’ মুসলিম তাঁতী পরিবার তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান বা বাংলাদেশে চলে আসে। পূর্বে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকলেও স্বাধীনতার পর এদের বেশির ভাগ পরিবার মিরপুরে আবাস গড়ে তোলে। অধিকাংশ উর্দু ও বাংলা ভাষার সংমিশ্রণে কথা বলেন।
তাদের হাত ধরে ছোট ছোট তাঁত গুলো এক সময় বিশাল বেনারসি পল্লী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। মিরপুর দশ থেকে বার নম্বর হয়ে বাউনিয়া বেড়িবাঁধ পর্যন্ত এলাকা বেনারসি পল্লী হিসেবে পরিচিত। প্রায় এক লাখ মানুষ ঐতিহ্যবাহী এ শিল্পে জড়িত থাকলেও সরকারি অব্যবস্থাপনা ও হালফ্যাশনের ভারতীয় শাড়ির দাপটের কাছে ক্রমেই এই পল্লীর ঐতিহ্য হারিয়ে যেতে বসেছে।