গবেষণা সংস্থা ‘উন্নয়ন অন্বেষণ’-এর মতে, চলতি বছর জুলাই থেকে ডিসেম্বর সময়ের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের গৃহীত সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির কারণে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমে যেতে পারে।
উন্নয়ন অন্বেষণের ‘বাংলাদেশ অর্থনৈতিক পর্যালোচনা’র জুলাই সংখ্যায় এ আশঙ্কা করা হয়েছে।
মাসিক পর্যালোচনায় আরো বলা হয়েছে, বাংলাদেশের মুদ্রানীতি ব্যবস্থাপনায় সৃজনশীলতার নিদর্শন রাখবার আরো একটি সুযোগ হারালো কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বর্তমান মুদ্রানীতি প্রণয়ন করবার ক্ষেত্রে মূলত তিনটি চ্যালেঞ্জ ছিল: (ক) মূল্যস্ফীতি চাপ হ্রাস করা, (খ) বৈদেশিক লেনদেন ভারসাম্যে স্থিতাবস্থা আনা ও (গ) অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বজায় রাখা। কিন্তু সনাতনী কায়দায় মূল্যস্ফীতিরোধের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) তিন বছর মেয়াদী সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নে সংকোচনমূলক নীতি গ্রহণ করেছে তারা।
উন্নয়ন অন্বেষণের মতে, একদিকে প্রবৃদ্ধি বজায় রাখা এবং অন্যদিকে মূল্যস্ফীতির চাপ কমিয়ে ফেলার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক সৃজনশীলতার পরিচয় দিতে পারত। যেমন, আমদানি বাণিজ্যের ক্ষেত্রে “আমদানি হ্রাস করার জন্যই আমদানি হ্রাস” নীতি না নিয়ে উৎপাদন বৃদ্ধিকারী বা মূল্যসংযোজনকারী তথা উৎপাদন উপকরণ, মূলধনী যন্ত্রপাতি, মধ্যম শ্রেণির পণ্য ‘কেসভিত্তিক’ কায়দায় আমদানি বহাল রাখতে পারত। অন্যান্য আমদানির ক্ষেত্রের লাগাম টেনে ধরতে পারত।
অন্যদিকে, সুদের হার বাড়ানোর মাধ্যমে বিনিয়োগযোগ্য তহবিল বাবদ খরচ বাড়িয়ে উৎপাদনের ওপর চাপ সৃষ্টি করে প্রবৃদ্ধির ধারাকে না কমিয়ে টার্গেটভিত্তিক কৌশল ব্যবহার করে উৎপাদন ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধিকারী খাতে ঋণ সরবরাহ বাড়াতে পারত এবং অনুৎপাদনশীল খাতে ঋণ সরবরাহ কমাতে পারত।
নীতিকৌশল প্রণয়ন, বিশেষ করে, রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় দূরদৃষ্টির অভাব থেকে বর্তমান পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে। সরকার ’কুইক রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্ট’ স্থাপনের জন্য ব্যাপক ঋণ নেয়। এর ফলে মুদ্রা সরবরাহ বেড়ে যায়। অন্যদিকে, এসব প্ল্যান্টের জন্য অত্যাধিক পরিমাণে তেল আমদানি করতে হয়। অধিক আমদানি চাহিদা এবং রফতানি আয় সমান হারে বৃদ্ধি না হওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ পড়ে এবং টাকার অবমূল্যায়ন ঘটে। এই দুই পরিস্থিতির কারণে আরো মূল্যস্ফীতি হয়। একই সময়ে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধি এবং উৎপাদনের উপকরণের মূল্যবৃদ্ধির কারণে লাগামহীন মূল্যস্ফীতি বজায় ছিল।
একদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির কারণে মূলধনী যন্ত্রপাতি, উৎপাদন উপকরণ এবং মধ্যম পর্যায়ের পণ্যের আমদানি কমে যায় এবং অন্যদিকে সুদের হার বেড়ে যাওয়ার ফলে বিনিয়োগ ও উৎপাদনও কমে যায়। ফলে প্রবৃদ্ধির হারও কমে যায়। একইসঙ্গে মূল্যস্ফীতি সন্তোষজনক হারে কমেনি।
ব্যাপক মুদ্রা
গত অর্থবছর থেকে বাংলাদেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি, প্রবৃদ্বির ক্রমহ্রাসমান ধারা এবং সামষ্টিক অর্থনৈতিক ভারসাম্যমীনতার মধ্যে একটি কঠিন সময় পার করছে। যার ফলে বাংলাদেশ ব্যাংক আইএমএফের শর্ত অনুসারে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি নিয়েছে। এই দর্শন অনুসারে ব্যাপক মুদ্রা এবং রির্জাভ মুদ্রা সংকোচনের মাধ্যমে মূল্যস্ফীতির পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। সেই আলোকেই গত জুন ২০১১ থেকে ব্যাপক মুদ্রা প্রবৃদ্ধির ক্রম হ্রাসমান ধারা অনুসরণ করা হয়েছে। তলবি আমানতের ও মেয়াদী আমানতের সামান্য বৃদ্ধি সত্ত্বেও ব্যাপক মুদ্রা প্রবৃদ্ধি আগের অর্থবছরের চেয়ে কিছুটা কমে যায়।
২০১১-১২ অর্থবছরে জুলাই-মে মাসে ব্যাপক মুদ্রা ছিল ৭১৮ দশমিক ১৩ বিলিয়ন টাকা যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ বেশি। অথচ ব্যাপক মুদ্রার প্রবৃদ্ধি ২০১০-১১ অর্থবছরে একই সময়ে ছিল ১৮ দশমিক ২৫ শতাংশ।
২০১১-১২ অর্থবছরে জুলাই থেকে এপ্রিল সময়কালে, অভ্যন্তরীণ ঋণ আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১৫ দশমিক ২৩ শতাংশ বেড়ে যায়। ২০১১-১২ অর্থবছরের জন্য অভ্যন্তরীণ ঋণের প্রবৃদ্ধির হার নির্ধারণ করা হয়েছে ১৯ দশমিক ১ শতাংশ যা আগের অর্থবছরে প্রকৃত হারে ছিল ১৯ দশমিক ৯৬ শতাংশ। ২০১২-১৩ অর্থবছরের জন্য অভ্যন্তরীণ ঋণের প্রবৃদ্ধি হারের লক্ষ্যমাত্রা হলো ১৭ দশমিক ২ শতাংশ। একই সময়কালে বেসরকারি ঋণের পরিমাণ বাড়ছে অথচ এর প্রবৃদ্ধি হার ২০১২ সালের শুরু থেকেই কমে যাচ্ছে।
রিজার্ভ মুদ্রা
২০১১-১২ অর্থবছরের জানুয়ারি-জুন সময়কালে রিজার্ভ মুদ্রার প্রবৃদ্ধি ১২ দশমিক ২১ শতাংশে নির্ধারণ করা হয়েছিল। যেখানে ২০১১-১২ অর্থবছরে জুলাই-মে সময়কালে এই প্রবৃদ্ধির হার ছিল ২ দশমিক ৯৬ শতাংশ। ২০১২ সালে মে মাসে রিজার্ভ মুদ্রা ছিল ৯২৩ দশমিক ৮৬ বিলিয়ন টাকা যা আগের বছরের মে মাসের তুলনায় ৭০ দশমিক ৮২ বিলিয়ন টাকা বা ৮ দশমিক ২৫ শতাংশ বেশি ছিল। এর অন্যতম কারণ হলো বাংলাদেশের ব্যাংকের নিট অভ্যন্তরীণ সম্পদের পরিমাণ কমে যাওয়া।
সরকারের ঋণ
সরকারি ও বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে উচ্চ ব্যয় সম্পন্ন ডিজেল এবং ফার্নেস তেল ব্যবহারের কারণে পেট্রোলিয়ামের চাহিদা বাড়ছে। ২০১০-১১ অর্থবছরে, কুইক রেন্টাল পাওয়ার প্লান্টের চাহিদা বেড়ে যাওয়ার ফলে পেট্রোলিয়াম দ্রব্য এবং অপরিশোধিত পেট্রোলিয়ামের প্রবৃদ্ধি বিগত অর্থবছর থেকে ৫৪ দশমিক ৪৫ এবং ৬০ দশমিক ৭৪ শতাংশ বেড়েছে। অন্যদিকে, পেট্রোলিয়াম দ্রব্য এবং অপরিশোধিত পেট্রোলিয়ামের আমদানি ২০১১-১২ অর্থবছরে জুলাই-এপ্রিল সময়কালে যথাক্রমে ১৫ দশমিক ৯৮ এবং ১৩ দশমিক ২০ শতাংশ বেড়েছে।
বিগত দুই বছরে থেকে সরকারের অভ্যন্তরীণ ঋণ নেওয়ার পরিমাণ বাড়ছে। ২০১১-১২ অর্থবছরের প্রথমার্ধে, সরকারের ঋণ, ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন, বিশ্ব বাজারে উচ্চ তেলের দাম, উচ্চ মূল্যস্ফীতি এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমার ফলে লেনদেনের ভারসাম্যে চাপ লক্ষ্যণীয়। ২০১১-১২ অর্থবছরে জুলাই-এপ্রিল পর্যন্ত সরকারের অভ্যন্তরীণ ঋণের প্রবৃদ্ধি বিগত অর্থবছরের একই সময় থেকে ৩১ দশমিক ১০ শতাংশ বেড়েছে। বর্তমান মুদ্রানীতিতে ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২৩০ বিলিয়ন টাকা। বাংক থেকে সরকারের অতিরিক্ত ঋণ নেওয়া বেসরকারি বিনিয়োগকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে।
রিজার্ভ
জুলাই মাসের প্রথম ২৭ দিনে ঈদ-উল-ফিতরের কারণে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ১০ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলার বেড়েছে। কিন্তু প্রবাসী আয় ও রফতানি আয় কাক্সিক্ষত হারে না বাড়লে ভবিষ্যতে রিজার্ভ আরো কমে যেতে পারে।
অবমূল্যায়ন
উন্নয়ন অন্বেষণের মাসিক পর্যালোচনায় আরো দেখানো হয়েছে, ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের বাজেট ঘাটতি আরো বেড়ে গেছে। বর্তমান মুদ্রানীতিতে বাংলাদেশ ব্যাংক বাহ্যিক খাতের স্থিতিশীলতার জন্য বাজারভিত্তিক বিনিময় হার গ্রহণ করেছে। ২০১২ জুন মাসে মুদ্রার বিনিময় হার ছিল ৮১ দশমিক ৮২ যা ২০১১ জুন মাসে ছিল ৭৪ দশমিক ১৫। ২০১১-১২ অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়কালে প্রকৃত কার্যকর বিনিময় হার ছিল ৮৯ দশমিক শূন্য ৫ যেখানে ২০১০-১১ অর্থবছরে ছিল ৯৪ দশমিক ১৪। যেহেতু একটি দেশের দ্রব্যের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা মূলত প্রকৃত কার্যকর বিনিময় হারের ওপর নির্ভর করে তাই বিনিময় হারে অনিয়মিত গতি মোট দেশজ উৎপাদন এবং কর্মসংস্থানের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলবে।
ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে সাধারণত রফতানি আয় বেড়ে যায়। কিন্তু বাস্তবে তা দেখা হয়নি, এর কারণ দ্রব্যাদির মূলস্তর বৃদ্ধি এবং ক্ইুক রেন্টার পাওয়ারের জন্য আমদানি বৃদ্ধি পাওয়া।
সঞ্চয় ও বিনিয়োগ
প্রকৃত আয়ের নিম্নগতি এবং স্টক মার্কেটের বিপর্যয়ের কারণে ব্যক্তিগত সঞ্চয়ের হার কমে যাচ্ছে। মুদ্রাস্ফীতি ও সঞ্চয়পত্রের সুদের হার অপেক্ষাকৃত কম বৃদ্ধির ফলে সঞ্চয় প্রবৃদ্ধির হার সন্তোষজনক মাত্রায় বাড়েনি। বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে ২০১২-১৩ অর্থবছরে অভ্যন্তরীণ ও জাতীয় সঞ্চয় মোট দেশজ উৎপাদনের শতকরা হারে যথাক্রমে ১৯ দশমিক ২৮ এবং ২৯ দশমিক ৬৫ শতাংশ হতে পারে। এছাড়া বেসরকারি ও সরকারি সঞ্চয় কমে ১৭ দশমিক ৮৯ ও ১ দশমিক ৩৫ শতাংশ হতে পারে।
রাজস্ব আয় ধীরগতি এবং কুইক রেন্টাল পাওয়ার প্লান্টের ভর্তুকি বাড়ানোর কারণে মোট দেশজ উৎপাদনের শতকরা হিসেবে বিনিয়োগের পরিমাণ সন্তোষজনক নয়। আমানতের উচ্চ সুদের ফলে বেসরকারি বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
প্রবৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতি গতি প্রকৃতি বিশ্লেষণ করে উন্নয়ন অন্বেষণের মতে চলতি মুদ্রানীতিতে উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ নিশ্চিত করার পাশাপাশি সরকারি ব্যয় নিয়ন্ত্রণের মধ্যে ভারসাম্য আনা প্রয়োজন।
মূল্যস্ফীতি
২০১১-১২ অর্থবছরের উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক আবারো সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি প্রণয়ন করেছে। মূল্যস্ফীতি গত তিন অর্থবছর থেকে ক্রমাগত বাড়ছে। খাদ্য বহির্ভুত মূল্যস্ফীতি গত অর্থবছরের শেষ ১০ মাসে আশংকাজনক হারে বেড়েছিল সরকারের মাত্রাতিরিক্ত উচ্চ ব্যাংক ঋণের ফলে। সাম্প্রতিক মূল্যস্ফীতি কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ হলো ধানের বাম্পার ফলন, মসলা ও অন্যান্য খাদ্যের উৎপাদানের মূল্য কমে যাওয়া।