বিতর্ক পিছু ছাড়ছেনা বিমান চেয়ারম্যান এয়ার মার্শাল জামাল উদ্দিন আহমেদের। বলা যায় তিনি নিজেই জন্ম দিয়ে যাচ্ছেন নতুন নতুন বিতর্কের। সবশেষ নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়ে য্ক্তুরাষ্ট্র সফর করলেন বিমান চেয়ারম্যান। আকষ্মিক যুক্তরাষ্ট্র সফর নিয়ে চলছে নানা গুঞ্জন।
গত ১০ জুলাই তিনি তিন সপ্তাহের সফরে ঢাকা ছাড়েন। ফেরেন ৩১ জুলাই। চেয়ারম্যানের পরপরই যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্যে ঢাকা ছাড়েন বিমানে বিতর্কিত ও দুর্নীতিবাজ হিসেবে পরিচিত জিএম মামদুদ খান। এতেই বিমানে শুরু হয়ে যায় কানা-ঘুষা।
আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসে দুটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্বান্ত প্রসঙ্গ। একটি হচেছ- হজ ফ্লাইট হিসেবে কাবো’র চুড়ান্ত অনুমোদন অপরটি মামদুদ খানের এক্সটেনশন।
আজ ৪ আগস্ট শনিবারের বোর্ড সভায় এ দুটো বিষয়ই অনুমোদন পেতে যাচ্ছে বলে জানিয়েছে সূত্র।
বিষয়টি নিয়ে বিমানের সিবিএতেও চলছে তীব্র প্রতিক্রিয়া। বোর্ড মিটিংয়ে কাবো ও মামদুদের বিষয়ে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত হলে ফের আন্দোলন দানা বেঁধে উঠবে বলে জানান -একজন শ্রমিকলীগ নেতা। তার মতে, একদিকে তিনি পাইলটদের বয়স বাড়ানো হবেনা বলে অনঢ় থাকবেন, অন্যদিকে জিমএম মামদুদ খানকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিয়ে বিমানের চল্লিশ বছরের ইতিহাস ভ্ঙ্গ করবেন, তা কিছুতেই হতে দেওয়া হবেনা।
অনুসন্ধানে জানা যায়, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স এর আগে কখনো পরিকল্পনা বিভাগের কোন জিএমকে এভাবে এক্সটেনশান দেয়নি।
ওই শ্রমিকলীগ নেতা প্রশ্ন তোলেন, মামদুদ কি এমন গুনধর কর্মকর্তা যে তাকে এক্সটেনশান দিতেই হবে। চেয়ারম্যান কেন তার প্রতি এতটা দৃর্বল ? তবে কি কাবো নিয়ে বাজারে যা শোনা যাচেছ সবই সত্য?
এদিকে শনিবারের বোর্ড সভায় হজ লিজে দ্বিতীয় জাহাজ কাবো-কে চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়া হবে বলেই নিশ্চিত করেছে সূত্র। এ বছর কাবো ছাড়া হজযাত্রী বহন করা সম্ভব নয় বলে- আগেই মন্তব্য করেছেন বিমান চেয়ারম্যান জামাল উদ্দিন। কাবোর প্রতি কেন তার এতো দুর্বলতা এমন প্রশ্ন ঘুরপাক খাচেছ বলাকা ভবনে।
এ ব্যাপারে বলাকা ভবনে চাউড় হয়েছে বিড়াল-শুটকি তত্ত্বও। বিড়াল যেমন শুটকির প্রতি আসক্ত- চেয়ারম্যানও তেমনি কাবোর প্রতি দুর্বল, এমন কথাও মুখে মুখে।
তাদের মতে, কোনো একটি অজানা দুর্বলতার কারণে অনেক বদনামের ভাগীদার হবার পরও বিমান চেয়ারম্যান কাবো থেকে সরে আসতে পারেননি।
সূত্র জানায় – ২০০৯ সালে হজ মওসুমে বিতর্কিত কাবোর জাহাজ নিয়ে চরম কেলেংকারির জন্ম দেন বিমান চেয়ারম্যান। তখন কাবোর প্রতিনিধি পলাশ নামের এক ব্যাক্তির সাথে জামাল উদ্দিনের অস্বাভাবিক ঘনিষ্ঠতা দেখে বিমানের সবস্তরেই কর্মকর্তা- কর্মচারী বিষ্ময় প্রকাশ করে।
উল্লেখ্য সেই সময়ে মামদুদ খান কাবোর বিপক্ষেই ছিলেন। এক নোটে তিনি লিখেছিলেন.. ডিসি -১০ বসিয়ে রেখে কাবো চালানো হচেছ। এতে অনেক ক্ষতি হচেছ। ওই নোট লেখার অপরাধে তখন তাকে চাকরিচ্যুত করার মতো হুমকি দিয়েছিলেন চেয়ারম্যান। তবে শেষ পর্যন্ত শো-কজ নোটিশ দিয়ে অন্যত্র বদলী করা হয় তাকে। অভিযোগ রয়েছে, এ অবস্থায় কিছুদিন পরই পলাশের মাধ্যমে চেয়ারম্যানের সাথে মধুর সম্পর্ক গড়ে তোলেন মামদুদ খান। এমনকি সম্প্রতি হংকং যাবার সময় বিমানের জাহাজে বসে চেয়ারম্যান পলাশের স্ত্রীর হাতে রান্না করা বিরিয়ানি খেয়ে উচ্ছসিত প্রশংসা করে বির্তকের জন্ম দেন। তারপর থেকেই পলাশ কাবোর জাহাজ নেওয়ার নেশায় মেতে ওঠেন। এবং সেভাবেই এক বছরের পরিবর্তে ছয় মাসের আরএফপি করিয়ে নেন তিনি। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, কমিশন বাণিজ্য ভাল করতেই তার এই উদ্যোগ। এতে বিমানকমীদের মধ্যে চরম ক্ষোভেরও সঞ্চার হয়। কারণ ছয় মাসের খরচের সাথে আর কিছু যোগ করলেই এক বছরের জন্য জাহাজটি নেওয়া সম্ভব হতো। তাতে বিমানের অনেক উপকার হতো। তাতের দাবি, শুধু কমিশন বাণিজ্যের জন্যই এক বছরের পরিবর্তে ছয় মাসের জন্য জাহাজ নেওয়ার দরপত্র ডাকা হয়। আর এতে সহায়তা করেন জিএম মামদুদ খান।
এ অবস্থায় পলাশের অনুরোধেই মামদুদের ছেলের বিয়েতে দাওয়াত খেতে গিয়ে আরেক বির্তকের জন্ম দেন চেয়ারম্যান। সূত্র জানায়, এখন পলাশই মামদুদকে যে কোন উপায়েই হোক পরিচালক পদে এক বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়ার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেছেন। পলাশই এখন বলে বেড়াচেছন- মামদুদের পরিচালক হওয়াটা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। তাকে এক্সটেনশন দেওয়া শনিবারের বোর্ড সভায়, এটাও নিশ্চিত করেছেন অনেকে।
ইতিমধ্যে চেয়ারম্যান মামদুদ খানের আরও এক বছর চু্ক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেবার ফাইল প্রস্তুত করতে নির্দেশ দিয়েছেন এমন তথ্য বাংলানিউজকে নিশ্চিত করেছেন বিমানের ভারপ্রাপ্ত কোম্পানি সেক্রেটারি ফজলূর রহমান।
বিমান চেয়ারম্যানের সঙ্গে ঘনিষ্ট এমন আরেকটি সুত্র জানায়, গত জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে পলাশ ডিওএইচএস বাসায় গিয়ে এ ব্যাপারে চেয়ারম্যানকে প্রস্তাব দেন। প্রথমে এতে চেয়ারম্যান আপত্তি জানালে পলাশ যুক্তি দেখান -সামনে কাবো নিয়ে সাংবাদিকরা অনেক কেলেংকারি করবে। এ সময় পরিকল্পনা বিভাগে মামদুদের মতো বিশ্বস্ত লোক ছাড়া অন্য কাউকে দায়িত্ব দিলে, সব গোপন তথ্য ফাঁস করে দেবে। সূত্রের মতে, পলাশের এমন অকাট্য যুক্তি খন্ডাতে পারেননি বিমান চেয়ারম্যান। এরপরই মামদুদকে ভারপ্রাপ্ত পরিচালকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। আর ঢাকা ছাড়ার আগে চেয়ারম্যান সবুজ সংকেত দিয়ে যান- যাতে মামদুদকে আরও এক বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়। এ সংক্রান্ত একটি দরখাস্ত এরই মধ্যে মামদুদ খান সংশ্লিষ্ট বিভাগে জমা দিয়েছেন বলেও নিশ্চিত করে সূত্র।
এদিকে পরিচালক হতে আগ্রহী এমন দু’জন জিএম বলেন – পরিচালক পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হলে বিমানে চেইন অব কমান্ড ভেঙ্গে পড়বে। এরপর আগামি সেপ্টেম্বরে অবসরে যাবার সময় রাজপতি সরকারও চু্ক্তিভিত্তিক থেকে যাবার আব্দার করবেন। এতে করে অপেক্ষায় থাকা জিএম খান মোশাররফ হোসেন, আতিক সোবহান, বেলায়েত হোসেন, মমিনুল ইসলাম, ফিরোজ খান ও আলি আহসান বাবুর মতো সিনিয়র কর্মকর্তাদের ভবিষ্যত অন্ধকার হয়ে যাবে। তারা তখন চেয়ারম্যানের পক্ষ ত্যাগ করে হাত মেলাবে আন্দোলনকারী মশিকুরদের সাথে। যা বিমানের পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে করবে বলেই আশঙ্কা তাদের।
সুত্র আরও জানায়, এবার বিমানের সব শর্ত পূরণ করেই দরপত্রে টিকে যাওয়ায় কাবো নিয়ে কোন প্রশ্ন করার সুযোগ থাকবেনা বলে চেয়ারম্যান বেশ আত্মবিশ্বাস নিয়ে মন্তব্য করেছেন। কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানা যায়- এবার কাবোর স্থানীয় প্রতিনিধি পরিবর্তন হয়েছে। এর নেপথ্যে কাজ করেছেন চেয়ারম্যানের ঘনিষ্ট একটি মহল। আর দৌড়ঝাঁপের জন্য সামনে রয়েছেন পলাশ। বিশ্বস্ততার সাথে পরিকল্পনা বিভাগের কাজ সম্পন্ন করার জন্যই জিএম মামুদুদ খানকে চুক্তিভিত্তিক পরিচালক করার কৌশল নিয়েছেন পলাশ।
সূত্র জানায়, বিমানের সাম্প্রতিক একটি সিদ্ধান্তে পলাশকে বলাকা ভবনে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হলেও পিছনে থেকে তিনিই সব কলকাঠি নাড়িয়ে যাচ্ছেন।
প্রশাসন বিভাগের একটি সুত্র জানায়- গত ৩১ জুলাই ছিল মামদুদ খানের অবসরে যাবার দিন। অথচ চেয়ারম্যান ঢাকা ছাড়ার আগের দিন তাকে ভারপ্রাপ্ত পরিচালক করে যান। মাত্র তিন সপ্তাহের জন্য কেন তাকে ভারপ্রাপ্ত পরিচালক করা হলো সেটা রহস্যজনক। এখন তাকে আরও এক বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক পরিচালক নিয়োগ করার এমন কি প্রয়োজন দেখা দিল এমন প্রশ্ন সবার। শনিবারের বোর্ড সভায় যদি এ দুটো গুরুত্বর্পুর্ণ সিদ্বান্ত নেওয়া হয়- তাহলে ফের বিমান অশান্ত হয়ে ওঠবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন একজন জিএম।
সুত্র জানায় -আসলে এ ধরণের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের দাযভার অন্যের ঘাড়ে চাপানোর জন্যই তিনি এবার ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করেছিলেন মোল্লা ওয়াহেদকে। বিমানের ইতিহাসে এর আগে কখনো এ ভাবে কাউকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করা হয়নি। জামাল উদ্দিন নিজেও এর আগে এক মাসের জন্য অস্ট্রেলিয়ায় যান তখনও কাউকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করেননি। এ বার দীর্ঘ নিয়ে কেন যুক্তরাষ্ট্রে গেলেন এ নিয়েও গুঞ্জন রয়েছে নানারকম।
কাবোর বিতর্ক এড়াতেই কি কাবোর খরচে এ সফর? আর চেয়ারম্যান দেশ ছাড়ার আগেই পলাশ কি করে বিমানে রটালেন যে আগামী বোর্ড সভায় কাবোর অনুমোদন দেওয়া হবে? চেয়ারমানের ব্যক্তিগত জীবন যাপন সম্পর্কে পলাশই বা কিভাবে অবহিত থাকে? তবে কি যুক্তরাষ্ট্র সফরের সাথে কাবোর চুক্তির কোন সংশ্লিষ্টতা রয়েছে? এসব প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে বলাকা ভবনের কক্ষে কক্ষে।
এ দিকে জনৈক বোর্ড মেম্বার না প্রকাশ না করার শর্তে জানান, চেয়ারম্যান জামাল উদ্দিন ও ভারপ্রাপ্ত পরিচালক (পরিকল্পনা) মামদুদ খান যুক্তরাষ্ট্রে বহুল বিতর্কিত কাবোর জাহাজ সরজমিনে দেখার জন্যই য্ক্তুরাষ্ট্রে গেছেন। যাতে পরে তারা এ নিয়ে কোন ধরনের সমস্যায় না পড়েন। তাদের এ সফরের সব খরচও বহন করছে কাবো কর্তৃপক্ষ।