মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের ৯ম সাক্ষী পরাগ ধরের সাক্ষ্য আবারো ক্যামেরা ট্রায়ালের (গোপন সাক্ষ্য) মাধ্যমে গ্রহণ করা হবে। আগামী ৭ আগস্ট মঙ্গলবার এ ক্যামেরা ট্রায়াল গ্রহণের আদেশ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১।
এর আগে গত ২৬ জুলাই ট্রাইব্যুনালে-১ সাক্ষ্য দিয়েছিলেন ব্যবসায়ী পরাগ ধর। তিনি সাক্ষ্য দেওয়ার পর ওই দিনই তাকে জেরাও সম্পন্ন করেন আসামিপক্ষের আইনজীবী আহসানুল হক হেনা।
এদিকে সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে ১০ম সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণের কথা রয়েছে আগামী রোববার ৫ আগস্ট।
বুধবার ৯ম সাক্ষী পরাগ ধরের বিষয়ে ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউশনের এক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তাকে ক্যামেরা ট্রায়ালের মাধ্যমে ফের সাক্ষ্যগ্রহণ করার জন্য আদেশ দেন চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হকের নেতৃত্বে দুই সদস্যের ট্রাইব্যুনাল।
আদেশে বলা হয়, ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপুর সঙ্গে আরো দু’জনসহ রাষ্ট্রপক্ষের মোট তিন জন এবং আসামিপক্ষের দু’জন আইনজীবীকে ওই দিন ক্যামেরা ট্রায়ালে শুনানি করতে পারবেন।
চিফ প্রসিকিউটর ছাড়াও সাকা চৌধুরীর মামলার প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম ও চিফ প্রসিকিউটরের পছন্দের একজন মোট তিন জন এবং ডিফেন্সের আহসানুল হক হেনার সঙ্গে আরো একজনসহ মোট পাচঁজন আইনজীবী উপস্থিত থাকবেন।
তবে আদালতের ভেতরের কোনো তথ্য ট্রাইব্যুনালের বাইরে কোনো আইনজীবী প্রকাশ করতে পারবেন না। এমনকি কোনো সাংবাদিকও সেদিনের সাক্ষ্যগ্রহণে উপস্থিত থাকতে পারবেন না।
রাষ্ট্রপক্ষের প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম জানান, তারা বুধবার ট্রাইব্যুনালের কাছে আবেদন করেন যে, সাক্ষী তার সাক্ষ্য দানকালে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বাদ দিয়েছেন। তাই পুনরায় সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ করা হোক।
এ বিষয়ে শুনানিতে তিনি বলেন, সাক্ষী তার জবানবন্দিতে যে বক্তব্য পেশ করবেন তা যেন ক্যামেরা ট্রায়ালের মাধ্যমে গ্রহণ করা হয়।
তিনি বলেন, সাক্ষী পরাগ ধরকে আসামিপক্ষের আইনজীবী তার সাক্ষ্যের বাইরে গিয়ে তাকে প্রশ্ন করে জেরা করেছেন। যা ট্রাইব্যুনালের আইনসম্মত হয়নি। এছাড়া আসামিপক্ষের আইনজীবী সাক্ষীকে এমন সব প্রশ্ন করেছেন, যা তিনি ট্রাইব্যুনালে দেওয়া সাক্ষ্যতে পেশ করেননি।’’
এর আগে ১৭ জুলাই ট্রাইব্যুনালে-২ আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে প্রথম ক্যামেরা ট্রায়ালের মাধ্যমে এক নারী ভিকটিমের সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়েছিল।
উল্লেখ্য, বর্তমানে ৪৮ বছর বয়সী পরাগের মুক্তিযুদ্ধকালে বয়স ছিল ৭ বছর। তিনি ট্রাইব্যুনালে তাদের বাড়িতে একাত্তরে রাজাকার-আলবদর বাহিনীর লুটপাটের কথা উল্লেখ করে সাক্ষ্য দেন।
তাকে সাক্ষ্য দানে সহায়তা করেছিলেন রাষ্ট্রপক্ষের প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম। আর সাক্ষ্য শেষে তাকে জেরা করেছিলেন আসামিপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট আহসানুল হক হেনা।
তবে আসামিপক্ষ জেরা শুরুর আগে এই সাক্ষীকে জেরার বিষয়ে বিরোধিতা করেন প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম। তিনি বলেন, ‘‘সাক্ষী ফজলুল কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন। আর আইনজীবী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর। কাজেই এ জেরার প্রয়োজন নেই।’’ এ সময় আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়ানো সাকা চৌধুরী বলেন, ‘‘আমি আমার পিতার প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থিত আছি।’’
পরাগ ধর তার সাক্ষ্যে বলেছিলেন, ‘‘আমার পিতার নাম মৃত মানিক ধর। ১৯৭১ সালে আমার বয়স ছিল সাত বছর। আমি বিএ পাস করেছি। বর্তমানে একটি ব্যবসা করি।’’
এপ্রিল মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মুসলীম লীগ গঠন করা হয়। মুসলীম লীগের সভাপতি ছিলেন ফজলুল কাদের চৌধুরী। শুনেছি, তখন লুটতরাজ হতো। রাজাকাররা বিভিন্ন ঝমেলা করতো। জগৎমল্ল পাড়া, মধ্য গহিরা, সুলতানপুর ও কুন্ডেশ্বরী এলাকায় আলবদররা গণহত্যা শুরু করেছিল বলে আমি শুনেছি।’’
সাক্ষী আরো বলেন, ‘‘ওই খবর পাওয়ার পরে আমার মা-বাবা ও ভাইসহ এলাকা থেকে পালিয়ে যাই। আমরা আগরতলা হয়ে কলকাতা চলে যায়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে দেশে ফিরে আসি।’’
‘‘আমার বাবা ঠিকাদার ছিলেন। তার একটি জিপ গাড়ি ও একটি ধান ভাঙ্গার মেশিন ছিল। দেশে ফিরে দেখলাম, সেগুলো রাজাকার ও আলবদর বাহিনীর সদস্যরা লুট করে নিয়ে গেছে। আমাদের বাড়িতে কিছুই ছিল না। আসবাবপত্র, দরজা সব কিছুই লুট করা হয়। আমি শুনেছি, ফজলুল কাদের চৌধুরীর নেতৃত্বে এসব ঘটনা ঘটেছিল তবে অন্য কারা ছিল আমি তা বলতে পারবো না।’’
পরাগ জানান, ‘‘১৯৭২ সালে আমাদের বাড়িতে লুটপাটের বিষয়ে একটি মামলা করা হয়েছিল। মামলায় কাদের আসামি করা হয়েছিল, তা আমি জানি না। কারণ, মামলার কোনো কপি আমি হাতে পাইনি। মামলার পরে বিভিন্ন সংস্থা আমাদের বাড়িতে এসে সাক্ষ্যগ্রহণ করে।’’
উল্লেখ্য, সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে গত ১৪ মে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরুর পর এ পর্যন্ত পরাগ ধর ছাড়াও বাংলা একাডেমীর সভাপতি বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ড. আনিসুজ্জামান, চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী সলিমুল্লাহ, মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম সিরু বাঙালি, শহীদ নূতন চন্দ্র সিংহের ভাতিজা গৌরাঙ্গ সিংহ ও পুত্র প্রফুল্ল রঞ্জন সিংহ, শহীদ পরিবারের সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট নির্মল চন্দ্র শর্মা, আব্বাস উদ্দিন আহম্মেদ (আব্বাস চেয়ারম্যান) এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবি) উপাচার্য মোঃ সালেহ উদ্দিন সাক্ষ্য দিয়েছেন। তাদের জেরাও সম্পন্ন করেছেন আসামিপক্ষ।
২০১০ সালের ২৬ জুন হরতালের আগের রাতে রাজধানীর মগবাজার এলাকায় গাড়ি ভাঙচুর ও গাড়ি পোড়ানোর অভিযোগে সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে রমনা থানায় মামলা দায়ের করা হয়। ওই মামলায়ই সে বছরের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের প্রত্যুষে গ্রেফতার করা হয় তাকে। ১৯ ডিসেম্বর একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয় তাকে। পরে ৩০ ডিসেম্বর আদালতের নির্দেশে প্রথমবারের মতো সাকা চৌধুরীকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়।
একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ২০১১ সালের ৩ অক্টোবর তার বিরুদ্ধে অগ্রগতি তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে তদন্ত দল। একই বছরের ১৪ নভেম্বর সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হয়। ১৮ নভেম্বর তার বিরুদ্ধে এ আনুষ্ঠানিক অভিযোগপত্র গ্রহণ করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
৫৫ পৃষ্ঠার আনুষ্ঠানিক অভিযোগের সঙ্গে এক হাজার ২৭৫ পৃষ্ঠার আনুষঙ্গিক নথিপত্র এবং ১৮টি সিডি ট্রাইব্যুনালে জমা দেয় প্রসিকিউশন।
৪ এপ্রিল সাকার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন ট্রাইব্যুনাল। এতে তার বিরুদ্ধে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় ২৩টি মানবতাবিরোধী অপরাধের উল্লেখ করা হয়। এসবের মধ্যে রয়েছে গণহত্যা, হত্যা, ধর্ষণ, অপহরণ করে গুডস হিলে নির্যাতন, দেশান্তরে বাধ্য করা, অগ্নিসংযোগসহ বিভিন্ন অপরাধ। ৩ মে ও ৭ মে রাষ্ট্রপক্ষের প্রসিকিউশনের সূচনা বক্তব্য (ওপেনিং স্টেটমেন্ট) উপস্থাপন সম্পন্ন করার মধ্য দিয়ে শুরু হয় সাকা চৌধুরীর বিচার।