প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পুঁজিবাজারের নিঃস্ব বিনিয়োগকারীদের শেয়ার ফোর্সড সেল (জোরপূর্বক বিক্রি) না করার জন্য ব্রোকারেজ হাউজ ও মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর প্রতি অনুরোধ জানালেও তা কর্ণপাত করছে না সংশ্লিষ্ট মহল।
সোমবার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) সোহেল সিকিউরিটিজের বিনিয়োগকারী আবু হানিফের পোর্টফলিওতে থাকা ৭০ লাখ টাকার শেয়ার জোরপূর্বক বিক্রি করে দিয়েছে ব্রোকারেজ হাউজ। এখানেই শেষ নয়, তার পোর্টফলিওর সব শেয়ার এমনভাবে বিক্রি করে দিয়েছে যে উল্টো তার কাছে আরো ২৩ লাখ টাকা দাবি করছে সোহেল সিকিউরিটিজ কর্তৃপক্ষ।
এ অবস্থায় কোনো উপায়ান্ত না পেয়ে সামগ্রিক বিষয় অবহিত করে এর প্রতিকার চেয়ে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনকে (এসইসি) চিঠি দিয়েছেন তিনি।
আবু হানিফের মতো আরো অনেক বিনিয়োগকারী রয়েছেন যারা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে নিঃস্ব হয়েছেন। সর্বশেষ ফোর্সড সেলের শিকার হয়ে পথে বসেছেন অনেকেই, মানবেতর জীবন-যাপন করছেন তারা। বিষয়টা তাদের মানসিকভাবে এতটাই ভেঙ্গে দিয়েছে যে কখনও পুঁজিবাজারের বিনিয়োগ করতেন- কাউকে তা জানাতেও ঘৃণা বোধ করেন। আবার পুঁজিবাজারে সর্বস্ব হারিয়ে চরম হতাশা নিয়ে কয়েকজন নিঃস্ব বিনিয়োগকারী আত্মহত্যার পথও বেছে নিয়েছেন।
এদিকে, আইনি বাধা না থাকার কারণে ফোর্সড সেলও ঠেকানো যাচ্ছে না। নিয়ন্ত্রক সংস্থা এসইসির চেয়ারম্যান ড. এম খায়রুল হোসেনও বারবার ফোর্সড সেল না করার জন্য ব্রোকারেজ হাউজ ও মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু তাতেও বন্ধ হয়নি ফোর্সড সেল। ফলে নিঃস্ব ও সর্বশান্ত বিনিয়োগকারীর সংখ্যা বাড়ছে ক্রমাগতভাবে।
ফোর্সড সেল সম্পর্কে সিএসইর সোহেল সিকিউরিটিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শাহজাহানের কাছে জানতে চাইলে তিনি তার অফিসে যোগাযোগ করতে বলেন। ফোর্সড সেলের বিষয়ে কিছু জানেন কি না- জানতে চাইলে তিনি কোনো উত্তর না দিয়ে ফোন রেখে দেন।
এদিকে, বাজার বিশ্লেষকদের মতে, ফোর্সড সেল বন্ধে এসইসির কোনো কিছু করার না থাকায় সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে। কিন্তু ব্রোকারেজ হাউজ ও মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর বোঝা উচিৎ বিনিয়োগকারীদের কারণেই প্রতিষ্ঠানগুলো টিকে আছে। তাই সাময়িক সমস্যা হলেও প্রতিষ্ঠানগুলোকে ফোর্সড সেল নামক নিষ্ঠুর কাজ থেকে বিরত থাকা উচিৎ।
এছাড়া ফোর্সড সেল হওয়ার কারণে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক কাজ করে। গত দুই-এক দিনের বাজার পর্যালোচনায় দেখা গেছে, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগের যথেষ্ট তথ্য থাকা সত্যেও ফোর্সড সেলের আতঙ্কে বাজারে নিম্নমুখী প্রবণতা বিরাজ করে।
অপরদিকে, শুধু সোহেল সিকিউরিটিজ নয়, ফোর্সড সেল করেছে এমন প্রতিষ্ঠানের অভাব নেই পুঁজিবাজারে। এর আগে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে তাজউদ্দিন নামের এক বিনিয়োগকারীর শেয়ার ফোর্সড সেল করে ইবিএল সিকিউরিটিজ। ওই বিনিয়োগকারীর ৩৭ লাখ টাকার শেয়ার ফোর্সড সেল করে প্রতিষ্ঠানটি। ফোর্সড সেল করার পরেও তার কাছে প্রতিষ্ঠানটি আরো ৮৪ হাজার টাকা দাবি করে।
এর আগে গত বছরের মে মাসে কয়েক শ’ বিনিয়োগকারীর শেয়ার ফোর্সড সেল করে হ্যাক সিকিউরিটিজ। তবে এক্ষেত্রে আরো বড় ধরনের জালিয়াতি করেছে প্রতিষ্ঠানটি। বিনিয়োগকারীদের স্বাক্ষর জালিয়াতি করে ভুয়া বিক্রয় আদেশ তৈরি করে প্রতিষ্ঠানটি। আর ওই ভুয়া স্বাক্ষরের বিক্রয়াদেশের ভিত্তিতে সমস্ত ফোর্সড সেলকে স্বাভাবিক শেয়ার বিক্রয় বলে চালিয়ে নিতে চায় প্রতিষ্ঠানটি।
গেল বছর বাজার পতন শুরু হলে ব্যাপক ফোর্সড সেল আতঙ্ক বিরাজ করে পুঁজিবাজারে। এর পরিপ্রেক্ষিতে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত এসইসি ও মার্চেন্ট ব্যাংকারদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত এক বৈঠক শেষে ফোর্সড সেলকে অনৈতিক বলে অভিহিত করেন।
এরপর গত ১৪ নভেম্বর এসইসির পক্ষ থেকে ফোর্স সেল বন্ধের আহ্বান জানানো হয় মার্জিন ঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে। যেসব বিনিয়োগকারী ফোর্সড সেলের শিকার হচ্ছেন তাদের অভিযোগের ভিত্তিতে বিভিন্ন ব্রোকারেজ হাউজকে তা বন্ধের অনুরোধ জানায় এসইসি।
একই সঙ্গে ফোর্সড সেল বন্ধ না করলে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হবে বলেও জানানো হয়।
কিন্তু, এত কিছুর পরও ফোর্সড সেলকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি নিয়ন্ত্রক সংস্থা এসইসি।
বিনিয়োগকারীরা বলছেন, বাজার যখন খুব ঊর্ধ্বমুখী ছিল তখন যার যা সঞ্চয় ছিল তা দিয়ে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করেছেন। তখন বাজার পতন হতে পারে, হলে এত বড় পতন হতে পারে, এমন সতর্কবার্তা দেয়নি কেউ। অনেকে এর সঙ্গে মার্জিণ ঋণ নিয়ে পুরো অর্থ দিয়ে শেয়ার ক্রয় করেছে। আর বাজারের চাঙ্গাভাব থাকা অবস্থায় ব্রোকারেজ হাউজগুলো বিনিয়োগকারীদের ডেকে ডেকে ঋণ সুবিধা দিয়েছে। পরে বাজারে ভয়াবহ পতন শুরু হলে ফোর্সড সেল শুরু করে প্রতিষ্ঠানগুলো।