কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে ৬ষ্ঠ সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ বুধবার

মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের ৫ম সাক্ষী শহীদ বুদ্ধিজীবী সাংবাদিক ও আইনজীবী খন্দকার আবু তালেবের পুত্র খন্দকার আবুল আহসানকে জেরা সম্পন্ন করেছেন আসামিপক্ষ।

সোমবার বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবীরের নেতৃত্বাধীন ৩ সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে-২ বর্তমানে সরকারি কর্মকর্তা আবুল আহসানকে জেরা শেষ করেন আসামিপক্ষের আইনজীবী একরামুল হক।

আগামী বুধবার কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে ৬ষ্ঠ সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ধার্য করেছেন ট্রাইব্যুনাল।

এর আগে রোববার সাংবাদিক ও আইনজীবী খন্দকার আবু তালেবকে নির্যাতন ও হত্যার পেছনে কাদের মোল্লার সংশ্লিষ্টতা তুলে ধরে সাক্ষ্য দেন খন্দকার আবুল আহসান (৫৫)। তিনি কাদের মোল্লার হাতে তার পিতা খন্দকার আবু তালেব হত্যাকাণ্ডের মর্মষ্পর্শী বর্ণনা দেন। সাক্ষ্য শেষে আসামিপক্ষের আইনজীবী একরামুল হক তাকে জেরা শুরু করেছিলেন।

খন্দকার আবুল আহসান তার সাক্ষ্য দানকালে একাত্তরে মিরপুর এলাকায় অবাঙালিদের সঙ্গে নিয়ে কাদের মোল্লার নির্যাতন-নিপীড়ন ও হত্যাযজ্ঞের নানা বিবরণ তুলে ধরেন।

তিনি বলেন, ‘‘আমার বাবা আইন পেশার পাশাপাশি সাপ্তাহিক ইত্তেহাদ, দৈনিক আযাদ, সংবাদ, ইত্তেফাক, দ্য মর্নিং নিউজ, অবজারভার ও পয়গাম পত্রিকায় কাজ করেছেন। ২৯ মার্চ অফিস থেকে মিরপুরে ফেরার পথে ইত্তেফাকের তত্কালীন অবাঙালি চিফ অ্যাকাউন্ট্যান্ট আবদুল হালিম আমার বাবাকে তার গাড়িতে তুলে নিয়ে পরে কাদের মোল্লার কাছে হস্তান্তর করে বলে জানতে পেরেছিলাম।’’

কাদের মোল্লার নৃশংসতার বিবরণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘‘মিরপুরের ১০ নম্বর জল্লাদখানায় আমার বাবাকে নিয়ে উপর্যুপরি ছুরিকাঘাত করে হত্যা করে। কারণ, তিনি মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের চিন্তাধারার ছিলেন। কাদের মোল্লার নির্দেশে সে সময় আক্তার গুণ্ডা ও আবদুল্লাহসহ বেশ কিছু বিহারি ওই এলাকাজুড়ে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালায়। তারা গাবতলী বাসস্ট্যান্ড ও টেকনিক্যাল থেকে বাঙালিদের ধরে এনে শিয়ালবাড়ী, মুসলিম বাজার বধ্যভূমি জল্লাদখানায় ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালায়।’’

উল্লেখ্য, সাক্ষ্যগ্রহণ শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত আবুল আহসান ছাড়াও আরো ৪ জন সাক্ষী ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিয়েছেন। তাদের মধ্যে প্রথম সাক্ষী বীর মুক্তিযোদ্ধা মোজাফফর আহম্মেদ খান একাত্তরের ২৫ নভেম্বর কাদের মোল্লার নেতৃত্বে কেরানীগঞ্জের শহীদনগর গ্রামের বড় ভাওয়াল খান বাড়ি ও ঘাটারচরসহ পাশের আরও দুটি গ্রামের গণহত্যার ঘটনা তুলে ধরেন। তিনি দাবি করেন, এই কাদের মোল্লা একাত্তরে তার নৃশংসতার জন্য ‘মিরপুরের জল্লাদ বা কসাই’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন।

দ্বিতীয় সাক্ষী বীর মুক্তিযোদ্ধা মামা বাহিনীর প্রধান ও কমান্ডার শহিদুল হক খান মামা মিরপুর-কেরানীগঞ্জে এই আলবদর কমান্ডারের হত্যা, গণহত্যাসহ নানা যুদ্ধাপরাধের আরো বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছিলেন।

চতুর্থ সাক্ষী কবি কাজী রোজি শহীদ বুদ্ধিজীবী কবি মেহেরুন্নেসা হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে ট্রাইব্যুনালকে অবহিত করেন। তিনি কবি মেহেরুন্নেসা ও তার পরিবারের চার সদস্যের হত্যাকাণ্ডে কাদের মোল্লা সরাসরি জড়িত ছিল বলে সাক্ষ্যে জানান।

এছাড়া গত ১৭ জুলাই কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের ৩য় সাক্ষী হিসেবে তার হাতে ক্ষতিগ্রস্ত এক নারী সাক্ষী রুদ্ধদ্বার কক্ষে গোপন সাক্ষ্য (ক্যামেরা ট্রায়াল) দেন। ওই দিন এবং পরদিন তার জেরা সম্পন্ন করেন আসামিপক্ষ। আরো একজন নারী সাক্ষীরও রুদ্ধদ্বার কক্ষে গোপন সাক্ষ্য (ক্যামেরা ট্রায়াল) দেওয়ার কথা রয়েছে খুব শিগগিরই।

গত ২৮ মে একাত্তরে হত্যা, গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ, ষড়যন্ত্র ও উস্কানিসহ ৬টি অভিযোগ এনে কাদের মোল্লার বিরদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের ৩(২)(এ), ৩(২)(জি), ৩(২)(এইচ), ৩(১), ৩(২)(এ)(এইচ) অভিযোগ গঠন করেন ট্রাইব্যুনাল-২। গত ২০ জুন তার বিরুদ্ধে ওপেনিং স্টেটমেন্ট (সূচনা বক্তব্য) উপস্থাপন করেন রাষ্ট্রপক্ষের প্রসিকিউটর মোহাম্মদ আলী ও সুলতান মাহমুদ। তারা ৯৬ পৃষ্ঠার এ সূচনা বক্তব্যে কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে আনা ৬টি অভিযোগ বিস্তারিতভাবে তুলে ধরেন।

কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে আনা ৬টি অভিযোগের মধ্যে রয়েছে, কবি মেহেরুন্নেছাসহ বুদ্ধিজীবী হত্যা, পল্লবীর আলোকদি গ্রামে ৩৪৪ জনকে হত্যা, খন্দকার আবু তালেবকে হত্যা, বাংলা কলেজের ছাত্র পল্লবসহ সাত জনকে হত্যা, কেরানীগঞ্জের শহীদনগর গ্রামের ভাওয়াল খান বাড়ি ও খাটারচরসহ পাশের আরো দু’টি গ্রামের অসংখ্য লোককে হত্যার ঘটনা।

মুক্তিযুদ্ধকালে গোলাম মোস্তফা নামে এক মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যার অভিযোগে ২০০৭ সালের ১৭ ডিসেম্বর জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কাদের মোল্লাসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে কেরানীগঞ্জ থানায় একটি মামলা হয়। ওই মামলাটি করেছিলেন কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে প্রথম সাক্ষী মোস্তফার কমান্ডার মোজাফফর আহমেদ খান। ২০০৮ সালে পল্লবী থানায় আরো একটি মামলা হয় কাদের মোল্লাসহ আরো অনেকের বিরুদ্ধে। ওই মামলার অভিযোগে ২০১০ সালের ১৩ জুলাই তাকে গ্রেফতার করা হয়।

আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে গত বছরের ১ নভেম্বর জমা দেওয়া তদন্ত প্রতিবেদনে হত্যা, খুন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের বিভিন্ন অভিযোগ আনা হয়। ২৮ ডিসেম্বর তার বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল।

গত ১৬ এপ্রিল আব্দুল কাদের মোল্লার মামলাসহ তিনটি মামলা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ থেকে ট্রাইব্যুনাল-২ এ স্থানান্তর করা হয়।

উল্লেখ্য, স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কাজ শুরু করার পর গ্রেফতারকৃত বিএনপি-জামায়াতের ৯ নেতার মধ্যে মোট ৫ জনের বিরুদ্ধে সাক্ষ্যগ্রহণ চলছে। বর্তমানে কাদের মোল্লা ছাড়াও জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযম, নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ এবং বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্যগ্রহণ অব্যাহত রয়েছে। তারা ছাড়াও জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ ও বিএনপির সাবেক মন্ত্রী আব্দুল আলীমের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেছেন ট্রাইব্যুনাল।

এছাড়া গ্রেফতারকৃত জামায়াতের কর্মপরিষদ ও নির্বাহী কমিটির সদস্য মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে গত ৫ জুলাই তদন্তের অগ্রগতি প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে এবং আগামী ১২ আগস্ট তদন্ত সংস্থার আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিলের কথা রয়েছে।

অন্যদিকে জামায়াতের সাবেক রোকন আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকারের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনাল-২ গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করলেও তিনি পালিয়ে দেশত্যাগ করেন। তার বিরুদ্ধে তদন্ত শেষ হয়েছে এবং তদন্ত সংস্থা চূড়ান্ত তদন্ত প্রতিবেদন ট্রাইব্যুনালে জমা দিয়েছে।

গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে একমাত্র বিএনপি নেতা আবদুল আলীম শর্তসাপেক্ষে জামিনে থাকলেও অন্যরা কারাগারে আটক আছেন। তবে অসুস্থতার কারণে গোলাম আযম বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল ও সাঈদী বারডেম হাসপাতালের প্রিজন সেলে চিকিৎসাধীন।

বাংলাদেশ