মাহবুব-উল-আলম খান
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বব্যাংক স্থাপিত হয়েছিল গরীব, স্বল্প্ন্নোত, যুদ্ধ
বিধ্বস্ত দেশগুলিকে অবকাঠামো উন্নয়নে আর্থিক, কারিগরি ও প্রয়োজনীয়
সহায়তা প্রদানের জন্য। কিন্তু ক্রমেক্রমে বর্তমানে উহা রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের
অর্থনীতিতে পরিণত হয়েছে। মুরব্বী উন্নত দেশগুলি এ প্রতিষ্ঠানটিকে নিজেদের
স্বার্থে ব্যবহার করছে। বর্তমানে আরো ন্যাক্কারজনকভাবে গরীব দেশগুলিকে অপমান
করছে। নিজেদের একগুয়েমীর কাছে বন্দি করে ফেলেছে। পদ্মা সেতুর জন্য ঋণ প্রদানে
দীর্ঘ সময়ক্ষেপন করে অবশেষে বর্তমান সরকারের হাতে তাদের মেয়াদ মাত্র দেড় বছর
থাকতে উদ্দেশ্যমূলকভাবে অর্থায়নে অপারগতা প্রকাশ করেছে। বিষয়টি অত্যন্ত
দূর্ভাগ্যজনক। সম্ভাব্য দুর্নীতির আশংকায় দুর্নীতির ষড়যন্ত্র হয়েছে এ মর্মে
ঋণ প্রদান বাতিল করা হয়েছে। এটা অত্যন্ত হাস্যকর ব্যাপার।্ দুর্নীতি প্রমাণ
না করে, প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত কাউকে দুর্নীতিবাজ বলা অন্যায়, অসভ্যতা
ও দূরভিসন্ধিমূলক কাজ। বাংলাদেশে অবশ্য বিগত বিএনপি জামাত জোট সরকারের
আমলে বেশ কয়েকটি প্রকল্পে বিদ্যুৎ, যোগাযোগ ইত্যাদি ক্ষেত্রে দুর্নীতির জন্য
বিশ্বব্যাংক ঋণ বাতিল করেছে। কিন্তু পদ্মা সেতু নির্মানে যেখানে অর্থই ছাড়
হয়নি সেখানে দুর্নীতির ষড়যন্ত্র হয়েছে- এই অভিযোগে কেন এমন নির্মম
রসিকতা করা হলো বোধগোম্য নয়। বিশ্বব্যাংক মনোনীত কোম্পানিকে তাদের
অযোগ্যতার জন্য যোগ্য বিবেচনা করা যায়নি। স্বনামধন্য প্রকৌশলী অধ্যাপক
জামিলুর রেজা চৌধুরীর নেতৃত্বে গঠিত কমিটি বিশ্বব্যাংকের সুপারিশকৃত
কোম্পানিকে যোগ্য বিবেচনা করতে পারেনি। এতে সরকারের কিছুই করার নেই।
বিশ্বব্যাংক তাদের স্বার্থ হাসিল না হওয়ায় দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করে এখন ঋণ
প্রদান বাতিল করল। এটা দুঃখজনক ও অপমানজনক। তাদের অপারগতা আরো এক বছর
আগে জানাতে পারত। জানা যায় তাদের মনোনীত কোম্পানিতে নাকি একজন
পাকিস্তানী পার্টানার আছে। তাহলে বুঝা যাচ্ছে এখানে রাজনৈতিক অর্থনীতি
এই অপমান আমাদের টনক নাড়িয়ে দিয়েছে। নিজ পায়ে দাঁড়ানোর একটি সোনালী
দ্বার উন্মোচন করেছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে দৃঢ় কণ্ঠে
উচ্চারণ করেছেন পদ্মা সেতু নিজস্ব অর্থায়নেই হবে। তাঁর এ আহ্বান দেশে
বিদেশে সকল বাঙালরি মনে দারুণ উৎসাহের সৃষ্টি করেছে। চারিদিক হতে
দেশপ্রেমিক নাগরিকগণ, প্রতিষ্ঠান অর্থায়নে আগ্রহ প্রকাশ করছেন। কষ্ট করেও
এদেশের মানুষ এই সেতুর বাস্তবায়ন চায়। বিগত আওয়ামীলীগ সরকারের আমলেই
পদ্মা সেতু নির্মানের কাজ শুরুর উদ্যোগ নেয়া হয়। কিন্তু ২০০১ এ বিএনপি জামাত
জোট ক্ষমতা দখল করে এই সেতু নির্মাণে কোন উদ্যোগ নেয়নি। বিশ্বব্যাংকের ঋণ
বাতিল সিদ্ধান্তে বিএনপি নেতৃবৃন্দ এখন আনন্দে উচ্ছ্বল। খন্দকারেরা, মির্জারা,
বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী বুদ্ধিজীবীরা, দুর্নীতির দায়ে আয়ূবখান আমলে ৩০৩ এ
চাকুরিচ্যুত কর্মকর্তা যুদ্ধাপরাধীরা প্রতিদিনই টকশোতে, মানববন্ধনে ও
বিভিন্ন প্রোগ্রামে অনবরত চিল্লাচিল্লি করতে করতে কান ঝালাপালা করে ফেলছে।
বিভিন্ন চ্যানেল অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে এদের উদ্ভট ভাষণ প্রচার করে যাচ্ছে। এই অপ-
প্রচারে সরকারের তেমন জবাব নেই। বিরোধী চোখ, মানুষের চোখ, জনতার চোখ ও
নানবিধ মিডিয়ায় এরা যেভাবে সরকারের বিরুদ্ধে প্রপাগন্ডা করছে মনে হচ্ছে সরকার
সম্পূর্ণ ব্যর্থ। বিভিন্ন টকশোতে কতিপয় যুদ্ধাপরাধী রক্ষাকারীরা, বসন্তের
কোকিলেরা, পাকিস্তানী প্রেতাত্মারা নানা সুরে তালে বেতালে অনর্গল বয়ান করে
যাচ্ছে। বলতে চাচ্ছে বর্তমান সরকার ২০০১-২০০৬ এর আইয়ামে জাহেলিয়াতকে
ছাড়িয়ে যাচ্ছে। বিরোধী দলীয় নেত্রী বলেন, সরকার দুর্নীতিবাজ, লজ্জা থাকলে পদত্যাগ
করুন। সরকার দেশের সম্পদ অন্যের হাতে তুলে দেয় ইত্যাদি ইত্যাদি। বিরোধী দলীয় নেত্রী
যদি অন্য কাউকে দুর্নীতিবাজ বলেন তাহলে হাসি পায়। তিনি ক্ষমতায় থাকাকালে
যেসব দুর্নীতি করেছেন তা কি ভুলে গেছেন? তিনি নিজে তার অর্থমন্ত্রী ও দলের
অনেক নেতানেত্রী জরিমানা দিয়ে অপ্রদর্শিত আয় অর্থাৎ অবৈধ উপায়ে অর্জিত
অর্থের কর দিয়েছেন। তার আমলে বাংলাদেশ চারবার দুর্নীতিতে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন
হয়েছে। ব্যর্থ, অকার্যকর ও জঙ্গী রাষ্টে পরিণত হয়েছিল। এখন নিজেই লজ্জাসরম ভুলে
উচ্চস্বরে নর্দন-কুর্দন শুরু করেছেন। একেই বলে চোরের মার বড় গলা। ১৯৯২ সনে
পাকিস্তান হতে কঠিন শর্তে পাবনা সুগার মিল আধুনিকায়নের জন্য খালেদা
জিয়া ঋণ নেন। এত কঠিন শর্ত কেন, কার স্বার্থে এ ঋণের জন্য বাংলাদেশকে অনর্থক
কয়েক গুন বেশি অর্থ পরিশোধ করতে হবে। এত কঠিন শর্তে পাকিস্তান হতে ঋণ
নেয়ার কারণ কি? ১৯৭১ সনের পাকিস্তান প্রেমই যদি মনে থাকে; তাহলে জনগণের
পয়সায় প্রেম দেবেন কেন? বিএনপি নেতানেত্রীরা এখন বলছেন আগামীতে ক্ষমতায়
গিয়ে তারা দুইটি পদ্মা সেতু করবেন এবং সকল দুর্নীতির বিচার করবেন। এ মর্মে
সবিনয় নিবেদন জানাব, ২০০১-২০০৬ এ হাওয়া ভবন, খোয়াব ভবন, তার দুই ছেলে
তারেক-কোকো, হারিছ চৌধুরী, মামুন ইত্যাদির দুর্নীতির বিচার দিয়ে শুরু করুন।
হারিছ চৌধুরী এখন কোথায়? সকল দুর্নীতির তদন্ত চাই এবং জনগণের সম্পদ
ফেরত চাই। বাচ্চু রাজাকার এখন কোথায়? আদালতের রায়ে সেনাবাহীনির সম্পদ
কেন্টনমেন্টের বাড়ি ফেরত দিতে বাধ্য হয়েছেন। গুলশানে অনৈতিকভাবে প্রায় চার
বিঘা জমিসহ দখলকৃত বাড়িটি সরকারকে ফেরত দিন। সম্পদের তো অভাব নেই।
বিদেশি আদালতে তারেক কোকোর বিচার হয়েছে। দেশে এনে আইনের হাতে বিচারের
সম্মুখীন করুন। দুর্নীতি না করলেতো ভয়ের কিছু নেই। দেশে আইনের শাসন
কায়েমে সরকারকে সহায়তা করুন।
ড. মো. ইউনুস নোবেল বিজয়ী সম্মানিত বাঙালী। তিনি সর্বোচ্চ আদালতে
তাঁর পদ রক্ষায় হেরে গেছেন। এখানে সরকারের কিছুই করার নেই। তাঁর জন্য বিশ্ব
নেতৃবৃন্দ ওকালতি করেছেন। হিলারী ক্লিনটন তাঁর ঘনিষ্ট বন্ধু। সরকারকে সবিনয়
অনুরোধ জানাব আমেরিকার বন্ধুকে এদেশের উন্নয়নে কাজে লাগাতে পারেন
কি-না দেখুন। সৈয়দ আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে অনেকে উঠেপড়ে লেগেছেন। কেউ
কাউকে মুখে বললেই তাকে দুর্নীতিবাজ বলা যায় না। উহা প্রমাণ করতে হবে।
আপনারা আবুল হোসেনের দুর্নীতি প্রমাণ করুন, প্রমানিত হলে তাকে শাস্তি
দিন। হাওয়ার উপর কথা বলা অন্যায়। অনর্থক মানুষকে অপমান করার অধিকার কোরো
নাই। তারেক-কোকো দুর্নীতির জন্য বিদেশি আদালতে দোষী।
হাতে তুলে দেয়াই হবে ন্যায় বিচার। যে কোম্পানিকে কাজ দেয়ার জন্য বিশ্বব্যাংক
বারবার পত্র দিয়েছে, যোগ্য না হওয়ায় উক্ত কোম্পানি বিবেচনায় আসেনি। সন্দেহ
হচ্ছে এই কোম্পানিকে পর্দার আড়ালে যুদ্ধাপরাধীরা, পরাজিত শক্তি, মুক্তিযুদ্ধের
চেতনা বিরোধী শক্তি কৌশলে ব্যবহার করে দুর্নীতির ফাঁদ পেতেছে কিনা; বিষয়টি
তাদেরকে আইনের
রহস্যজনক। নইলে বিশ্বব্যাংক একটি অযোগ্য কোম্পানিকে কাজ দেয়ার জন্য বারবার
পত্র দেবে কেন? সফল না হয়ে ১০% উৎকোচের নাটক সাজানো হয়েছে কিনা তলিয়ে
দেখা প্রয়োজন। বিশ্বব্যাংক এর মুরব্বিগণ এদেশের এজেন্টদের সহায়তায় কখন কোন
স্বার্থে, কি ষড়যন্ত্র করে বুঝা মুস্কিল। যুদ্ধাপরাধীর দোষরেরা যেভাবে বিভিন্ন টিভি
চ্যানেলে, মিডিয়ায় চেচাচ্ছেন তারা কি ধরে নিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের কান্ডারীগণ
এতই দূর্বল? তারা যদি মনে করেন যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাতে পারবেন, পাকিস্তানী
প্রেতাত্মাদের বাঁচাতে পারবেন তাহলে ভুল করবেন। ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল ও ফোর্বসের
প্রতিবেদনে বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতির চিত্র উঠে এসেছে। এগুলি তলিয়ে দেখা
প্রয়োজন। বিশ্বব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট ইসাবেল ঢাকা এসে যে দুটি পত্র
দিয়েছেন ঐ পত্রে দেখা গেছে দুর্নীতির অভিযোগটি বিএনপি জামাত জোট
আমলের মন্ত্রির বিরুদ্ধে। তাহলে বুঝুন আসল ঘটনা কোথায় এবং কেন?
বর্তমান সরকারের সামগ্রিক কর্মকান্ডকে আরো গতিশীল ও সুষ্ঠুভাবে এগিয়ে
নিয়ে যেতে হবে। আর মাত্র দেড় বছর সময়ের মধ্যে বিরোধীদের সকল অপতৎপরতার দাঁত
ভাঙ্গা জবাব দিতে হবে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে স্যাবোটেজ চলছে। ২৫শে ফেব্র“য়ারী ২০০৯
বিডিআর হত্যা দিয়ে উহার শুরু। চোখ কান খোলা রেখে সামনে এগুতে হবে। প্রশাসন
দক্ষ ও কমিটেড না হলে কাজে গতি আসবেনা। মন্ত্রিকে হতে হবে সৎ, দক্ষ, নিষ্ঠাবান
ও আদর্শবান। এ মূহুর্তে মন্ত্রিসভার কতিপয়কে বাদ দিয়ে যোগ্য অভিজ্ঞদের অন্ত
র্ভূক্তিকরণ সময়ের দাবী। কথাবার্তা বলতে হবে ভেবেচিন্তে সঠিকভাবে। ক্লাউনের
মতো কথা বলা, ভোট নষ্ট ও ভাবমূর্তি নষ্ট, অতিকথা কখনোই কাম্য নয়। কথা কম
কাজ বেশি উহাই হতে হবে মূলমন্ত্র। দলকে, কর্মীদের, নেতানেত্রীদের আরো চাঙা
হতে হবে। সকল অপপ্রচারের উপযুক্ত জবাব দিতে হবে। দলের সাধারণ সম্পাদক ও অন্যান্য
গুরুত্বপূর্ণ পদধারীদের দলীয় কাজে ও কার্যালয়ে আরো সময় দিতে হবে। দলের সাধারণ
সম্পাদককে ফুল টাইম পার্টির কাজে নিয়োজিত রাখাই কাম্য। বঙ্গবন্ধু মন্ত্রিত্ব
ছেড়ে দলের দায়িত্বে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন। এজন্যই আওয়ামীলীগে তার
লক্ষ্যে পৌঁছতে পেরেছেন। জাতির জনকের প্রদর্শিত পথই আমাদের অনুসরণ করা
বাঞ্ছনীয়। দেশ ও জাতির স্বার্থে এই দেড় বছরে আওয়ামীলীগ তথা মহাজোটকে আরো
সংঘবদ্ধ হতে হবে আগামী এক সোনালী ভবিষ্যতের জন্য। যে গভীর ষড়যন্ত্রে বিরোধী
জোট এগিয়ে যাচ্ছে একে সঠিকভাবে মোকাবেলা করতে না পারলে দেশ ও জাতি
গভীর অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে। অতএব সরকার প্রধানকে জরুরি করণীয় ব্যাপারে বাস্ত
ব পদক্ষেপ নিতে হবে। শেয়ার বাজার কেলেংকারীদের কঠোর সাজা দিন। যুদ্ধাপরাধীদের
বিচার এ বছরই শেষ করুন। পদ্মা সেতু নির্মান শুরু করুন। প্রয়োজনে বিশ্বব্যাংকের
সাথে পুনরায় বিষয়টি উত্থাপন করা যায়। কেননা সম্ভাব্য দুর্নীতির ধারণা একটা
হাস্যকর ব্যার্পা, এটা বিরোধী শিবিরের রাজনীতি। সরকারের উচিৎ অভিযোগ
উদঘাটন ও প্রকাশ করা। মন্ত্রিসভাকে দক্ষ রাজনীতিবিদদের দ্বারা ঢেলে সাজাতে হবে।
প্রশাসনকে গতিশীল করতে হবে; সৎ, নিষ্ঠাবান ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্ভাসিত
কর্মকর্তাদের গুরুত্বপূর্ণ উচ্চপদে সমাসীন করে। সকলের সম্মিলিত প্রয়াসে গড়ে
তুলতে হবে একটি আধুনিক উন্নত ডিজিটাল বাংলাদেশ। রূপকল্প ২০২১ এর অঙ্গীকার
বাস্তবায়ন না হলে জনগণ বিমুখ হবেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রি এই চিন্তা ও
চেতনায় সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। জনগণ এখনো দিশেহারা হয়নি।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্ভাসিত পথেই এগিয়ে যাবে বাঙালী জাতি। অতএব দেড়
বছর সময় কাজে লাগাতে হবে মানুষের কল্যাণে, মানুষের প্রত্যাশা বাস্তবায়নে।
অপনার আহ্বান নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু হবে, উহাই সকল বাঙালীর আকাঙ্খা।
এই সেতুর নাম হোক “স্বাধীনতা সেতু”।
(লেখক সাবেক সচিব)পদ্মা সেতুর নাম হোক “স্বাধীনতা সেতু”।
আগামী দেড় বছর সময় কাজে লাগাতে মানুষের প্রত্যাশা বাস্ত
বায়নে
মাহবুব-উল-আলম খান
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বব্যাংক স্থাপিত হয়েছিল গরীব, স্বল্প্ন্নোত, যুদ্ধ
বিধ্বস্ত দেশগুলিকে অবকাঠামো উন্নয়নে আর্থিক, কারিগরি ও প্রয়োজনীয়
সহায়তা প্রদানের জন্য। কিন্তু ক্রমেক্রমে বর্তমানে উহা রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের
অর্থনীতিতে পরিণত হয়েছে। মুরব্বী উন্নত দেশগুলি এ প্রতিষ্ঠানটিকে নিজেদের
স্বার্থে ব্যবহার করছে। বর্তমানে আরো ন্যাক্কারজনকভাবে গরীব দেশগুলিকে অপমান
করছে। নিজেদের একগুয়েমীর কাছে বন্দি করে ফেলেছে। পদ্মা সেতুর জন্য ঋণ প্রদানে
দীর্ঘ সময়ক্ষেপন করে অবশেষে বর্তমান সরকারের হাতে তাদের মেয়াদ মাত্র দেড় বছর
থাকতে উদ্দেশ্যমূলকভাবে অর্থায়নে অপারগতা প্রকাশ করেছে। বিষয়টি অত্যন্ত
দূর্ভাগ্যজনক। সম্ভাব্য দুর্নীতির আশংকায় দুর্নীতির ষড়যন্ত্র হয়েছে এ মর্মে
ঋণ প্রদান বাতিল করা হয়েছে। এটা অত্যন্ত হাস্যকর ব্যাপার।্ দুর্নীতি প্রমাণ
না করে, প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত কাউকে দুর্নীতিবাজ বলা অন্যায়, অসভ্যতা
ও দূরভিসন্ধিমূলক কাজ। বাংলাদেশে অবশ্য বিগত বিএনপি জামাত জোট সরকারের
আমলে বেশ কয়েকটি প্রকল্পে বিদ্যুৎ, যোগাযোগ ইত্যাদি ক্ষেত্রে দুর্নীতির জন্য
বিশ্বব্যাংক ঋণ বাতিল করেছে। কিন্তু পদ্মা সেতু নির্মানে যেখানে অর্থই ছাড়
হয়নি সেখানে দুর্নীতির ষড়যন্ত্র হয়েছে- এই অভিযোগে কেন এমন নির্মম
রসিকতা করা হলো বোধগোম্য নয়। বিশ্বব্যাংক মনোনীত কোম্পানিকে তাদের
অযোগ্যতার জন্য যোগ্য বিবেচনা করা যায়নি। স্বনামধন্য প্রকৌশলী অধ্যাপক
জামিলুর রেজা চৌধুরীর নেতৃত্বে গঠিত কমিটি বিশ্বব্যাংকের সুপারিশকৃত
কোম্পানিকে যোগ্য বিবেচনা করতে পারেনি। এতে সরকারের কিছুই করার নেই।
বিশ্বব্যাংক তাদের স্বার্থ হাসিল না হওয়ায় দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করে এখন ঋণ
প্রদান বাতিল করল। এটা দুঃখজনক ও অপমানজনক। তাদের অপারগতা আরো এক বছর
আগে জানাতে পারত। জানা যায় তাদের মনোনীত কোম্পানিতে নাকি একজন
পাকিস্তানী পার্টানার আছে। তাহলে বুঝা যাচ্ছে এখানে রাজনৈতিক অর্থনীতি
এই অপমান আমাদের টনক নাড়িয়ে দিয়েছে। নিজ পায়ে দাঁড়ানোর একটি সোনালী
দ্বার উন্মোচন করেছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে দৃঢ় কণ্ঠে
উচ্চারণ করেছেন পদ্মা সেতু নিজস্ব অর্থায়নেই হবে। তাঁর এ আহ্বান দেশে
বিদেশে সকল বাঙালরি মনে দারুণ উৎসাহের সৃষ্টি করেছে। চারিদিক হতে
দেশপ্রেমিক নাগরিকগণ, প্রতিষ্ঠান অর্থায়নে আগ্রহ প্রকাশ করছেন। কষ্ট করেও
এদেশের মানুষ এই সেতুর বাস্তবায়ন চায়। বিগত আওয়ামীলীগ সরকারের আমলেই
পদ্মা সেতু নির্মানের কাজ শুরুর উদ্যোগ নেয়া হয়। কিন্তু ২০০১ এ বিএনপি জামাত
জোট ক্ষমতা দখল করে এই সেতু নির্মাণে কোন উদ্যোগ নেয়নি। বিশ্বব্যাংকের ঋণ
বাতিল সিদ্ধান্তে বিএনপি নেতৃবৃন্দ এখন আনন্দে উচ্ছ্বল। খন্দকারেরা, মির্জারা,
বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী বুদ্ধিজীবীরা, দুর্নীতির দায়ে আয়ূবখান আমলে ৩০৩ এ
চাকুরিচ্যুত কর্মকর্তা যুদ্ধাপরাধীরা প্রতিদিনই টকশোতে, মানববন্ধনে ও
বিভিন্ন প্রোগ্রামে অনবরত চিল্লাচিল্লি করতে করতে কান ঝালাপালা করে ফেলছে।
বিভিন্ন চ্যানেল অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে এদের উদ্ভট ভাষণ প্রচার করে যাচ্ছে। এই অপ-
প্রচারে সরকারের তেমন জবাব নেই। বিরোধী চোখ, মানুষের চোখ, জনতার চোখ ও
নানবিধ মিডিয়ায় এরা যেভাবে সরকারের বিরুদ্ধে প্রপাগন্ডা করছে মনে হচ্ছে সরকার
সম্পূর্ণ ব্যর্থ। বিভিন্ন টকশোতে কতিপয় যুদ্ধাপরাধী রক্ষাকারীরা, বসন্তের
কোকিলেরা, পাকিস্তানী প্রেতাত্মারা নানা সুরে তালে বেতালে অনর্গল বয়ান করে
যাচ্ছে। বলতে চাচ্ছে বর্তমান সরকার ২০০১-২০০৬ এর আইয়ামে জাহেলিয়াতকে
ছাড়িয়ে যাচ্ছে। বিরোধী দলীয় নেত্রী বলেন, সরকার দুর্নীতিবাজ, লজ্জা থাকলে পদত্যাগ
করুন। সরকার দেশের সম্পদ অন্যের হাতে তুলে দেয় ইত্যাদি ইত্যাদি। বিরোধী দলীয় নেত্রী
যদি অন্য কাউকে দুর্নীতিবাজ বলেন তাহলে হাসি পায়। তিনি ক্ষমতায় থাকাকালে
যেসব দুর্নীতি করেছেন তা কি ভুলে গেছেন? তিনি নিজে তার অর্থমন্ত্রী ও দলের
অনেক নেতানেত্রী জরিমানা দিয়ে অপ্রদর্শিত আয় অর্থাৎ অবৈধ উপায়ে অর্জিত
অর্থের কর দিয়েছেন। তার আমলে বাংলাদেশ চারবার দুর্নীতিতে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন
হয়েছে। ব্যর্থ, অকার্যকর ও জঙ্গী রাষ্টে পরিণত হয়েছিল। এখন নিজেই লজ্জাসরম ভুলে
উচ্চস্বরে নর্দন-কুর্দন শুরু করেছেন। একেই বলে চোরের মার বড় গলা। ১৯৯২ সনে
পাকিস্তান হতে কঠিন শর্তে পাবনা সুগার মিল আধুনিকায়নের জন্য খালেদা
জিয়া ঋণ নেন। এত কঠিন শর্ত কেন, কার স্বার্থে এ ঋণের জন্য বাংলাদেশকে অনর্থক
কয়েক গুন বেশি অর্থ পরিশোধ করতে হবে। এত কঠিন শর্তে পাকিস্তান হতে ঋণ
নেয়ার কারণ কি? ১৯৭১ সনের পাকিস্তান প্রেমই যদি মনে থাকে; তাহলে জনগণের
পয়সায় প্রেম দেবেন কেন? বিএনপি নেতানেত্রীরা এখন বলছেন আগামীতে ক্ষমতায়
গিয়ে তারা দুইটি পদ্মা সেতু করবেন এবং সকল দুর্নীতির বিচার করবেন। এ মর্মে
সবিনয় নিবেদন জানাব, ২০০১-২০০৬ এ হাওয়া ভবন, খোয়াব ভবন, তার দুই ছেলে
তারেক-কোকো, হারিছ চৌধুরী, মামুন ইত্যাদির দুর্নীতির বিচার দিয়ে শুরু করুন।
হারিছ চৌধুরী এখন কোথায়? সকল দুর্নীতির তদন্ত চাই এবং জনগণের সম্পদ
ফেরত চাই। বাচ্চু রাজাকার এখন কোথায়? আদালতের রায়ে সেনাবাহীনির সম্পদ
কেন্টনমেন্টের বাড়ি ফেরত দিতে বাধ্য হয়েছেন। গুলশানে অনৈতিকভাবে প্রায় চার
বিঘা জমিসহ দখলকৃত বাড়িটি সরকারকে ফেরত দিন। সম্পদের তো অভাব নেই।
বিদেশি আদালতে তারেক কোকোর বিচার হয়েছে। দেশে এনে আইনের হাতে বিচারের
সম্মুখীন করুন। দুর্নীতি না করলেতো ভয়ের কিছু নেই। দেশে আইনের শাসন
কায়েমে সরকারকে সহায়তা করুন।
ড. মো. ইউনুস নোবেল বিজয়ী সম্মানিত বাঙালী। তিনি সর্বোচ্চ আদালতে
তাঁর পদ রক্ষায় হেরে গেছেন। এখানে সরকারের কিছুই করার নেই। তাঁর জন্য বিশ্ব
নেতৃবৃন্দ ওকালতি করেছেন। হিলারী ক্লিনটন তাঁর ঘনিষ্ট বন্ধু। সরকারকে সবিনয়
অনুরোধ জানাব আমেরিকার বন্ধুকে এদেশের উন্নয়নে কাজে লাগাতে পারেন
কি-না দেখুন। সৈয়দ আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে অনেকে উঠেপড়ে লেগেছেন। কেউ
কাউকে মুখে বললেই তাকে দুর্নীতিবাজ বলা যায় না। উহা প্রমাণ করতে হবে।
আপনারা আবুল হোসেনের দুর্নীতি প্রমাণ করুন, প্রমানিত হলে তাকে শাস্তি
দিন। হাওয়ার উপর কথা বলা অন্যায়। অনর্থক মানুষকে অপমান করার অধিকার কোরো
নাই। তারেক-কোকো দুর্নীতির জন্য বিদেশি আদালতে দোষী।
হাতে তুলে দেয়াই হবে ন্যায় বিচার। যে কোম্পানিকে কাজ দেয়ার জন্য বিশ্বব্যাংক
বারবার পত্র দিয়েছে, যোগ্য না হওয়ায় উক্ত কোম্পানি বিবেচনায় আসেনি। সন্দেহ
হচ্ছে এই কোম্পানিকে পর্দার আড়ালে যুদ্ধাপরাধীরা, পরাজিত শক্তি, মুক্তিযুদ্ধের
চেতনা বিরোধী শক্তি কৌশলে ব্যবহার করে দুর্নীতির ফাঁদ পেতেছে কিনা; বিষয়টি
তাদেরকে আইনের
রহস্যজনক। নইলে বিশ্বব্যাংক একটি অযোগ্য কোম্পানিকে কাজ দেয়ার জন্য বারবার
পত্র দেবে কেন? সফল না হয়ে ১০% উৎকোচের নাটক সাজানো হয়েছে কিনা তলিয়ে
দেখা প্রয়োজন। বিশ্বব্যাংক এর মুরব্বিগণ এদেশের এজেন্টদের সহায়তায় কখন কোন
স্বার্থে, কি ষড়যন্ত্র করে বুঝা মুস্কিল। যুদ্ধাপরাধীর দোষরেরা যেভাবে বিভিন্ন টিভি
চ্যানেলে, মিডিয়ায় চেচাচ্ছেন তারা কি ধরে নিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের কান্ডারীগণ
এতই দূর্বল? তারা যদি মনে করেন যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাতে পারবেন, পাকিস্তানী
প্রেতাত্মাদের বাঁচাতে পারবেন তাহলে ভুল করবেন। ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল ও ফোর্বসের
প্রতিবেদনে বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতির চিত্র উঠে এসেছে। এগুলি তলিয়ে দেখা
প্রয়োজন। বিশ্বব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট ইসাবেল ঢাকা এসে যে দুটি পত্র
দিয়েছেন ঐ পত্রে দেখা গেছে দুর্নীতির অভিযোগটি বিএনপি জামাত জোট
আমলের মন্ত্রির বিরুদ্ধে। তাহলে বুঝুন আসল ঘটনা কোথায় এবং কেন?
বর্তমান সরকারের সামগ্রিক কর্মকান্ডকে আরো গতিশীল ও সুষ্ঠুভাবে এগিয়ে
নিয়ে যেতে হবে। আর মাত্র দেড় বছর সময়ের মধ্যে বিরোধীদের সকল অপতৎপরতার দাঁত
ভাঙ্গা জবাব দিতে হবে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে স্যাবোটেজ চলছে। ২৫শে ফেব্র“য়ারী ২০০৯
বিডিআর হত্যা দিয়ে উহার শুরু। চোখ কান খোলা রেখে সামনে এগুতে হবে। প্রশাসন
দক্ষ ও কমিটেড না হলে কাজে গতি আসবেনা। মন্ত্রিকে হতে হবে সৎ, দক্ষ, নিষ্ঠাবান
ও আদর্শবান। এ মূহুর্তে মন্ত্রিসভার কতিপয়কে বাদ দিয়ে যোগ্য অভিজ্ঞদের অন্ত
র্ভূক্তিকরণ সময়ের দাবী। কথাবার্তা বলতে হবে ভেবেচিন্তে সঠিকভাবে। ক্লাউনের
মতো কথা বলা, ভোট নষ্ট ও ভাবমূর্তি নষ্ট, অতিকথা কখনোই কাম্য নয়। কথা কম
কাজ বেশি উহাই হতে হবে মূলমন্ত্র। দলকে, কর্মীদের, নেতানেত্রীদের আরো চাঙা
হতে হবে। সকল অপপ্রচারের উপযুক্ত জবাব দিতে হবে। দলের সাধারণ সম্পাদক ও অন্যান্য
গুরুত্বপূর্ণ পদধারীদের দলীয় কাজে ও কার্যালয়ে আরো সময় দিতে হবে। দলের সাধারণ
সম্পাদককে ফুল টাইম পার্টির কাজে নিয়োজিত রাখাই কাম্য। বঙ্গবন্ধু মন্ত্রিত্ব
ছেড়ে দলের দায়িত্বে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন। এজন্যই আওয়ামীলীগে তার
লক্ষ্যে পৌঁছতে পেরেছেন। জাতির জনকের প্রদর্শিত পথই আমাদের অনুসরণ করা
বাঞ্ছনীয়। দেশ ও জাতির স্বার্থে এই দেড় বছরে আওয়ামীলীগ তথা মহাজোটকে আরো
সংঘবদ্ধ হতে হবে আগামী এক সোনালী ভবিষ্যতের জন্য। যে গভীর ষড়যন্ত্রে বিরোধী
জোট এগিয়ে যাচ্ছে একে সঠিকভাবে মোকাবেলা করতে না পারলে দেশ ও জাতি
গভীর অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে। অতএব সরকার প্রধানকে জরুরি করণীয় ব্যাপারে বাস্ত
ব পদক্ষেপ নিতে হবে। শেয়ার বাজার কেলেংকারীদের কঠোর সাজা দিন। যুদ্ধাপরাধীদের
বিচার এ বছরই শেষ করুন। পদ্মা সেতু নির্মান শুরু করুন। প্রয়োজনে বিশ্বব্যাংকের
সাথে পুনরায় বিষয়টি উত্থাপন করা যায়। কেননা সম্ভাব্য দুর্নীতির ধারণা একটা
হাস্যকর ব্যার্পা, এটা বিরোধী শিবিরের রাজনীতি। সরকারের উচিৎ অভিযোগ
উদঘাটন ও প্রকাশ করা। মন্ত্রিসভাকে দক্ষ রাজনীতিবিদদের দ্বারা ঢেলে সাজাতে হবে।
প্রশাসনকে গতিশীল করতে হবে; সৎ, নিষ্ঠাবান ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্ভাসিত
কর্মকর্তাদের গুরুত্বপূর্ণ উচ্চপদে সমাসীন করে। সকলের সম্মিলিত প্রয়াসে গড়ে
তুলতে হবে একটি আধুনিক উন্নত ডিজিটাল বাংলাদেশ। রূপকল্প ২০২১ এর অঙ্গীকার
বাস্তবায়ন না হলে জনগণ বিমুখ হবেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রি এই চিন্তা ও
চেতনায় সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। জনগণ এখনো দিশেহারা হয়নি।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্ভাসিত পথেই এগিয়ে যাবে বাঙালী জাতি। অতএব দেড়
বছর সময় কাজে লাগাতে হবে মানুষের কল্যাণে, মানুষের প্রত্যাশা বাস্তবায়নে।
অপনার আহ্বান নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু হবে, উহাই সকল বাঙালীর আকাঙ্খা।
এই সেতুর নাম হোক “স্বাধীনতা সেতু”।
(লেখক সাবেক সচিব)