প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আবারও নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতু নির্মাণের দৃঢ় প্রত্যয় ঘোষণা করে প্রবাসীদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, “পদ্মাসেতু নির্মাণের জন্যে চাঁদা সংগ্রহের প্রয়োজন নেই। আপনারা দেশে নিয়মিত যে রেমিট্যান্স পাঠান এখন থেকে এর পরিমাণ কিছুটা বাড়িয়ে দিন। আপনাদের পাঠানো এই রেমিট্যান্স থেকেই পদ্মাসেতুর খরচের বিরাট অংশ বেরিয়ে আসবে।”
তিনি বলেন, “একটি মিথ্যা অভিযোগ তুলে বিশ্বব্যাংক আমাদের দেড় বছর সময় নেওয়ার পর পদ্মাসেতুর ঋণচুক্তি বাতিল করেছে। অথচ বার বার অনুরোধ করার পরও তাঁরা অভিযোগের কোনো প্রমাণ দিতে পারেনি।”
প্রধানমন্ত্রী দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, “আমরা মুক্তিযুদ্ধ করে যখন একটি দেশ স্বাধীন করতে পেরেছি, তখন কারো সাহায্য না নিয়ে পদ্মাসেতুও করতে পারবো ইনশাল্লাহ। বাঙালি বীরের জাতি। এই জাতি মাথা উঁচু করে চলতে চায়, কারো করুণার পাত্র হয়ে নয়।”
তিনি বলেন, “ইতোমধ্যে আমরা পদ্মাসেতুর সব পরিকল্পনা ঠিক করে ফেলেছি। জমি অধিগ্রহণসহ বিভিন্ন কাজ প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা খরচও হয়ে গেছে।”
শনিবার কেন্দ্রীয় লন্ডনের হোটেল পার্ক প্লাজায় যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের আয়োজনে প্রবাসীদের এক ইফতার মাহফিল ও নৈশভোজেপ্রধানমন্ত্রী এই আহ্বান জানান। যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের সভাপতি সুলতান শরীফের সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ ফারুকের পরিচালনায় ইফতার-পূর্ব বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী দেশে বেশি করে বিনিয়োগ করার জন্যেও প্রবাসীদের প্রতি আহ্বান জানান।
প্রায় হাজার খানেক প্রবাসীর উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত ইফতার-পূর্ব বক্তৃতায় অন্যদের মধ্যে অংশ নেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি, ব্রিটিশ এমপি মাইক গেইপস, লেবার পার্টির এমপি ভ্যালরি ভাজ, সাবেক ব্রিটিশ এমপি মাইক্যাল বার্ন, আওয়ামী লীগ দলীয় সাংসদ শফিকুর রহমান চৌধুরী, ইউরোপিয়ান আওয়ামী লীগের সভাপতি অনিল দাশগুপ্ত, যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি জালাল উদ্দিন, হরমুজ আলী, যুগ্ন-সাধারণ সম্পাদক আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী, মারুফ চৌধুরী, নঈম উদ্দিন রিয়াজ, সাংগঠনিক সম্পাদক শাহাব উদ্দিন চঞ্চল, সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য তারিফ আহমেদ, যুবলীগ সাধারণ সম্পাদক সেলিম খান, ছাত্রলীগ সভাপতি ঝলক পাল ও আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ নেতা অনুকুল তালুকদার ডাল্টন প্রমুখ।
অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর ছেলে সজিব ওয়াজেদ জয় ও শেখ রেহানার মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিকী উপস্থিত থাকলেও তারা বক্তব্য রাখেননি।
প্রধানমন্ত্রী তার ২৩ মিনিটের বক্তৃতায় দেশে বিনিয়োগের আহ্বান জানিয়ে প্রবাসীদের আশ্বস্ত করে বলেন, “বাংলাদেশে বিনিয়োগের পরিবেশ এখন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে ভালো।”
রধানমন্ত্রী বলেন, “এক সময় ব্রিটেনের আনাচে-কানাচে শুধুই চিকেন চিপসের গন্ধ পাওয়া যেত, আর এখন পাওয়া যায় কারির। ব্রিটিশরা নিজেদের খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করে আজ তারাকারির গন্ধে বিভোর। তারা এই গন্ধে যত বেশি বিভোর হবে ততই আমাদের অর্থাৎ বাংলাদেশের ব্যবসার সুযোগ বাড়বে। এটি আপনাদের কাজে লাগাতে হবে।”
তিনি খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ খাতে দেশে বিনিয়োগের পরামর্শ দিয়ে বলেন, “দেশ থেকে সবকিছু তৈরি করে এনে ব্রিটিশদের পাতে শুধু খাবারটি তুলে দেবেন। অর্থাৎ রেডি টু কুক অথবা রেডি টু ইট, যাই আপনারা বলেন। এতে আপনাদের যেমন হবে লাভ, তেমনি লাভ হবে আপনার মাতৃভূমিরও।”
বর্তমান সরকারের উন্নয়ন কার্যক্রমের বর্ণনা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশের কথা বলেছিলাম। প্রতিটি থানায় ইন্টারনেট সংযোগের কথা বলেছিলাম। শুধু থানায় নয়, দেশের প্রতিটি ইউনিয়নের মানুষ আজ ইন্টারনেট সুবিধা ভোগ করছেন।”
প্রধানমন্ত্রী বলেন, “সারা বিশ্বে যখন চলেছে অর্থনিতক মন্দা, বাংলাদেশে তখন বাড়ছে গড় মাথাপিছু আয়।” ১৯৯৬-২০০১ শাসনামলে তার সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরবর্তী সরকার ধরে রাখতে পারেনি অভিযোগ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “খাদ্য উৎপাদনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে উন্নয়ন আমরা করেছিলাম বিগত শাসনামলে, পরবর্তী সরকার তা ধরে রাখতে পারেনি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসার পর কোনো জবাবদিহিতা ছিল না। ফলে দেশের উন্নয়ন করার যে সুযোগ ছিল, সেই সুযোগ তারা কাজে না লাগিয়ে নিজের কাজে ব্যবহার করেছে। ফলে দেশ গিয়েছিল কয়েক বছর পিছিয়ে।”
গণতান্ত্রিক শাসন ঝুঁকিমুক্ত রাখতে সংবিধান সংশোধন করা হয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “অগণতান্ত্রিক শক্তির ক্ষমতায় আসার পথ চিরতরে রুদ্ধ করতেই আমরা সংবিধান সংশোধন করেছি। এখন মূল কাজ হলো গণতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখা।”
সিলেটে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর করে সিলেট-লন্ডন সরাসরি ফ্লাইট আওয়ামী লীগের আগের মেয়াদে চালু করলেও বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় এসে তা বন্ধ করে দিয়েছিল বলে অভিযোগ করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, “রিফুয়েলিংয়ের ব্যবস্থা হয়ে গেলেই আবার সিলেট-লন্ডন ফ্লাইট চালু হবে।”
শিক্ষা ক্ষেত্রে সিলেটসহ সারা দেশের উন্নয়নে সন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, “আমাদের এসব অর্জন ধরে রাখতে হবে। আমাদের দুর্ভাগ্য যে, বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ড করি আমরা আর পরে বিএনপি এসে ফিতা কাটে। গাছ লাগাই আমরা, ফল খায় বিএনপি।”
প্রধানমন্ত্রী ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একটিমধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে পরিণত করার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করে বলেন, “ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে পারলে ইনশাল্লাহ আমরা আমাদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারবো।”
প্রধানমন্ত্রী তার বক্তৃতায় প্রবাসীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলন, বঙ্গবন্ধু এবং বিভিন্ন দুঃসময়ে তার পাশে প্রবাসীদের এসে দাঁড়ানোর বিষয়টি স্মরণ করেন।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেন, “যুদ্ধাপরাধীদের সমর্থকদের তৎপরতা নিয়ে প্রতিদিন শত শত ই-মেল যায় আমার কাছে। আওয়ামী লীগের এবারের মেয়াদে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে না পারলে তা আর করা সম্ভব হবে কি না এতে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।” ব্রিটেনের বাংলা টিভি চ্যানেলগুলোতে চ্যারিটি ফান্ড রেইজিং-এর নামে যে অর্থ সংগ্রহ করা হচ্ছে, তা প্রকৃত কাজে ব্যয় হচ্ছে কি না এ বিষয়েও তিনি প্রশ্ন তুলেন।
লেবার দলীয় এমপি ভ্যালরি ভাজ বাংলাদেশকে একটি সম্ভাবনাময় দেশ হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, “অচিরেই এই দেশটি ভারত ও চীনের পথ ধরে অর্থনীতিতে শক্তিশালী অবস্থানে গিয়ে দাঁড়াবে বলে আমার বিশ্বাস।”
লেবার দলীয় আরেক এমপি মাইক গেইপস ব্রিটেন প্রবাসীরাই বাংলাদেশের প্রকৃত বন্ধু হিসেবে শেখ হাসিনার কাছে পরিচয় করিয়ে দেন।